০৪:১৬ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

জয়শঙ্করের শ্রীলঙ্কা সফরে সম্পর্কে নতুন মাত্রা যোগ হবে?

শ্রীপতি নারায়ণন: গত কয়েক মাসে উচ্চ পর্যায়ে বেশ কয়েকটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে ভারত ও শ্রীলঙ্কার মাঝে। এর মাঝে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য গত ডিসেম্বরে লঙ্কান অর্থমন্ত্রী বাসিল রাজাপাকসে এবং চলতি ফেব্রুয়ারিতে লঙ্কান পররাষ্ট্রমন্ত্রী জিএল পেইরিসের ভারত সফর। দ্বীপদেশটি বর্তমানে যে অর্থনৈতিক দূরাবস্থার মুখোমুখি হয়েছে, তার প্রেক্ষিতে সঙ্কীর্ণ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে দু দেশের মধ্যকার এই ঘন ঘন যোগাযোগকে সন্দেহজনক বলে মনে হতে পারে অনেকের! কিন্তু, আরেকটু গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলেই দেখা যাবে যে, ভারতীয় কর্তাদের এই হাঁকডাক শুধুমাত্র লঙ্কাকে বশীকরণ করা নয়, বরং প্রতিবেশী হিসেবে সহানুভূতি এবং দীর্ঘমেয়াদে সম্পর্ক স্বাভাবাবিকীকরণে ব্যাপক কাজে আসবে।

ভারত ও শ্রীলঙ্কার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বরাবরই মুখরোচক গল্পের সৃষ্টি করে। দু দেশের পারস্পরিক এই সম্পর্ক সময়ের ব্যবধানে বহু নীরব বিবর্তনের স্বাক্ষী হয়েছে। কিন্তু, গত দু বছরে, বিশেষ করে মহামারী পরবর্তী সময়ে এবং লঙ্কান অর্থনীতির বেহাল দশায় ভারত যেভাবে দেশটির পাশে দাঁড়িয়েছে, সেটি এক নতুন যুগের সূচনা বললেও ভুল হবে না! এমনই প্রেক্ষাপটে, বিমসটেক মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে যোগ দিতে লঙ্কান দেশটিতে ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর তিনদিনের সফর দু দেশের মধ্যকার অনেক কিছুর সংযোগ সেতু হিসেবে কাজ করবে বলে ধারণা করি।

দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মধ্যকার সুসম্পর্ক বরাবরই কোনো না কোনো বড় ইস্যুতে ঢাকা পড়ে গিয়েছে। কিংবা, এমন কোন ইস্যুর তৈরী হয়েছে, যা দু দেশের মধ্যে এক বিভেদের দেয়াল তুলে দিয়েছে! তামিল জাতিগত প্রশ্ন, জেলেদের বিরোধ এবং ‘চীন’ ফ্যাক্টর সেসবেরই উদাহরণ মাত্র! কিন্তু, জয়শঙ্করের এবারের সফরে সেসব বিভেদ ভুলিয়ে দেয়ার সর্বোচ্চ প্রয়াস করা হচ্ছে। ভারতীয় মিডিয়াতে ফলাও করে লঙ্কাকে দেয়া অর্থনৈতিক সহায়তাকে বন্ধুর প্রতি বন্ধুর অবস্থান হিসেবে দেখানো হচ্ছে। জাফনা সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের ভার্চুয়াল উদ্বোধন, মেরিটাইম রেসকিউ কোঅর্ডিনেশন সেন্টারে একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) এবং উত্তর জাফনা উপদ্বীপের কাছে তিনটি দ্বীপে হাইব্রিড-বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিষয়ে চুক্তি এসবেরই উদাহরণ।

এছাড়া, লঙ্কান রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে জয়শঙ্করের এবারের দ্বিপাক্ষিক বৈঠকগুলো সম্পর্কে নতুন কিছুর লক্ষণ প্রকাশ করেছে। প্রায় প্রতিটি বৈঠকে অর্থনৈতিক ইস্যুতে আলোচনা করেন নেতৃবৃন্দ। কিন্তু, তারপরও সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হয়ে থাকবে এসব আলোচনায় জাতিগত বিভেদ থেকে শুরু করে অন্য সকল বিবাদমান ইস্যু মিটিয়ে ফেলার উদ্যোগ নেয়া।

