০৩:৪৯ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও আমাদের বঙ্গমাতা

সাদিয়া রহমান: স্রষ্টার সব সৃষ্টি-ই জন্মগতভাবে স্বাধীন। কিন্তু জীবনে চলার প্রতিটি ধাপেই আমাদেরকে পরাধীনতা বরণ করে নিতে হয়! তবুও স্বাধীনতা আমাদের পরম আরাধ্য, প্রার্থিত, কাঙ্ক্ষিত! এজন্যেই হয়তো, স্বাধীনতার ব্যাপ্তি, বিস্তৃতি এবং গভীরতা শব্দটির অর্থের চেয়েও ব্যাপক।

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, হাজার বছরের বাঙালী জাতি বরাবরই ছিলো পরাধীন কিংবা শাসনাধীন। দীর্ঘ এই পথপরিক্রমায় না ছিলো স্বাধীন স্বতন্ত্র্ বাংলা ভূখন্ডের অস্তিত্ব, না ছিলেন কোনো বাঙালী শাসনকর্তা। স্বাধীন বাংলা ভূখন্ডের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়ে বাঙালী জাতিকে এই পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে সর্বপ্রথম মুক্তির স্বাদ এনে দেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

আর অভূতপূর্ব কিংবদন্তীগাঁথা এই অর্জনে যে মানুষটি সবসময় বঙ্গবন্ধুর ছায়া হয়ে পাশে ছিলেন, সাহচার্য দিয়েছেন, সাহস জুগিয়েছেন, বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে গোটা জাতির ভার বহন করেছেন, তিনি বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব

বাঙালী জাতির অন্যতম এই অগ্রপথিক ১৯৩০ সালের ৮ আগস্ট গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর ডাকনাম ছিলো রেনু। তাঁর পিতার নাম শেখ জহুরুল হক ও মাতার নাম হোসনে আরা বেগম। মাত্র তিন বছর বয়সে পিতা এবং পাঁচ বছর বয়সে মাতাকে হারান তিনি। মাত্র আট বছর বয়সে ১৯৩৮ সালে চাচাতো ভাই শেখ মুজিবের সঙ্গে বিয়ে হয় তাঁর। ব্যক্তি জীবনে দুই কন্যা ও তিন ছেলের জননী ছিলেন রত্নগর্ভা এই নারী। তাঁর জৈষ্ঠ্য কন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশের চারবারের প্রধানমন্ত্রী। তাঁর অন্য চার সন্তান যথাক্রমে, শেখ রেহানা এবং শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শেখ রাসেল।

বেগম মুজিবের রেনু থেকে বঙ্গমাতা হয়ে উঠার গল্পটা ভীষণ অনুপ্রেরণাদায়ী। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের তাঁর বিখ্যাত নারী কবিতায় লিখেছিলেন, “পৃথিবীতে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।” বিদ্রোহী কবির পঙক্তি গুলো যে কী ভীষণ রকমে সত্য, তা আমরা বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের জীবনীর দিকে আলোকপাত করলেই বুঝতে পারি।

বাঙালীর স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রবাদ পুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বিশ্ব রাজনীতিতেও এক সময় মহীরুহ হয়ে উঠেন জাতির পিতা। কিন্তু, জেল-জুলুম-সংগ্রামমুখর জীবনের এই বন্ধুর পথ তিনি পাড়ি দিতে পেরেছিলেন সহধর্মিণী ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের আকণ্ঠ সমর্থন এবং সাহচার্যে।

যখনই বঙ্গবন্ধু দেশের কাজে বেরিয়েছেন, একা হাতে সংসার ও সন্তানদের সকল দায়িত্ব সামলেছেন ফজিলাতুন্নেছা। স্বীয় ধৈর্য্য, ত্যাগ, মমত্ত্ববোধ এবং প্রজ্ঞা গুণে তিনি হয়ে উঠেছিলেন বঙ্গবন্ধুর ভরসার জায়গা। সামরিক জান্তার রোষানলে পড়ে বঙ্গবন্ধু যতবারই কারাবরণ করেছেন, সংসার সামলানোর পাশাপাশি দলীয় নেতাকর্মীদের দিকনির্দেশনা দেয়ার ভারও নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছেন তিনি। পাহাড়ের মতো অবিচল থেকে সামলেছেন প্রতিটি দায়িত্ব।

