ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার সাপে-নেউলে সম্পর্কের কথাই এখনও অবধি গোটা বিশ্ব জেনে এসেছে। উভয় রাষ্ট্রই এঁকে অন্যের ভুল ধরা কিংবা কালিমা ছোড়ায় লিপ্ত থাকে বলে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকেরা অভিযোগ করে থাকেন। কিন্তু, এতদ্বসত্ত্বেও দু দেশের জনগণের রুচিবোধ, পছন্দ, মনন ও মানসিকতায় ঐতিহাসিকভাবে কিছু মিল রয়েছে। বাণিজ্য ক্ষেত্রে যা উভয়ের জন্যেই লাভবান হতে পারে।
ভারত বরাবরই প্রতিবেশীদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে সচেষ্ট। কিন্তু, পাকিস্তানের মৌলবাদী সরকারগুলো এবং তাঁদের কুখ্যাত গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর জন্য আজ অবধি দেশটির সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক একটি অস্থিতিশীল অবস্থায় রয়ে গিয়েছে! তবে সম্প্রতি কিছু ক্ষেত্রে সুর পাল্টাতে আরম্ভ করেছে ইসলামাবাদ।
এর সাম্প্রতিকতম উদাহরণ, গত সপ্তাহে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বাণিজ্য, বস্ত্র, শিল্প, উৎপাদন ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা আবদুল রাজাক দাউদ বলেছেন, “যতদূর পাকিস্তান বাণিজ্য মন্ত্রকের কথা সম্পর্কে জানি, তাদের অবস্থান ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য করা। ভারতের সাথে বাণিজ্য সবার জন্য, বিশেষ করে, পাকিস্তানের জন্য খুবই উপকারী এবং আমি এটা সমর্থন করি।”
ভারতের সঙ্গে এর আগেও বাণিজ্য ক্ষেত্রে সম্পর্ক বাড়ানোর বিষয়ে কথা বলেছিলেন পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। গত বছর যখন পাকিস্তান চিনি এবং তুলার ঘাটতির মুখোমুখি হয়েছিল, তখন ইমরান খানের নেতৃত্বাধীন অর্থনৈতিক সমন্বয় পরিষদ ঘোষণা করেছিল যে তারা ভারত থেকে এগুলো আমদানি করবে।
তবে পরবর্তীতে দেশটির আভ্যন্তরীণ চাপে এই সিদ্ধান্তটি বাতিল করতে বাধ্য হয় ইমরান সরকার। এর কারণ হিসেবে তখন পাক সরকার ঘোষণা দিয়েছিলো, “ভারত ৩৭০ অনুচ্ছেদ বিলুপ্তির সিদ্ধান্ত থেকে সরে না আসলে নয়াদিল্লীর সঙ্গে বাণিজ্য করবেনা ইসলামাবাদ।”
বিষয়টির কথা উল্লেখ করে পাক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা বলেছেন, “আমাদেরকে বাস্তববাদী হতে হবে। ভারত থেকে আমদানি আমাদের সময়ের প্রয়োজন। অন্য দেশ থেকে তুলা আমদানি করে আমরা আমাদের টেক্সটাইল শিল্পকে মারাত্মক ক্ষতির দিকে ঠেলে দিচ্ছি।”
একই প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে পাকিস্তানের তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির প্রধান ইজাজ খোখার বলেছেন, “বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার আইন অনুযায়ী, অন্য কোনো দেশের সঙ্গে বাণিজ্য করতে কেউ আপত্তি করতে পারে না। ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যে পাকিস্তান যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, তা মূলত, রাজনৈতিক কারণে। কিন্তু, অনুমতি নিয়ে ভারত থেকে ওষুধ আমদানি করা যাচ্ছে, তাহলে সুতা কেন নয়!”