বিশেষ করে, রাষ্ট্রপতি গোটাবায়া যখন জয়শঙ্করকে তামিল ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স এর সাথে নিজের আলোচনার বিষয়বস্তু শেয়ার করেছেন, তখন বুঝতে হবে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের গভীরতা নতুন এক পর্যায়ে পৌছে গিয়েছে! পরবর্তীতে জয়শঙ্কর লঙ্কান সাংসদ আর সাম্পানথানের নেতৃত্বে তামিল ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স এর প্রতিনিধিদের সাথে একটি নির্ধারিত বৈঠকেও অংশ নেন।

বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় মিডিয়াতেও ব্যাপক বলাবলি হয়েছে। জয়শঙ্করের মধ্যস্থতায় হয়তো এই প্রথমবারের মত একই সুরে কথা বলতে দেখা গিয়েছে লঙ্কান সরকার এবং তামিল বিদ্রোহীদের। গোটা ব্যাপারটিতে কৃতিত্ব না নিয়ে বরং জনগণের ভালোর জন্য কাজ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন জয়শঙ্কর। তাঁর এই সরলতাই রাজনৈতিক সমাধান সহ নির্দিষ্ট অন্যান্য ইস্যুতে নতুন যুগের সূচনা আনতে পারবে বলে মনে হয়েছে।

এই সফর চলাকালেই, শ্রীলঙ্কার মৎস্য ও জলজ সম্পদ মন্ত্রী ডগলাস দেবানন্দের সাথেও দেখা করেছেন জয়শঙ্কর। লঙ্কান এই মন্ত্রী নিজেও একজন তামিল বংশোদ্ভূত। তাঁর সাথে মৎস্য সম্পদ আহরণ নিয়ে দু দেশের জেলেদের মধ্যকার সমস্যা নিয়েও কথা বলেছেন জয়শঙ্কর। পাশাপাশি ভার্চুয়াল মোডে অনুষ্ঠিত পঞ্চম অফিসিয়াল-লেভেল জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ (জেডব্লিউজি) বৈঠকের ফলাফল নিয়ে আলোচনা করেছেন। দু দেশের মৎস্যজীবীদের মঙ্গল, সুরক্ষা এবং নিরাপত্তা ইস্যুতে এসব বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ যা বলার অপেক্ষা রাখে না!

তাছাড়া, জয়শঙ্করের এই সফরেই শ্রীলঙ্কায় মৎস্য পোতাশ্রয়ের উন্নয়নের বিষয়ে একটি সমঝোতা স্মারকও স্বাক্ষরিত হয়েছে। স্মরণ করা যেতে পারে, ২০০৯ সালের মে মাসে লঙ্কান জাতিগত যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশটির সাধারণ মানুষের মাছ ধরার উন্নয়নের জন্য প্রকল্প তহবিল গঠন করেছিলো ভারত।

মৎস্য সংক্রান্ত এসব ইস্যু বা ঘটনা বিচ্ছিন্নভাবে না দেখে বরং সহযোগিতার নতুন এক প্রাপ্তি হিসেবে দেখলেও ভুল হবেনা। দু পক্ষই ভারত মহাসাগরে এঁকে অপরের প্রাপ্য দেয়ার চেষ্টা করছে। বিষয়টি দেখা যতটা মনের জন্য শান্তির, ততোটাই চোখের জন্যেও!

এছাড়াও, দক্ষতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও চুক্তিবদ্ধ হয়েছে দু দেশ। নিয়মিত দু দেশের সামরিক বাহিনীগুলো মহড়ায় অংশ নিচ্ছে। এসব ঘনিষ্ঠতা একদিকে যেমন দুই প্রতিবেশীর জন্য সম্পর্ক বৃদ্ধির চাবিকাঠি, অন্যদিকে, বাইরের অপশক্তির প্রতি এক ধরণের সতর্কবার্তাও। সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা পরম্পরায় আমরা দেখেছি, নিরাপত্তা উপদেষ্টা পর্যায়েও নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে শ্রীলঙ্কা এবং ভারত। সহযোগিতার বিভিন্ন স্তম্ভ, যথা, সামুদ্রিক নিরাপত্তা ও সুরক্ষা, কাউন্টার-টেরোরিজম অ্যান্ড রেডিক্যালাইজেশন, কমবেটিং ট্রাফিকিং অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল অর্গানাইজড ক্রাইম, সাইবার সিকিউরিটি, প্রটেকশন অফ ক্রিটিক্যাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার অ্যান্ড টেকনোলজি, মানবিক সহায়তা এবং দুর্যোগ ত্রাণ -সবদিকেই ঘনিষ্ঠতা বাড়ছে লঙ্কা এবং ভারতের মধ্যে।