বঙ্গবন্ধু প্রায়শই নিজ করণীয় নির্ধারণে সহধর্মীণীর সঙ্গে পরামর্শ করতেন, যার সবচেয়ে বড় প্রমাণ ঐতিহাসিক ০৭-ই মার্চের ভাষণ। সেদিন ভাষণের পূর্বে বঙ্গমাতা স্বামীকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, “তুমি তোমার সারাটা জীবন এদেশের মানুষের জন্য লড়াই করেছ। ভাষণে কি বলতে হবে, সেটা তুমিই সবচেয়ে ভাল জানো। তুমি তোমার হৃদয়ের কথা শুনো।” বঙ্গবন্ধুর ঠিক তা-ই করেছিলেন। সেদিন আঠারো মিনিটের অলিখিত বক্তব্যে পৃথিবীর ইতিহাসে এক নতুন মানচিত্রের ভিত্তি স্থাপন করেন তিনি।

এছাড়াও, ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৫৪’র নির্বাচন, ৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৬-র ছয় দফা আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ৬৯’ এর গণ-অভ্যুত্থান, ৭০’র নির্বাচন ও আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধসহ দেশের যেকোনো গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব সবসময় বঙ্গবন্ধুকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিয়েছেন। নিজ স্বামীর জীবন শঙ্কা ও অনিশ্চয়তায় ভরপুর থাকা সত্ত্বেও দেশ ও জাতির স্বার্থে সবসময়ই সাহসের পরিচয় দিয়েছেন তিনি। এজন্যেই গোটা জাতি ভালোবেসে শ্রদ্ধাবনত চিত্তে তাঁর নাম দিয়েছে বঙ্গমাতা। টুঙ্গিপাড়ার ছোট্ট রেনু হয়েছেন বাঙালী জাতির বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব।

মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গমাতার অবদান নিয়ে যতো বলা হবে, ততই যেনো কম! যে উপমাতেই বিশেষায়িত করা হোক না কেনো, শব্দভাণ্ডার ফুরিয়ে যাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট রচনা হয় পাকিস্তান আমলের দীর্ঘ ২৪ বছরের শাসনামলে। দীর্ঘ এই পথপরিক্রমায় জাতির অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করেন বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর সবচেয়ে ভরসার পাত্র হয়ে গোটা আন্দোলন-সংগ্রামে সাহস জোগান বঙ্গমাতা।

মুক্তি সংগ্রামের শুরু থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত বঙ্গমাতা যদি একটুও আপোষ করতেন, তাহলে বাংলাদেশের ইতিহাস অন্যরকম হতে পারতো। ২৫শে মার্চের কালরাত্রিতে হানাদার বাহিনী যখন বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়, তখনও তাঁর পাশেই ছিলেন শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব।

পাকবাহিনী কর্তৃক বঙ্গবন্ধুকে বন্দী করে করাচী নিয়ে যাবার পর পরিবারের সবাইকে নিয়ে ধানমন্ডির ঐতিহাসিক ৩২ নং বাড়ী ত্যাগ করেন বঙ্গমাতা। কিন্তু, মগবাজারের নিকটস্থ একটি ফ্ল্যাট থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়মিত পরামর্শ ও নির্দেশনা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অনবদ্য ভূমিকা রাখছিলেন বঙ্গমাতা। পরবর্তীতে এরই জেরে ১২ মে, ১৯৭১ এ- পুত্র-কন্যা সহ পরিবারের সকলের সঙ্গে তাঁকে বন্দী করে পাকবাহিনী এবং ধানমন্ডির ৯এ সড়কের (পুরনো ১৮) ২৬ নং বাড়িতে ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত বন্দী করে রাখা হয় তাঁদেরকে।

