ড. সম্পা কুন্ডু: সিঙ্গাপুরের প্রেসিডেন্ট থারমান শানমুগারাত্নমের ২০২৫ সালের ১৪ থেকে ১৮ জানুয়ারি প্রথম ভারত সফর শুধুই ৬০ বছরের কূটনৈতিক সম্পর্ক উদযাপনের আনুষ্ঠানিক উপলক্ষ নয়। এটি ভারত ও সিঙ্গাপুরের শক্তিশালী ও ক্রমবর্ধমান অংশীদারিত্বের প্রমাণ। এই সম্পর্ক সবসময় প্রাকৃতিক বন্ধুত্ব, পারস্পরিক বিশ্বাস এবং অভিন্ন মূল্যবোধের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে, যা দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার একটি মডেল হিসেবে অন্য দেশগুলোর জন্য অনুকরণীয়।
ভারত-সিঙ্গাপুর সম্পর্ক শুধু কৌশলগত নয়, বরং ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দ্বীপ রাষ্ট্র সফরের সময় ভারত ও সিঙ্গাপুর তাদের সম্পর্ককে একটি “ক্যাম্প্রিহেনসিভ স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ”-এ উন্নীত করে।
প্রেসিডেন্ট থারমান এবং ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু একটি স্মারক লোগো উন্মোচন করেন, যেখানে ভারতের জাতীয় ফুল পদ্ম এবং সিঙ্গাপুরের জাতীয় ফুল অর্কিডের সংমিশ্রণ ব্যবহার করা হয়েছে। এই প্রতীকী অঙ্গভঙ্গি শুধু ঐতিহ্যের অংশীদারিত্বকেই নয়, অভিন্ন আকাঙ্ক্ষাও প্রতিফলিত করে। এটি উভয় দেশের মধ্যে বৃহত্তর সহযোগিতার প্রেরণা জোগায়।
ভারতের “অ্যাক্ট ইস্ট পলিসি” সিঙ্গাপুরের কৌশলগত গুরুত্বকে আঞ্চলিক প্রবেশদ্বার এবং আসিয়ান কাঠামোর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা বিবেচনা করলে, সিঙ্গাপুরের অবস্থান ভারতের কূটনৈতিক কৌশলের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি।
অনেকেই মনে করেন, ভারত-সিঙ্গাপুর সম্পর্ক মূলত বাণিজ্য ও বিনিয়োগের উপর নির্ভরশীল। তবে এটি এই অংশীদারিত্বের বহুমুখী প্রকৃতি উপেক্ষা করে। উন্নত শিল্প উৎপাদন, ডিজিটালাইজেশন, স্বাস্থ্যসেবা, টেকসই উন্নয়ন এবং শিক্ষা সহ বহু ক্ষেত্রে সহযোগিতা করেছে উভয় দেশ। মিনিস্ট্রিয়াল রাউন্ডটেবিল মেকানিজম প্রতিষ্ঠা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে প্রাতিষ্ঠানিক সংলাপ চালিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি প্রকাশ করে।
উন্নয়ন ও সহযোগিতায় দৃঢ় প্রতিশ্রুতি
সাম্প্রতিক সফরে প্রেসিডেন্ট থারমান শানমুগারাত্নম উদীয়মান খাতগুলোতে সহযোগিতা আরও গভীর করার এবং বিদ্যমান সম্পর্ক প্রসারিত করার প্রতি সিঙ্গাপুরের আকাঙ্ক্ষা তুলে ধরেছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন, এই অংশীদারিত্ব একটি নতুন দিগন্তে পৌঁছানোর সম্ভাবনা রাখে। লজিস্টিকস, সংযোগ, পেট্রোকেমিক্যালস এবং এয়ারস্পেস খাত নিয়ে আলোচনা করে তিনি সিঙ্গাপুরের আকাঙ্ক্ষার সাথে ভারতের শিল্প উন্নয়ন ও প্রযুক্তিগত নেতৃত্ব অর্জনের লক্ষ্যের সাদৃশ্য তুলে ধরেছেন। আধুনিক বিশ্ব অর্থনীতির দ্রুত পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে এই অভিন্ন স্বার্থ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেমিকন্ডাক্টর ইকোসিস্টেম গড়ে তুলতে সিঙ্গাপুরের ভারতের পাশে দাঁড়ানোর লক্ষ্য এই সম্পর্কের গভীর অর্থনৈতিক আন্তঃনির্ভরতার একটি সুস্পষ্ট উদাহরণ।