এবারের বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনেও ভারতের প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কোন্নয়নের যে বার্তা দিয়েছেন, তা কার্যত লঙ্কার সাথে ভারতের ঘনিষ্ঠতা বাঁড়াতে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে। ভারতের গ্রহণ করা প্রতিবেশী প্রথম নীতিতেও শ্রীলঙ্কাকে ব্যাপক অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে।

সম্পর্কের এই ধাপে এসে অনুমান করা যেতে পারে, শ্রীলঙ্কাও সম্পর্কের পুনর্নিমাণকে প্রথম অগ্রাধিকার হিসেবে নিয়েছে। শুধুমাত্র ভারতের কৃতিত্ব দিলে বিষয়টি অন্যায় হবে। এক্ষেত্রে লঙ্কান কর্তৃপক্ষও নিজেদের শেষ সম্বল হিসেবে ভারতের আশ্রয়ই চাইছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে প্রতিটি ধাপেই।

আমরা সকলেই জানি, লঙ্কান অর্থনীতির দুরাবস্থার মধ্যে দেশটির রাষ্ট্রপতির অনুরোধে কোন ফায়দার আশা না করেই ভারত দেশটিকে ব্যাপক অর্থনৈতিক সহায়তার জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়। ভারতের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে এই বিনিয়োগে আশু কোনো লাভ রয়েছে বলে মনে হয়না! এমনকি লঙ্কার ঐতিহ্যগত মিত্র চীনও দেশটিকে লোন দিতে অস্বীকৃতি জানায়। এমতাবস্থায়, ভারত অনেকটা বিপদে পড়া ছোটভাইকে বাচানোর জন্য বড় ভাইয়ের মতো পদক্ষেপ নিয়েছে। এতে হয়তো অনেকেই ভাববেন যে শ্রীলংকা থেকে চীনের প্রভাব দূর হয়ে যাবে, সেজন্য ভারত এমন পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু আদতে বিষয়টি মোটেও এমন নয়। কেননা, চাইলেই লঙ্কায় চীনের প্রভাব বলয় দূর করা যাবেনা। দেশটিতে এখনও চীনের ব্যাপক অঙ্কের অর্থ বিনিয়োগ রয়েছে।

তাই ভারত যেসব চুক্তি করেছে শ্রীলঙ্কার সাথে, কিংবা সম্পর্কোন্নয়নে যেসব ভূমিকা নিয়েছে, সেটি আদতে অদূর ভবিষ্যতে দু দেশের মধ্যকার সম্পর্ক বাড়ানোর প্রচেষ্টা বৈ অন্য কিছুই নয়, কিংবা ঐতিহাসিকভাবে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকা প্রতিবেশীর সাথে সম্পর্কোন্নয়নের চেষ্টা, সেটা বুঝতে বিশারদ হতে হয়না।

স্মরণ করা যেতে পারে, জাফনায় হাইব্রিড বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলো মূলত চীনকে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু, ভারতের উপকূল থেকে খুব বেশি দূরে নয় এমন সংবেদনশীল পাল্ক বে অঞ্চলে এই ধরনের একটি উদ্যোগের বিষয়ে দিল্লি তার রিজার্ভেশন প্রকাশ করার পরে, কলম্বো এখন এটিতে ভারতীয় সহযোগিতা চেয়েছে। ভারতের বেসরকারী খাত আদানি গ্রুপ এই প্রকল্পের দায়িত্ব পেয়েছে। সম্ভবত, ইতিহাসে প্রথমবারের এভাবে চীনা প্রভাব সরিয়ে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পেরেছে শ্রীলঙ্কা। উল্লেখ্য, আদানিরা এর আগে কলম্বো বন্দরের ওয়েস্টার্ন কন্টেইনার টার্মিনাল (ডব্লিউসিটি) এর যৌথ উন্নয়নের অংশীজন ছিল।