যুদ্ধ শেষে দেশ গঠনে বঙ্গমাতার অবদান কিংবদন্তীগাঁথা। বলা হয়ে থাকে, স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা কঠিন। তাই স্বাধীনতা রক্ষার্থে ও জাতির বিনির্মাণে স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করেন বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। বিশেষ করে, গোটা দেশজুড়ে নির্যাতিত মা-বোনদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন তিনি এবং সামাজিকভাবে তাদের প্রতিষ্ঠিত করার উদ্যোগ নেন। একই কাজে নিজ সন্তানদেরও বিলিয়ে দেন তিনি। তাই বলাই বাহুল্য, দেশ গঠনে বঙ্গমাতার অবদান যেমন অনবদ্য, দেশপ্রেমে তিনি চির ভাস্বর, সদা অম্লান।

বঙ্গমাতার জীবন থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা-ও দেশের প্রত্যেক নারী ও পুরুষের জন্য অনুকরণীয়। শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব এক সংগ্রামী, আদর্শিক ও মহীয়সী নারীর প্রতিভূ। তিনি অসাধারণ মেধা, অসীম সাহস, দৃঢ় মনোবল, সর্বংসহা ও দূরদৃষ্টি সম্পন্ন ছিলেন। প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও তিনি কখনো মনোবল হারাতেন না। তাঁর এই গুণগুলোই তাঁকে করেছে অনন্য। তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর মানসিক অস্ত্র। তাঁর জীবন থেকে কেবল বাংলা নয়, গোটা বিশ্বের নারী জাতির শিক্ষণীয় উপাদান রয়েছে প্রচুর।

কিন্তু সব সূর্যেরই অস্ত থাকে। স্বাধীনতা বিরোধী চক্র যখন কোনোভাবেই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ উত্থান থামানোর উপায় খুঁজে পাচ্ছিলো না, তখন ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় তাঁরা। স্বাধীনতা ও দেশবিরোধী অপশক্তি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাতে জাতির পিতার সঙ্গে বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকেও সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করে, যা জাতির ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে।

তবে দেশের প্রতি বঙ্গমাতার অকৃত্রিম ভালোবাসা ও ত্যাগকে মহামান্বিত করে রাখতে স্বাধীন বাংলাদেশের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক সরকার তাঁর নামে সারাদেশ জুড়ে বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং আবাসিক হল প্রতিষ্ঠা করেছে। এছাড়াও, শ্রদ্ধাভরে প্রতিবছর পালন করা হয় তাঁর জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী।

দেশ ও জাতিকে নিজ পরিবার তূল্য জ্ঞান করে সর্বদা নিজ মমতায় আগলে রেখেছেন বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। দিনের পর দিন কষ্ট সহ্য করেছেন জাতির মঙ্গলের আশায়। তাঁর জীবনী প্রতিটি বাঙালী নারীর উজ্জীবনী শক্তি। নারী জাগরনের অগ্রপথিক তিনি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদান যতটা দৃশ্যমান, তারচেয়ে অনেক বেশি মনস্তাত্ত্বিক। পর্দার আড়ালে থেকেও একটি জাতিকে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌছে দেয়ার কঠিনতম কাজটি করেছেন তিনি।

ক্ষণজন্মা এই নারী কখনোই নিজ স্বার্থ বিবেচনায় নেননি। তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণের দায়িত্ব এখন আমাদের তরুণ প্রজন্মের কাঁধে। তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল রাষ্ট্র বাংলাদেশকে উন্নত বিশ্বের সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তোলার গুরুদায়িত্ব আমাদেরকেই নিতে হবে। তাই আমাদের সকলেরই উচিত মহিয়সী এই নারীর জীবনীকে পাথেয় করে ভবিষ্যতের পথে যাত্রা করা।

 

লেখক: সাদিয়া রহমান, শিক্ষার্থী, এগ্রিকালচার, সেশন: ২০১৭-১৮, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল, নোবিপ্রবি

