প্রশান্ত দীক্ষিত: ক্রমশ ইউক্রেনের উপর আক্রমণ জোরদার করছে রাশিয়ার সেনাবাহিনী। গোটা ইউরোপ জুড়ে বিরাজমান থমথমে অবস্থা! রুশ-ইউক্রেন সঙ্কট ঘিরে উত্তাল বৈশ্বিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কাও করছেন অনেকেই! এরই মাঝে ইউক্রেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর খারকিভে প্রবেশে করেছে রুশ বাহিনী। ইউক্রেনের একের পর এক স্থাপনা দখলে নিচ্ছে পুতিনের অনুগামীরা। শীঘ্রই পতন ঘটতে পারে রাজধানী কিয়েভের। দিনভর শত্রুপক্ষের স্বল্প পাল্লার রকেট, বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্র বর্তমান ইউক্রেনের রুঢ় বাস্তবতা।
এমতাবস্থায়, চুপচাপ বসে নেই ইউক্রেনও! কূটনৈতিক ও সামরিক উভয় ভাবেই পরাশক্তি রাশিয়াকে মোকাবেলা করার চেষ্টা করে চলেছে দেশটি। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যপদের আবেদন সহ বিভিন্ন মোড়ল রাষ্ট্রের প্রধানদের সঙ্গে আলোচনা অব্যহত রাখার পাশাপাশি সামরিকভাবেও যুদ্ধের ময়দানে রুশ আক্রমণের জবাব দিচ্ছে ইউক্রেন।
ইতোমধ্যে ম্যান পোর্টেবল এসএএম, এফআইএম – স্টিংগার মিসাইলের সাহায্যে রাশিয়ার বেশ কিছু হেলিকপ্টার ধ্বংস করতে সক্ষম হয়েছে ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনী। পাশাপাশি কিয়েভের সহযোগিতায় জার্মানী, ইইউ, যুক্তরাষ্ট্র সহ বিভিন্ন দেশ অত্যাধুনিক অস্ত্রাদিও পাঠিয়েছে। এখন দেখার বিষয় এই যে, রুশ বাহিনীর মোকাবেলায় কতক্ষণ প্রতিরোধ ধরে রাখতে পারে পূর্ব ইউরোপের দেশটি!
জানা গিয়েছে, ন্যাটো মিত্র দেশগুলো কিয়েভকে প্রায় সহস্রাধিক ম্যান পোর্টেবল এসএএম দিয়ে সাহায্য করছে। আমাদের মনে রাখতে হবে, এই ম্যান পোর্টেবল এসএএমগুলোই আফগানিস্তানে সোভিয়েত বিমান বাহিনীর শক্তিকে হ্রাস করেছিল। অর্থনৈতিকভাবে এক বাড়তি চাপ তৈরী করেছিলো রুশ বাহিনীর উপর, যার ফলে আফগানিস্তান থেকে দ্রুত বাহিনী প্রত্যাহার করে নেয় সোভিয়েত। তাই ধারণা করি, এবারও রুশ বাহিনীকেও ব্যাপক চাপে রাখবে অস্ত্রটি।
এদিকে, আলোচনা শুরু করেছে উভয় দেশই। কিন্তু, যুদ্ধের চিরায়ত নিয়ম মেনেই ভেস্তে গিয়েছে প্রথম দফার আলোচনা। মস্কো-কিয়েভ দ্বিতীয় দফা আলোচনা মাঠে গড়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে ঠিকই, কিন্তু সেটিও যে খুব একটা ফলপ্রসূ হবে, তা মনে হয়না! এরই মাঝে, নিজের পারমাণবিক প্রতিরোধ বাহিনীকে সতর্ক থাকার নির্দেশ নিয়েছেন পুতিন। এটি ন্যাটোর বিরুদ্ধে এক ধরণের সতর্কতা হিসেবেই মনে করছে বোদ্ধামহল।
পরিসংখ্যান ঘাঁটলে দেখা যায়, ন্যাটো বাহিনীর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের পর সবচেয়ে বেশি পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে ফ্রান্সের কাছে। যুক্তরাজ্যও পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্র। কিন্তু তারপরও সোভিয়েত উত্তরাধিকারী রাশিয়ার কাছে ন্যাটোর সম্মিলিত বাহিনীর চেয়েও বেশি পরমাণু অস্ত্র রয়েছে। একই সঙ্গে, বর্তমান পরিস্থিতিতে রাশিয়াকে সমর্থনকারী চীনের পরমাণু অস্ত্রও যদি রুশ গণনায় শামিল হয়, তবে তা বিধ্বংসী এক পরিসংখ্যানে গিয়ে দাঁড়াবে।
এখানে আলোচনা করতে গিয়ে বলবো, আমাদের মনে রাখা উচিত, উল্লখিত প্রতিটি রাষ্ট্রই পারমাণবিক বিস্তার রোধ চুক্তি স্বাক্ষরকারী দেশ। এছাড়া, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ঐতিহাসিক ‘ইন্টারমিডিয়েট রেঞ্জ নিউক্লিয়ার ফোর্সেস ট্রিটি (আইএনএফ)’ চুক্তিটিও স্বাক্ষরিক হয়েছিলো ১৯৮৭ সালের ডিসেম্বরে, যা ইতোমধ্যে মেয়াদ উত্তীর্ণ।
মূলত, ৫০০ থেকে ৫০০০ কিলোমিটারের ভেতর আঘাত হানতে সক্ষম সমস্ত ব্যালিস্টিক এবং ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র নির্মূল করা এবং এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর সরবরাহযোগ্য পারমাণবিক অস্ত্রাগার বাতিল করার দিকে কাজ করতে চুক্তিটি করা হয়েছিলো। কিন্তু, এরপরও পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্তার রোধ কাঙ্ক্ষিত গতি লাভ করেনি।