গত কয়েক মাস ধরে, ভারতীয় পাবলিক সেক্টরের সংস্থাগুলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভিনটেজের তেল ট্যাঙ্ক খামারগুলোর পুনর্নবীকরণের জন্য যৌথ সেক্টর চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে, যাতে বহু মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ জড়িত। দুটি সরকারী সংস্থা যৌথভাবে একটি সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পও স্থাপন করছে সামপুরে। সামপুরকে মূলত ভারতের পাবলিক সেক্টর এনটিপিসি-এর জন্য এক দশক বা তারও বেশি আগে একটি কয়লা-চালিত বিদ্যুৎ-প্রকল্প স্থাপনের জন্য নির্বাচিত করা হয়েছিল এবং তেল-চালিত ইউনিট হিসাবে পুনর্নির্মাণ করা হয়েছিল। এখন, এনটিপিসি সৌর প্রকল্পের জন্য এটি নির্বাচিত করা হয়েছে।

দু পক্ষই নিজেদের মধ্যে সম্প্রতি প্রতিরক্ষা চুক্তিও সম্পাদন করেছে। যদিও এর আদ্যোপান্ত এখনও বিস্তারিত প্রকাশ করা হয়নি, তবে এখনই বুঝা যাচ্ছে যে অহিতকর কোনো কিছুই শ্রীলংকার জন্য বরাদ্দ করেনি ভারত। এ নিয়ে শ্রীলংকার প্রতিপক্ষ বিরোধী দলগুলো দেশজুড়ে একটি ঝামেলা সৃষ্টি করতে চাইলেও সরকারীভাবে গত ২৯ মার্চ এক বিবৃতি দিয়ে বিষয়টি মীমাংসা করেছে দেশটির সরকার।

আইওআর, বিমসটেক কিংবা অন্যান্য সকল বহুপাক্ষিক ফোরাম, যেখানে ভারত ও শ্রীলঙ্কা এঁকে অন্যের সাথে সম্পৃক্ত, প্রতিটি ক্ষেত্রেই ঘনিষ্ঠ হচ্ছে দু পক্ষ। ভারত একদিকে যেমন ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের কেন্দ্রীয়তার উপর জোর দিচ্ছে, একইভাবে, শ্রীলংকাও ভারতের নেতৃত্বে বিশ্বমঞ্চে নতুনভাবে নিজেদের প্রকাশ করছে। সাম্প্রতিক বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলন আয়োজনের মধ্য দিয়ে আদতে সে বার্তাই পাওয়া গিয়েছে।

লঙ্কান অর্থনীতির উপর ভারতীয় প্রভাব বেশ পুরনো হলেও সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহে বিষয়টি বেশ চোখে পড়ার মতোই! তবে সব সন্দেহবাতিক দূর করে দুই প্রতিবেশীর এমন অভূতপূর্ব মেলবন্ধনকে মান্যতা দেয়াতেই বিশ্ব মানবতার জয় নিহিত। গোটা বিশ্বজুড়েই সবাই যদি এঁকে অপরের বিপদে এগিয়ে আসতো এভাবে, তাহলে আজকের বিশ্ব ইউক্রেন-রাশিয়া সঙ্কট দেখতো না। তাই ভারত-শ্রীলঙ্কা সাম্প্রতিক সম্পর্ককে সাধুবাদ না জানিয়ে উপায় নেই। একইভাবে জয়শঙ্করের সাম্প্রতিক সফরে যেনো নতুন এক মাত্রা পেলো দু প্রতিবেশীর সম্পর্ক!

লেখকঃ শ্রীপতি নারায়ণন, পিএইচডি, ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর ওয়ার্ল্ড অ্যাফেয়ার (আইসিডব্লিউএ), নয়াদিল্লির একজন রিসার্চ ফেলো। (প্রকাশিত লেখনী সম্পূর্ণ তাঁর নিজস্ব অভিমত)

ট্যাগ:

জয়শঙ্করের শ্রীলঙ্কা সফরে সম্পর্কে নতুন মাত্রা যোগ হবে?