ট্যাগ:
জনপ্রিয়

বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও আমাদের বঙ্গমাতা

প্রকাশ: ০১:৫০:৪১ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৭ ডিসেম্বর ২০২১

সাদিয়া রহমান: স্রষ্টার সব সৃষ্টি-ই জন্মগতভাবে স্বাধীন। কিন্তু জীবনে চলার প্রতিটি ধাপেই আমাদেরকে পরাধীনতা বরণ করে নিতে হয়! তবুও স্বাধীনতা আমাদের পরম আরাধ্য, প্রার্থিত, কাঙ্ক্ষিত! এজন্যেই হয়তো, স্বাধীনতার ব্যাপ্তি, বিস্তৃতি এবং গভীরতা শব্দটির অর্থের চেয়েও ব্যাপক।

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, হাজার বছরের বাঙালী জাতি বরাবরই ছিলো পরাধীন কিংবা শাসনাধীন। দীর্ঘ এই পথপরিক্রমায় না ছিলো স্বাধীন স্বতন্ত্র্ বাংলা ভূখন্ডের অস্তিত্ব, না ছিলেন কোনো বাঙালী শাসনকর্তা। স্বাধীন বাংলা ভূখন্ডের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়ে বাঙালী জাতিকে এই পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে সর্বপ্রথম মুক্তির স্বাদ এনে দেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

আর অভূতপূর্ব কিংবদন্তীগাঁথা এই অর্জনে যে মানুষটি সবসময় বঙ্গবন্ধুর ছায়া হয়ে পাশে ছিলেন, সাহচার্য দিয়েছেন, সাহস জুগিয়েছেন, বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে গোটা জাতির ভার বহন করেছেন, তিনি বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব

বাঙালী জাতির অন্যতম এই অগ্রপথিক ১৯৩০ সালের ৮ আগস্ট গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর ডাকনাম ছিলো রেনু। তাঁর পিতার নাম শেখ জহুরুল হক ও মাতার নাম হোসনে আরা বেগম। মাত্র তিন বছর বয়সে পিতা এবং পাঁচ বছর বয়সে মাতাকে হারান তিনি। মাত্র আট বছর বয়সে ১৯৩৮ সালে চাচাতো ভাই শেখ মুজিবের সঙ্গে বিয়ে হয় তাঁর। ব্যক্তি জীবনে দুই কন্যা ও তিন ছেলের জননী ছিলেন রত্নগর্ভা এই নারী। তাঁর জৈষ্ঠ্য কন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশের চারবারের প্রধানমন্ত্রী। তাঁর অন্য চার সন্তান যথাক্রমে, শেখ রেহানা এবং শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শেখ রাসেল।

বেগম মুজিবের রেনু থেকে বঙ্গমাতা হয়ে উঠার গল্পটা ভীষণ অনুপ্রেরণাদায়ী। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের তাঁর বিখ্যাত নারী কবিতায় লিখেছিলেন, “পৃথিবীতে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।” বিদ্রোহী কবির পঙক্তি গুলো যে কী ভীষণ রকমে সত্য, তা আমরা বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের জীবনীর দিকে আলোকপাত করলেই বুঝতে পারি।

বাঙালীর স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রবাদ পুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বিশ্ব রাজনীতিতেও এক সময় মহীরুহ হয়ে উঠেন জাতির পিতা। কিন্তু, জেল-জুলুম-সংগ্রামমুখর জীবনের এই বন্ধুর পথ তিনি পাড়ি দিতে পেরেছিলেন সহধর্মিণী ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের আকণ্ঠ সমর্থন এবং সাহচার্যে।

যখনই বঙ্গবন্ধু দেশের কাজে বেরিয়েছেন, একা হাতে সংসার ও সন্তানদের সকল দায়িত্ব সামলেছেন ফজিলাতুন্নেছা। স্বীয় ধৈর্য্য, ত্যাগ, মমত্ত্ববোধ এবং প্রজ্ঞা গুণে তিনি হয়ে উঠেছিলেন বঙ্গবন্ধুর ভরসার জায়গা। সামরিক জান্তার রোষানলে পড়ে বঙ্গবন্ধু যতবারই কারাবরণ করেছেন, সংসার সামলানোর পাশাপাশি দলীয় নেতাকর্মীদের দিকনির্দেশনা দেয়ার ভারও নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছেন তিনি। পাহাড়ের মতো অবিচল থেকে সামলেছেন প্রতিটি দায়িত্ব।