উল্লেখ্য, সম্প্রতি ব্যাপক ওষুধ ঘাটতির মুখে পড়ে পাকিস্তান। সে প্রেক্ষিতে ভারত থেকে ওষুধ আমদানির অনুমতি দিয়েছে ইমরান খানের সরকার। এমনিতে অনেক ভারতীয় পণ্য দুবাই হয়ে পাকিস্তানে প্রবেশ করে। সেখানে ব্যাপক দাম বেড়ে যায় সেসব পণ্যের। তাই ভারতের সঙ্গে সরাসরি বাণিজ্যের কথাও ভাবছে ইমরান সরকার।
পাকিস্তানের সম্প্রতি প্রকাশিত জাতীয় নিরাপত্তা নীতিতেও বলা হয়েছে, “আমাদের নীতি ব্যাপক জাতীয় নিরাপত্তার মূলে অর্থনৈতিক নিরাপত্তাকে স্থান দেয়, ভূ-কৌশলের উপর ফোকাসকে পরিপূরক করার জন্য একটি ভূ-অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির উপর জোর দেয় এবং স্বীকার করে যে আমাদের প্রসারিত করার জন্য টেকসই এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি প্রয়োজন।”
এই নীতিতে আরও বলা হয়েছে, “পাকিস্তানের মূল্যবান ভূ-অর্থনৈতিক অবস্থান দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকার জন্য উত্তর-দক্ষিণ এবং পূর্ব-পশ্চিম সংযোগের মাধ্যমে একটি অনন্য সুযোগ প্রদান করে।”
এই প্রসঙ্গে, একাধিক অনুষ্ঠানে কথা বলেছেন পাক জেনারেল বাজওয়া এবং এস এম কুরেশি। তাঁদের মূল ভাষ্য এই যে, পাকিস্তান ক্রমশ ভূ-রাজনীতি থেকে ভূ-অর্থনীতিতে নিজেদের ফোকাস সরিয়ে নিচ্ছে। এখানে ভূ-অর্থনীতি অবলম্বন করা বোঝায় যে পাকিস্তান তার অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে তার ভূগোলকে কাজে লাগাবে।
এক্ষেত্রে, পাকিস্তানের অন্যতম শক্তি হওয়া উচিত ছিলো চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোর তথা সিপিইসি। এটি নিঃসন্দেহে চীনের জন্যে কূটনৈতিকভাবে ও বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক এক প্রকল্প। এর মাধ্যমে পাকিস্তানের উন্নয়নের অজুহাতে চীন মধ্যপ্রাচ্য থেকে তেল আমদানির জন্য পাকিস্তানের গোয়াদর বন্দরকে কাজে লাগাবে এবং সড়কপথে তা চীনে পরিবহন করবে।
তথাপি, পাকিস্তানও অর্থনৈতিকভাবে বেশ ফায়দা করতে সক্ষম হওয়ার কথা এখান থেকে। কিন্তু, করিডোরে চলাচলকারী চীনা যানবাহনকে সড়ক কর থেকে অব্যহতি প্রদান করা হয়েছে! এসব অর্থ আদায় সহ দোকানপাট তৈরী পূর্বক বেশ কিছু কর্মসংস্থান হওয়া উচিত ছিলো পাকিস্তানের। কিন্তু তা হয়নি! বরং ভূ-রাজনীতির চাপে পড়ে দিনকে দিন ঋণের বোঝা বাড়ছে ইসলামাবাদের উপর। দেশটির জাতীয় পরিষদের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান আব্দুল মজিদ খান খানান খাইল ২০১৭ সালে বলেছিলেন, “আমরা রাস্তা, জমি এবং পুরো রুট চাইনিজ ট্রাককে দিচ্ছি, তবে কী শর্তে?!”