প্রকাশ: ০৭:২৫:৩৬ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৩০ মার্চ ২০২২

শ্রীপতি নারায়ণন: গত কয়েক মাসে উচ্চ পর্যায়ে বেশ কয়েকটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে ভারত ও শ্রীলঙ্কার মাঝে। এর মাঝে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য গত ডিসেম্বরে লঙ্কান অর্থমন্ত্রী বাসিল রাজাপাকসে এবং চলতি ফেব্রুয়ারিতে লঙ্কান পররাষ্ট্রমন্ত্রী জিএল পেইরিসের ভারত সফর। দ্বীপদেশটি বর্তমানে যে অর্থনৈতিক দূরাবস্থার মুখোমুখি হয়েছে, তার প্রেক্ষিতে সঙ্কীর্ণ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে দু দেশের মধ্যকার এই ঘন ঘন যোগাযোগকে সন্দেহজনক বলে মনে হতে পারে অনেকের! কিন্তু, আরেকটু গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলেই দেখা যাবে যে, ভারতীয় কর্তাদের এই হাঁকডাক শুধুমাত্র লঙ্কাকে বশীকরণ করা নয়, বরং প্রতিবেশী হিসেবে সহানুভূতি এবং দীর্ঘমেয়াদে সম্পর্ক স্বাভাবাবিকীকরণে ব্যাপক কাজে আসবে।

ভারত ও শ্রীলঙ্কার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বরাবরই মুখরোচক গল্পের সৃষ্টি করে। দু দেশের পারস্পরিক এই সম্পর্ক সময়ের ব্যবধানে বহু নীরব বিবর্তনের স্বাক্ষী হয়েছে। কিন্তু, গত দু বছরে, বিশেষ করে মহামারী পরবর্তী সময়ে এবং লঙ্কান অর্থনীতির বেহাল দশায় ভারত যেভাবে দেশটির পাশে দাঁড়িয়েছে, সেটি এক নতুন যুগের সূচনা বললেও ভুল হবে না! এমনই প্রেক্ষাপটে, বিমসটেক মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে যোগ দিতে লঙ্কান দেশটিতে ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর তিনদিনের সফর দু দেশের মধ্যকার অনেক কিছুর সংযোগ সেতু হিসেবে কাজ করবে বলে ধারণা করি।

দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মধ্যকার সুসম্পর্ক বরাবরই কোনো না কোনো বড় ইস্যুতে ঢাকা পড়ে গিয়েছে। কিংবা, এমন কোন ইস্যুর তৈরী হয়েছে, যা দু দেশের মধ্যে এক বিভেদের দেয়াল তুলে দিয়েছে! তামিল জাতিগত প্রশ্ন, জেলেদের বিরোধ এবং ‘চীন’ ফ্যাক্টর সেসবেরই উদাহরণ মাত্র! কিন্তু, জয়শঙ্করের এবারের সফরে সেসব বিভেদ ভুলিয়ে দেয়ার সর্বোচ্চ প্রয়াস করা হচ্ছে। ভারতীয় মিডিয়াতে ফলাও করে লঙ্কাকে দেয়া অর্থনৈতিক সহায়তাকে বন্ধুর প্রতি বন্ধুর অবস্থান হিসেবে দেখানো হচ্ছে। জাফনা সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের ভার্চুয়াল উদ্বোধন, মেরিটাইম রেসকিউ কোঅর্ডিনেশন সেন্টারে একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) এবং উত্তর জাফনা উপদ্বীপের কাছে তিনটি দ্বীপে হাইব্রিড-বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিষয়ে চুক্তি এসবেরই উদাহরণ।

এছাড়া, লঙ্কান রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে জয়শঙ্করের এবারের দ্বিপাক্ষিক বৈঠকগুলো সম্পর্কে নতুন কিছুর লক্ষণ প্রকাশ করেছে। প্রায় প্রতিটি বৈঠকে অর্থনৈতিক ইস্যুতে আলোচনা করেন নেতৃবৃন্দ। কিন্তু, তারপরও সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হয়ে থাকবে এসব আলোচনায় জাতিগত বিভেদ থেকে শুরু করে অন্য সকল বিবাদমান ইস্যু মিটিয়ে ফেলার উদ্যোগ নেয়া।

বিশেষ করে, রাষ্ট্রপতি গোটাবায়া যখন জয়শঙ্করকে তামিল ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স এর সাথে নিজের আলোচনার বিষয়বস্তু শেয়ার করেছেন, তখন বুঝতে হবে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের গভীরতা নতুন এক পর্যায়ে পৌছে গিয়েছে! পরবর্তীতে জয়শঙ্কর লঙ্কান সাংসদ আর সাম্পানথানের নেতৃত্বে তামিল ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স এর প্রতিনিধিদের সাথে একটি নির্ধারিত বৈঠকেও অংশ নেন।

বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় মিডিয়াতেও ব্যাপক বলাবলি হয়েছে। জয়শঙ্করের মধ্যস্থতায় হয়তো এই প্রথমবারের মত একই সুরে কথা বলতে দেখা গিয়েছে লঙ্কান সরকার এবং তামিল বিদ্রোহীদের। গোটা ব্যাপারটিতে কৃতিত্ব না নিয়ে বরং জনগণের ভালোর জন্য কাজ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন জয়শঙ্কর। তাঁর এই সরলতাই রাজনৈতিক সমাধান সহ নির্দিষ্ট অন্যান্য ইস্যুতে নতুন যুগের সূচনা আনতে পারবে বলে মনে হয়েছে।

এই সফর চলাকালেই, শ্রীলঙ্কার মৎস্য ও জলজ সম্পদ মন্ত্রী ডগলাস দেবানন্দের সাথেও দেখা করেছেন জয়শঙ্কর। লঙ্কান এই মন্ত্রী নিজেও একজন তামিল বংশোদ্ভূত। তাঁর সাথে মৎস্য সম্পদ আহরণ নিয়ে দু দেশের জেলেদের মধ্যকার সমস্যা নিয়েও কথা বলেছেন জয়শঙ্কর। পাশাপাশি ভার্চুয়াল মোডে অনুষ্ঠিত পঞ্চম অফিসিয়াল-লেভেল জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ (জেডব্লিউজি) বৈঠকের ফলাফল নিয়ে আলোচনা করেছেন। দু দেশের মৎস্যজীবীদের মঙ্গল, সুরক্ষা এবং নিরাপত্তা ইস্যুতে এসব বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ যা বলার অপেক্ষা রাখে না!

তাছাড়া, জয়শঙ্করের এই সফরেই শ্রীলঙ্কায় মৎস্য পোতাশ্রয়ের উন্নয়নের বিষয়ে একটি সমঝোতা স্মারকও স্বাক্ষরিত হয়েছে। স্মরণ করা যেতে পারে, ২০০৯ সালের মে মাসে লঙ্কান জাতিগত যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশটির সাধারণ মানুষের মাছ ধরার উন্নয়নের জন্য প্রকল্প তহবিল গঠন করেছিলো ভারত।

মৎস্য সংক্রান্ত এসব ইস্যু বা ঘটনা বিচ্ছিন্নভাবে না দেখে বরং সহযোগিতার নতুন এক প্রাপ্তি হিসেবে দেখলেও ভুল হবেনা। দু পক্ষই ভারত মহাসাগরে এঁকে অপরের প্রাপ্য দেয়ার চেষ্টা করছে। বিষয়টি দেখা যতটা মনের জন্য শান্তির, ততোটাই চোখের জন্যেও!

এছাড়াও, দক্ষতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও চুক্তিবদ্ধ হয়েছে দু দেশ। নিয়মিত দু দেশের সামরিক বাহিনীগুলো মহড়ায় অংশ নিচ্ছে। এসব ঘনিষ্ঠতা একদিকে যেমন দুই প্রতিবেশীর জন্য সম্পর্ক বৃদ্ধির চাবিকাঠি, অন্যদিকে, বাইরের অপশক্তির প্রতি এক ধরণের সতর্কবার্তাও। সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা পরম্পরায় আমরা দেখেছি, নিরাপত্তা উপদেষ্টা পর্যায়েও নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে শ্রীলঙ্কা এবং ভারত। সহযোগিতার বিভিন্ন স্তম্ভ, যথা, সামুদ্রিক নিরাপত্তা ও সুরক্ষা, কাউন্টার-টেরোরিজম অ্যান্ড রেডিক্যালাইজেশন, কমবেটিং ট্রাফিকিং অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল অর্গানাইজড ক্রাইম, সাইবার সিকিউরিটি, প্রটেকশন অফ ক্রিটিক্যাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার অ্যান্ড টেকনোলজি, মানবিক সহায়তা এবং দুর্যোগ ত্রাণ -সবদিকেই ঘনিষ্ঠতা বাড়ছে লঙ্কা এবং ভারতের মধ্যে।