টেকসই উন্নয়ন এই অংশীদারিত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। নেট-জিরো শিল্প পার্ক এবং একটি সম্ভাব্য নবায়নযোগ্য শক্তি করিডোর গড়ে তোলার বিষয়ে প্রেসিডেন্ট শানমুগারাত্নমের উক্তি একটি দূরদর্শী উদ্যোগের পরিচায়ক, যা বৈশ্বিক জলবায়ু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় অপরিহার্য। এটি দায়িত্বশীল উন্নয়নের প্রতি একটি অভিন্ন প্রতিশ্রুতি প্রদর্শন করে, যা ভবিষ্যতের সকল সহযোগিতার মূল চালিকাশক্তি হওয়া উচিত।
দক্ষতা উন্নয়নের ক্ষেত্রে, ভারতের বহুমুখী কর্মীবাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য সিঙ্গাপুরের চলমান প্রতিশ্রুতি উল্লেখযোগ্য। শিক্ষা যেকোনো সফল অর্থনীতির ভিত্তি। ভারতীয় কর্মীদের প্রশিক্ষণ অব্যাহত রেখে সিঙ্গাপুর শুধু মানবসম্পদে বিনিয়োগ করছে না, বরং দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বে ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক সহযোগিতার ভিত্তি মজবুত করছে। এ ধরনের বিনিয়োগ একটি দূরদর্শী দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করে, যা উভয় দেশের অর্থনীতির জন্য কেন্দ্রীয়।
ডিজিটালাইজেশনের যুগে ভারতের রূপান্তরকে প্রেসিডেন্ট শানমুগারাত্নম প্রশংসা করেছেন এবং উল্লেখ করেছেন যে ভারতের ‘সমষ্টিগত দক্ষতা ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা’ বিশ্বমঞ্চে ভারতের অবস্থানকে শক্তিশালী করেছে। রাষ্ট্রপতি ভবনে প্রেসিডেন্ট শানমুগারাত্নমের ভাষণে ভারত ও সিঙ্গাপুরের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের সমৃদ্ধি প্রতিফলিত হয়েছে।
প্রেসিডেন্টের ওড়িশা সফর তার সফরসূচির একটি অংশ হিসেবে এই সম্পর্ককে আরও গভীরতা ও তাৎপর্য দিয়েছে। এটি ভারতের পূর্বে উপেক্ষিত রাজ্যগুলো, যেমন ওড়িশা ও আসামের দিকে সিঙ্গাপুরের কৌশলগত মনোযোগের প্রতিফলন ঘটিয়েছে। এটি উপমহাদেশের অপ্রাপ্ত সম্ভাবনাগুলো কাজে লাগানোর একটি বৃহত্তর লক্ষ্যকে তুলে ধরে। এই রাজ্যগুলোতে সহযোগিতার মাধ্যমে সিঙ্গাপুর কেবল অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব নয়, বরং একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন কাঠামোর কল্পনা করছে, যা ভারতের সকল অঞ্চলে সমন্বিত প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করবে।
সিঙ্গাপুরের প্রেসিডেন্ট এবং ফার্স্ট লেডি ওড়িশার কোনার্কের সূর্য মন্দির এবং রঘুরাজপুর শিল্পীদের গ্রাম পরিদর্শন করেছেন এবং ভারত ও সিঙ্গাপুরের অভিন্ন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের কথা স্মরণ করেছেন। সিঙ্গাপুর নামটি দুটি সংস্কৃত শব্দ সিংহ (সিংহ) এবং পুরা (নগরী) থেকে উদ্ভূত, যা ভারত ও সিঙ্গাপুরের গভীর সাংস্কৃতিক ও সভ্যতার বন্ধনের পরিচায়ক।
‘অভিন্ন স্বার্থ ও মূল্যবোধে স্বাভাবিক অংশীদারিত্ব’
এই সফর প্রদর্শন করে যে সিঙ্গাপুরও প্রধানমন্ত্রী মোদির ‘পূর্বোদয়’ দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ, যা আমাদের দেশের পূর্বাঞ্চলকে উন্নয়নের লক্ষ্য নিয়ে পরিচালিত। ওড়িশা সফরকালে সিঙ্গাপুরের প্রেসিডেন্ট একাধিক সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছেন।