রূঢ় বাস্তবতা হলো, এই রাস্তাগুলো শুধুমাত্র চীনা যানবাহনই ব্যবহার করছে! এর নির্মাণের জন্য অর্থ প্রদান করছে পাকিস্তান। তবে পাকিস্তান আরও বেশ কিছু সুযোগ হারিয়েছে এই ভূ-রাজনীতির খেলায়। সম্প্রতি ভারত আফগানিস্তানে গম পাঠাতে চায় পাক সড়ক ব্যবহার করে। বাণিজ্যও এগিয়ে নিতে চেয়েছিল হয়তো নয়াদিল্লী। কিন্তু পাক সরকার দর্পভরে সে আবেদন প্রত্যাখ্যান করে।
অবশেষে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও আফগানিস্তানের চাপে ঠিকই ভারতকে সড়ক ব্যবহার করতে দিতে বাধ্য হয় পাকিস্তান, কিন্তু সম্ভাব্য যে ফায়দা তারা আদায় করে নিতে পারতো, সেটি আর পায়নি! বিনা রাজস্বে ভারতীয় ট্রাকগুলো আফগানিস্তানে যায় পাক সড়ক ব্যবহার করে। ফলে আরও একটি আয়ের সুযোগ হারায় দেশটি।
গত তিন বছরে পাকিস্তানের রুপীর মান কমেছে প্রায় ৭০ শতাংশ। ২৮৯ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে এর ঋণ। মুদ্রাস্ফীতি দেশটির ইতিহাসে সর্বোচ্চ রেকর্ড অতিক্রম করেছে। তাই বলাই বাহুল্য পাকিস্তানের কাছে বর্তমানে ভূ-রাজনীতির মারপ্যাঁচে জড়ানোর চেয়ে ভূ-অর্থনীতির খেলায় জড়ানোটা বেশি লাভজনক প্রতীয়মান হচ্ছে।
পাকিস্তান যদি তার ভূ-অর্থনীতির ধারণাকে গুরুত্ব সহকারে বাস্তবায়ন করতে পারে এবং নিজেদের কৌশলগত স্থানকে কাজে লাগাতে চায়, তাহলে তার নীতিগুলোতে ব্যাপকভাবে পরিবর্তন করতে হবে। প্রথম এবং সর্বাগ্রে, দেশটিকে তার নিকট প্রতিবেশী, প্রধানত ভারতের সাথে, আবেগপ্রবণতা এবং বিভ্রমের উপর না থেকে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
এটা জানা কথা যে, ভারত অর্থনৈতিক ও সামরিকভাবে প্রতিবেশী হিসেবে পাকিস্তানের জন্য খুবই শক্তিশালী। ভারত কখনই কাশ্মীর নিয়ে নিজের সিদ্ধান্তগুলো ফিরিয়ে দেবে না এবং পাকিস্তানকে এই অঞ্চলের মধ্যে সমস্যা তৈরি করতে সফল হতে দেবে না। কাশ্মীরে সন্ত্রাসবাদ একটি ক্যান্সারের মতো, যা ভারত কখনই বাড়তে দেবে না। যেকোনো অপ্রীতিকর ঘটনার জবাব দেওয়া হবে, যেমনটি ঘটেছিলো বালাকোটের ক্ষেত্রে। তাই স্বভাবতই ভাবাবেগ দূর করতে হবে পাকিস্তানকে।
খুবই স্বাভাবিক বিষয় যে, ভারতের জন্য পাকিস্তানের সাথে বাণিজ্য তেমন আহামরি কিছু হবেনা। ভারত প্রতিনিয়ত বিশ্বব্যাপী নিজের মান বাড়াচ্ছে। তবে এটি পাকিস্তানের কৌশলগত স্থানকে লাভবান করতে পারে, যার ফলে দেশটির রাজস্ব খাতে যোগ হবে নতুন মাত্রা।
একটি সর্বোত্তম উদাহরণ হলো, একাধিক গ্যাস এবং তেল পাইপলাইন, যেগুলো, তুর্কমেনিস্তান বা ইরান থেকে নির্গত এবং ভারতে সমাপ্ত। এগুলোকে পাকিস্তানের মধ্য দিয়ে ট্রানজিট করতে পারলে ভারত যেমন লাভবান হবে, তেমনই এ থেকে পাওয়া রাজস্ব পাকিস্তানকে উপকৃত করবে। কিন্তু, ভূ-রাজনীতির মারপ্যাঁচে পাকিস্তান এই সুবিধা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে।
পরিশেষে, একটি দেশের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা সেখানকার প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা বৃদ্ধির জন্য অপরিহার্য। পুতুল প্রধানমন্ত্রীদের সাথে সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র, উন্নয়ন তহবিল এবং প্রযুক্তি বিনিয়োগের জন্য আদর্শ পরিবেশ দিতে পারেনা। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও ভারতের থেকে অনেক কিছু শিখতে পারে পাকিস্তান।
লেখক: মেজর জেনারেল হর্ষ কাকর (অব:), ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল এবং নিরাপত্তা বিষয়ক বিশেষজ্ঞ।