এবারের বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনেও ভারতের প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কোন্নয়নের যে বার্তা দিয়েছেন, তা কার্যত লঙ্কার সাথে ভারতের ঘনিষ্ঠতা বাঁড়াতে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে। ভারতের গ্রহণ করা প্রতিবেশী প্রথম নীতিতেও শ্রীলঙ্কাকে ব্যাপক অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে।

সম্পর্কের এই ধাপে এসে অনুমান করা যেতে পারে, শ্রীলঙ্কাও সম্পর্কের পুনর্নিমাণকে প্রথম অগ্রাধিকার হিসেবে নিয়েছে। শুধুমাত্র ভারতের কৃতিত্ব দিলে বিষয়টি অন্যায় হবে। এক্ষেত্রে লঙ্কান কর্তৃপক্ষও নিজেদের শেষ সম্বল হিসেবে ভারতের আশ্রয়ই চাইছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে প্রতিটি ধাপেই।

আমরা সকলেই জানি, লঙ্কান অর্থনীতির দুরাবস্থার মধ্যে দেশটির রাষ্ট্রপতির অনুরোধে কোন ফায়দার আশা না করেই ভারত দেশটিকে ব্যাপক অর্থনৈতিক সহায়তার জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়। ভারতের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে এই বিনিয়োগে আশু কোনো লাভ রয়েছে বলে মনে হয়না! এমনকি লঙ্কার ঐতিহ্যগত মিত্র চীনও দেশটিকে লোন দিতে অস্বীকৃতি জানায়। এমতাবস্থায়, ভারত অনেকটা বিপদে পড়া ছোটভাইকে বাচানোর জন্য বড় ভাইয়ের মতো পদক্ষেপ নিয়েছে। এতে হয়তো অনেকেই ভাববেন যে শ্রীলংকা থেকে চীনের প্রভাব দূর হয়ে যাবে, সেজন্য ভারত এমন পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু আদতে বিষয়টি মোটেও এমন নয়। কেননা, চাইলেই লঙ্কায় চীনের প্রভাব বলয় দূর করা যাবেনা। দেশটিতে এখনও চীনের ব্যাপক অঙ্কের অর্থ বিনিয়োগ রয়েছে।

তাই ভারত যেসব চুক্তি করেছে শ্রীলঙ্কার সাথে, কিংবা সম্পর্কোন্নয়নে যেসব ভূমিকা নিয়েছে, সেটি আদতে অদূর ভবিষ্যতে দু দেশের মধ্যকার সম্পর্ক বাড়ানোর প্রচেষ্টা বৈ অন্য কিছুই নয়, কিংবা ঐতিহাসিকভাবে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকা প্রতিবেশীর সাথে সম্পর্কোন্নয়নের চেষ্টা, সেটা বুঝতে বিশারদ হতে হয়না।

স্মরণ করা যেতে পারে, জাফনায় হাইব্রিড বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলো মূলত চীনকে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু, ভারতের উপকূল থেকে খুব বেশি দূরে নয় এমন সংবেদনশীল পাল্ক বে অঞ্চলে এই ধরনের একটি উদ্যোগের বিষয়ে দিল্লি তার রিজার্ভেশন প্রকাশ করার পরে, কলম্বো এখন এটিতে ভারতীয় সহযোগিতা চেয়েছে। ভারতের বেসরকারী খাত আদানি গ্রুপ এই প্রকল্পের দায়িত্ব পেয়েছে। সম্ভবত, ইতিহাসে প্রথমবারের এভাবে চীনা প্রভাব সরিয়ে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পেরেছে শ্রীলঙ্কা। উল্লেখ্য, আদানিরা এর আগে কলম্বো বন্দরের ওয়েস্টার্ন কন্টেইনার টার্মিনাল (ডব্লিউসিটি) এর যৌথ উন্নয়নের অংশীজন ছিল।