এগুলো সবুজ জ্বালানি, শিল্প পার্ক, পেট্রোকেমিক্যাল কমপ্লেক্স এবং বিশেষত সেমিকন্ডাক্টর খাতে দক্ষতা উন্নয়ন এবং অন্যান্য দক্ষতা উন্নয়নের ক্ষেত্রে সহায়তা জোরদার করার উদ্দেশ্যে সম্পন্ন হয়েছে। বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলার জন্য অপরিহার্য খাতগুলোতে এই কৌশলগত মনোযোগ তাদের দূরদর্শিতা এবং আসন্ন বৈশ্বিক প্রযুক্তিগত প্রবণতাগুলোর প্রতি সচেতনতার সাক্ষ্য বহন করে। সমালোচকরা প্রায়ই বলেন যে এমন লক্ষ্যযুক্ত সহযোগিতাগুলো অসম ফলাফল নিয়ে আসে, কিন্তু বাস্তবতা হলো, এগুলো পারস্পরিক প্রবৃদ্ধির পথ তৈরি করে, যা উভয় দেশকে বৈশ্বিক মূল্য শৃঙ্খলে সুবিধাজনক অবস্থানে পৌঁছে দেয়।
ভারত এবং সিঙ্গাপুরের অংশীদারিত্বের ভিত্তি অভিন্ন ইতিহাসে নিহিত, তা উল্লেখ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৬৫ সালে সিঙ্গাপুরের স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেওয়া প্রথম দেশগুলোর মধ্যে ভারত অন্যতম। এই দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্ক এখন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক বিভিন্ন মাত্রায় বিকশিত হয়েছে। ভারত-সিঙ্গাপুর দ্বিপাক্ষিক অংশীদারিত্বের ঐতিহাসিক ভিত্তি তাদের আধুনিক কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মেরুদণ্ড। প্রেসিডেন্ট শানমুগারাত্নম যথার্থই এই অংশীদারিত্বকে ‘স্বাভাবিক’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন, যা অভিন্ন স্বার্থ এবং মূল্যবোধ থেকে উদ্ভূত। এই বক্তব্য এই দীর্ঘস্থায়ী সহযোগিতার মূল ভিত্তি তুলে ধরে।
সংক্ষেপে, প্রেসিডেন্ট থারমান শানমুগারাত্নমের সাম্প্রতিক ভারত সফর কেবলমাত্র একটি স্মরণীয় অনুষ্ঠান নয়, বরং উভয় দেশের জন্য বিভিন্ন অভিন্ন স্বার্থের ক্ষেত্রে তাদের সম্পৃক্ততা গভীর করার আহ্বান। বিস্তৃত কৌশলগত অংশীদারিত্ব বৃহত্তর সংযোগ, উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করা এবং উভয় দেশের জনগণের সামাজিক-অর্থনৈতিক অবস্থা উন্নত করার একটি অনন্য সুযোগ উপস্থাপন করে। বিশ্ব পরিস্থিতি দ্রুত পরিবর্তনের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে, এটা স্পষ্ট যে ভারত-সিঙ্গাপুর সম্পর্ক আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধির জন্য একটি কৌশলগত প্রয়োজন। উভয় দেশকে এই মুহূর্তটি কাজে লাগিয়ে তাদের অংশীদারিত্বকে আরও শক্তিশালী করতে হবে, যাতে পরবর্তী দশক এই ষাট বছরের সহযোগিতার স্থিতিশীল ঐতিহ্যের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। ফলে বলা যায়, ভারত-সিঙ্গাপুর দ্বিপাক্ষিক অংশীদারিত্ব একটি রূপান্তরমূলক ভবিষ্যতের দিকে পরিচালিত, যা অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে।
লেখক: পরামর্শক, আসিয়ান-ইন্ডিয়া সেন্টার, রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম ফর ডেভেলপিং কান্ট্রিজ, নয়াদিল্লি; এখানে প্রকাশিত মতামত সম্পূর্ণ তাঁর নিজস্ব। সূত্র: ইন্ডিয়া নিউজ নেটওয়ার্ক