আর বর্তমানে ইউক্রেনীয় লক্ষ্যবস্তুগুলোতে যে ধরণের ক্ষেপণাস্ত্র এবং রকেট হামলা করা হচ্ছে, সেগুলো খুবই স্বল্প পরিসরের অস্ত্র, যার রেঞ্জ ৩০ কি ৪০ মিটারের বেশি হবেনা! তাই স্বাভাবিকভাবেই চুক্তিতে আঘাত না করেই ইউক্রেনে উদ্দেশ্য হাসিল করতে পারছে মস্কো।
অন্যদিকে, পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ মেনে নিরস্ত্র হওয়া ইউক্রেন রাশিয়ার বিরুদ্ধে এমন কিছুই ব্যবহার করতে পারছেনা। তাই ধরে নেয়া যায়, ইউক্রেন বর্তমানে প্রতিঘাতের চেয়ে আত্মরক্ষাতেই বেশি মনোযোগ দিবে। তাই বলা বাহুল্য, যতক্ষণ না রুশ সেনারা ইউক্রেনীয় ভূখণ্ডের উপর ডি-ফ্যাক্টোর নিয়ন্ত্রণ না পায়, ততক্ষণ এই হামলা অব্যহত থাকবে।
দু দেশের মধ্যে যুদ্ধ চলাকালীন প্রথম বৈঠকে শান্তির বার্তা নিয়ে হাজির হয়েছিলেন ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট ভ্লোদিমির জেলেনস্কি। ইউক্রেনের জনগণও এটিই চাইছে। রাশিয়া এ নিয়ে কোন মন্তব্য করেনি ঠিকই, কিন্তু মুদ্রার উলটো পিঠে সীমান্তগুলোতে তৎপরতা বাড়িয়েছে।
আশঙ্কার বিষয়, যেহেতু ন্যাটো ভুক্ত কিছু দেশ গোপনে ইউক্রেনের ভেতর অস্ত্র পাঠাচ্ছে, এমতাবস্থায়, আগামী দিনে ইউক্রেনের মাটিতে দৃঢ় এক যুদ্ধ শুরু হতে পারে। যুদ্ধে একটি দেশ জয়ী হবে। কিন্তু ক্ষতি তো দুই দেশের হচ্ছে। অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে। আর মারা যাচ্ছে হাজারো মানুষ। ইউক্রেনের ডেপুটি প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দাবি, এ পর্যন্ত রাশিয়ার ৪ হাজার ৩০০ সেনা নিহত হয়েছেন। ১৪৬টি ট্যাংক, ৭০৬টি যুদ্ধযান, ২টি ড্রোন, ২৬টি হেলিকপ্টার, ২৭টি উড়োজাহাজ ধ্বংস করেছে ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা বাহিনী।
এদিকে ইউক্রেনেরও অনেক সেনা নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছে সামরিক, বেসামরিক অনেক মানুষ। আর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অকল্পনীয়। যা দেখা যাচ্ছে—শুধু ধ্বংসস্তূপ। বৈরী আবহাওয়া আর রুশ সেনাদের ট্যাংকের শব্দে আতঙ্কিত মানুষ যেন জীবিত হয়েও মৃত। যেন যমদূত দাঁড়িয়ে আছে চোখের সামনে।
তবে এই আক্রমণের মাধ্যমে রাশিয়া কূটনৈতিকভাবেও বেশ প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছে। সবচেয়ে জোরালো প্রতিক্রিয়া এসেছে ইউরোপের শক্তিশালী অর্থনীতি জার্মানি থেকে। রাশিয়া থেকে টোটোতে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করার সময় এটি তার নর্ড স্ট্রিম II গ্যাস প্রকল্পটি সরিয়ে নিয়েছে। পাশাপাশি পুনঃসস্ত্রীকরণ কর্মসূচির জন্য ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সামরিক বাজেট ঘোষণা করেছে দেশটি। এটি সর্বোতভাবে ইউরোপের স্থিতিশীলতার জন্যেই এক বিরাট পরিবর্তনের ইঙ্গিত।
কূটনৈতিক ও সামরিক এই উত্থান পতনের মাঝেই ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে রাশিয়ার মিত্রদের তালিকা। কিন্তু চীন একমাত্র দেশ হিসেবে রাশিয়াকে প্রকাশ্যে কূটনৈতিক সমর্থন দিয়ে চলেছে। আর রাশিয়ার কাছের মিত্র ভারত এই যুদ্ধকে কেন্দ্র করে নিরপেক্ষ নীতি অবলম্বনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে ভারত ইউক্রেন থেকে নিজ প্রবাসীদের ফিরিয়ে আনতে বলিষ্ঠ ভূমিকা হাতে নিয়েছে।
কিন্তু, স্মরণে রাখা প্রয়োজন, যুদ্ধ মানে অনেক কিছু হারানো। পাওয়া না পাওয়ার বেদনা ভরা ক্ষত চিহ্ন। এসবের সঙ্গে যোগ হয়েছে হাজারো সামরিক-কূটনৈতিক হিসেব নিকেশ! তাই দিনশেষে এই যুদ্ধের ফলাফল বিশ্বকে কোথায় গিয়ে দাঁড় করায়, সেটিই এখন দেখার!
লেখক: ভারতীয় কূটনীতিক বিশেষজ্ঞ। প্রকাশিত মতামত সম্পূর্ণ তাঁর ব্যক্তিগত। (লেখাটি ইন্ডিয়া নিউজ নেটওয়ার্ক থেকে গৃহীত)