বঙ্গবন্ধু প্রায়শই নিজ করণীয় নির্ধারণে সহধর্মীণীর সঙ্গে পরামর্শ করতেন, যার সবচেয়ে বড় প্রমাণ ঐতিহাসিক ০৭-ই মার্চের ভাষণ। সেদিন ভাষণের পূর্বে বঙ্গমাতা স্বামীকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, “তুমি তোমার সারাটা জীবন এদেশের মানুষের জন্য লড়াই করেছ। ভাষণে কি বলতে হবে, সেটা তুমিই সবচেয়ে ভাল জানো। তুমি তোমার হৃদয়ের কথা শুনো।” বঙ্গবন্ধুর ঠিক তা-ই করেছিলেন। সেদিন আঠারো মিনিটের অলিখিত বক্তব্যে পৃথিবীর ইতিহাসে এক নতুন মানচিত্রের ভিত্তি স্থাপন করেন তিনি।

এছাড়াও, ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৫৪’র নির্বাচন, ৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৬-র ছয় দফা আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ৬৯’ এর গণ-অভ্যুত্থান, ৭০’র নির্বাচন ও আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধসহ দেশের যেকোনো গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব সবসময় বঙ্গবন্ধুকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিয়েছেন। নিজ স্বামীর জীবন শঙ্কা ও অনিশ্চয়তায় ভরপুর থাকা সত্ত্বেও দেশ ও জাতির স্বার্থে সবসময়ই সাহসের পরিচয় দিয়েছেন তিনি। এজন্যেই গোটা জাতি ভালোবেসে শ্রদ্ধাবনত চিত্তে তাঁর নাম দিয়েছে বঙ্গমাতা। টুঙ্গিপাড়ার ছোট্ট রেনু হয়েছেন বাঙালী জাতির বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব।

মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গমাতার অবদান নিয়ে যতো বলা হবে, ততই যেনো কম! যে উপমাতেই বিশেষায়িত করা হোক না কেনো, শব্দভাণ্ডার ফুরিয়ে যাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট রচনা হয় পাকিস্তান আমলের দীর্ঘ ২৪ বছরের শাসনামলে। দীর্ঘ এই পথপরিক্রমায় জাতির অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করেন বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর সবচেয়ে ভরসার পাত্র হয়ে গোটা আন্দোলন-সংগ্রামে সাহস জোগান বঙ্গমাতা।

মুক্তি সংগ্রামের শুরু থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত বঙ্গমাতা যদি একটুও আপোষ করতেন, তাহলে বাংলাদেশের ইতিহাস অন্যরকম হতে পারতো। ২৫শে মার্চের কালরাত্রিতে হানাদার বাহিনী যখন বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়, তখনও তাঁর পাশেই ছিলেন শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব।

পাকবাহিনী কর্তৃক বঙ্গবন্ধুকে বন্দী করে করাচী নিয়ে যাবার পর পরিবারের সবাইকে নিয়ে ধানমন্ডির ঐতিহাসিক ৩২ নং বাড়ী ত্যাগ করেন বঙ্গমাতা। কিন্তু, মগবাজারের নিকটস্থ একটি ফ্ল্যাট থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়মিত পরামর্শ ও নির্দেশনা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অনবদ্য ভূমিকা রাখছিলেন বঙ্গমাতা। পরবর্তীতে এরই জেরে ১২ মে, ১৯৭১ এ- পুত্র-কন্যা সহ পরিবারের সকলের সঙ্গে তাঁকে বন্দী করে পাকবাহিনী এবং ধানমন্ডির ৯এ সড়কের (পুরনো ১৮) ২৬ নং বাড়িতে ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত বন্দী করে রাখা হয় তাঁদেরকে।