গত কয়েক মাস ধরে, ভারতীয় পাবলিক সেক্টরের সংস্থাগুলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভিনটেজের তেল ট্যাঙ্ক খামারগুলোর পুনর্নবীকরণের জন্য যৌথ সেক্টর চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে, যাতে বহু মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ জড়িত। দুটি সরকারী সংস্থা যৌথভাবে একটি সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পও স্থাপন করছে সামপুরে। সামপুরকে মূলত ভারতের পাবলিক সেক্টর এনটিপিসি-এর জন্য এক দশক বা তারও বেশি আগে একটি কয়লা-চালিত বিদ্যুৎ-প্রকল্প স্থাপনের জন্য নির্বাচিত করা হয়েছিল এবং তেল-চালিত ইউনিট হিসাবে পুনর্নির্মাণ করা হয়েছিল। এখন, এনটিপিসি সৌর প্রকল্পের জন্য এটি নির্বাচিত করা হয়েছে।

দু পক্ষই নিজেদের মধ্যে সম্প্রতি প্রতিরক্ষা চুক্তিও সম্পাদন করেছে। যদিও এর আদ্যোপান্ত এখনও বিস্তারিত প্রকাশ করা হয়নি, তবে এখনই বুঝা যাচ্ছে যে অহিতকর কোনো কিছুই শ্রীলংকার জন্য বরাদ্দ করেনি ভারত। এ নিয়ে শ্রীলংকার প্রতিপক্ষ বিরোধী দলগুলো দেশজুড়ে একটি ঝামেলা সৃষ্টি করতে চাইলেও সরকারীভাবে গত ২৯ মার্চ এক বিবৃতি দিয়ে বিষয়টি মীমাংসা করেছে দেশটির সরকার।

আইওআর, বিমসটেক কিংবা অন্যান্য সকল বহুপাক্ষিক ফোরাম, যেখানে ভারত ও শ্রীলঙ্কা এঁকে অন্যের সাথে সম্পৃক্ত, প্রতিটি ক্ষেত্রেই ঘনিষ্ঠ হচ্ছে দু পক্ষ। ভারত একদিকে যেমন ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের কেন্দ্রীয়তার উপর জোর দিচ্ছে, একইভাবে, শ্রীলংকাও ভারতের নেতৃত্বে বিশ্বমঞ্চে নতুনভাবে নিজেদের প্রকাশ করছে। সাম্প্রতিক বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলন আয়োজনের মধ্য দিয়ে আদতে সে বার্তাই পাওয়া গিয়েছে।

লঙ্কান অর্থনীতির উপর ভারতীয় প্রভাব বেশ পুরনো হলেও সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহে বিষয়টি বেশ চোখে পড়ার মতোই! তবে সব সন্দেহবাতিক দূর করে দুই প্রতিবেশীর এমন অভূতপূর্ব মেলবন্ধনকে মান্যতা দেয়াতেই বিশ্ব মানবতার জয় নিহিত। গোটা বিশ্বজুড়েই সবাই যদি এঁকে অপরের বিপদে এগিয়ে আসতো এভাবে, তাহলে আজকের বিশ্ব ইউক্রেন-রাশিয়া সঙ্কট দেখতো না। তাই ভারত-শ্রীলঙ্কা সাম্প্রতিক সম্পর্ককে সাধুবাদ না জানিয়ে উপায় নেই। একইভাবে জয়শঙ্করের সাম্প্রতিক সফরে যেনো নতুন এক মাত্রা পেলো দু প্রতিবেশীর সম্পর্ক!

লেখকঃ শ্রীপতি নারায়ণন, পিএইচডি, ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর ওয়ার্ল্ড অ্যাফেয়ার (আইসিডব্লিউএ), নয়াদিল্লির একজন রিসার্চ ফেলো। (প্রকাশিত লেখনী সম্পূর্ণ তাঁর নিজস্ব অভিমত)


Fatal error: Uncaught wfWAFStorageFileException: Unable to save temporary file for atomic writing. in /home/nabajugc/public_html/wp-content/plugins/wordfence/vendor/wordfence/wf-waf/src/lib/storage/file.php:34 Stack trace: #0 /home/nabajugc/public_html/wp-content/plugins/wordfence/vendor/wordfence/wf-waf/src/lib/storage/file.php(658): wfWAFStorageFile::atomicFilePutContents('/home/nabajugc/...', '<?php exit('Acc...') #1 [internal function]: wfWAFStorageFile->saveConfig('livewaf') #2 {main} thrown in /home/nabajugc/public_html/wp-content/plugins/wordfence/vendor/wordfence/wf-waf/src/lib/storage/file.php on line 34