যুদ্ধ শেষে দেশ গঠনে বঙ্গমাতার অবদান কিংবদন্তীগাঁথা। বলা হয়ে থাকে, স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা কঠিন। তাই স্বাধীনতা রক্ষার্থে ও জাতির বিনির্মাণে স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করেন বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। বিশেষ করে, গোটা দেশজুড়ে নির্যাতিত মা-বোনদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন তিনি এবং সামাজিকভাবে তাদের প্রতিষ্ঠিত করার উদ্যোগ নেন। একই কাজে নিজ সন্তানদেরও বিলিয়ে দেন তিনি। তাই বলাই বাহুল্য, দেশ গঠনে বঙ্গমাতার অবদান যেমন অনবদ্য, দেশপ্রেমে তিনি চির ভাস্বর, সদা অম্লান।

বঙ্গমাতার জীবন থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা-ও দেশের প্রত্যেক নারী ও পুরুষের জন্য অনুকরণীয়। শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব এক সংগ্রামী, আদর্শিক ও মহীয়সী নারীর প্রতিভূ। তিনি অসাধারণ মেধা, অসীম সাহস, দৃঢ় মনোবল, সর্বংসহা ও দূরদৃষ্টি সম্পন্ন ছিলেন। প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও তিনি কখনো মনোবল হারাতেন না। তাঁর এই গুণগুলোই তাঁকে করেছে অনন্য। তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর মানসিক অস্ত্র। তাঁর জীবন থেকে কেবল বাংলা নয়, গোটা বিশ্বের নারী জাতির শিক্ষণীয় উপাদান রয়েছে প্রচুর।

কিন্তু সব সূর্যেরই অস্ত থাকে। স্বাধীনতা বিরোধী চক্র যখন কোনোভাবেই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ উত্থান থামানোর উপায় খুঁজে পাচ্ছিলো না, তখন ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় তাঁরা। স্বাধীনতা ও দেশবিরোধী অপশক্তি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাতে জাতির পিতার সঙ্গে বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকেও সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করে, যা জাতির ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে।

তবে দেশের প্রতি বঙ্গমাতার অকৃত্রিম ভালোবাসা ও ত্যাগকে মহামান্বিত করে রাখতে স্বাধীন বাংলাদেশের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক সরকার তাঁর নামে সারাদেশ জুড়ে বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং আবাসিক হল প্রতিষ্ঠা করেছে। এছাড়াও, শ্রদ্ধাভরে প্রতিবছর পালন করা হয় তাঁর জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী।

দেশ ও জাতিকে নিজ পরিবার তূল্য জ্ঞান করে সর্বদা নিজ মমতায় আগলে রেখেছেন বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। দিনের পর দিন কষ্ট সহ্য করেছেন জাতির মঙ্গলের আশায়। তাঁর জীবনী প্রতিটি বাঙালী নারীর উজ্জীবনী শক্তি। নারী জাগরনের অগ্রপথিক তিনি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদান যতটা দৃশ্যমান, তারচেয়ে অনেক বেশি মনস্তাত্ত্বিক। পর্দার আড়ালে থেকেও একটি জাতিকে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌছে দেয়ার কঠিনতম কাজটি করেছেন তিনি।

ক্ষণজন্মা এই নারী কখনোই নিজ স্বার্থ বিবেচনায় নেননি। তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণের দায়িত্ব এখন আমাদের তরুণ প্রজন্মের কাঁধে। তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল রাষ্ট্র বাংলাদেশকে উন্নত বিশ্বের সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তোলার গুরুদায়িত্ব আমাদেরকেই নিতে হবে। তাই আমাদের সকলেরই উচিত মহিয়সী এই নারীর জীবনীকে পাথেয় করে ভবিষ্যতের পথে যাত্রা করা।

 

লেখক: সাদিয়া রহমান, শিক্ষার্থী, এগ্রিকালচার, সেশন: ২০১৭-১৮, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল, নোবিপ্রবি