মেজর জেনারেল (অবঃ) হর্ষ কাকর: বর্তমান বিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একাধিপত্য প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। আন্তর্জাতিক বোদ্ধামহলের প্রায় সবাই এতে একমত পোষণ করবেন। এদিকে, কালের পরিক্রমায় রাশিয়াকে হটিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠছে চীন। অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক উভয় ক্ষেত্রেই ওয়াশিংটনকে টেক্কা দিচ্ছে বেইজিং। তবে এতসব সমীকরণের ভীড়েও আঞ্চলিক স্তরে চীনের তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে ভারত। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই।
গত শতাব্দীর আশির দশকে চীন যখন প্রথমবারের মতো মুক্ত অর্থনীতিতে প্রবেশ করলো, এরপর থেকেই অর্থনৈতিক খাতে উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি অর্জন করে দেশটি। চীনের লাল বাহিনীর কল্যাণে সামরিক শক্তি হিসেবে ইতোমধ্যেই দেশটি নাম কামিয়েছিলো। অর্থনীতি ও সমর শক্তির মিশ্রণে বৈশ্বিক কূটনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতেও বেশি বেগ পেতে হয়নি বেইজিংকে।
জাতি হিসেবে তাই চীনাদেরকে শ্রদ্ধার চোখেই দেখতো গোটা বিশ্ব। কিন্তু সাম্প্রতিককালে দক্ষিণ চীন সাগরে দখলদারিত্ব, তাইওয়ান ইস্যু এবং লাদাখে আক্রমণের মাধ্যমে ভারতের সার্বভৌমত্বে আঘাত, দেশটির সম্মান ভূলুণ্ঠিত বৈ কিছুই করছে না। কিন্তু, শি জিনপিং এর চীনা সরকার যেনো সবকিছু দেখেও অন্ধ, সব বুঝেও অবুঝ! তাই চীনা গর্হিত পদক্ষেপ গুলো আটকানোর জন্য তার মতো করেই খেলতে হবে।
ইতোপূর্বে প্রায় সাত দশক ব্যাপী, বিশেষত, ১৯৬২ সালের ভারত-চীন যুদ্ধের পর থেকে যৌথ স্বার্থের ইস্যুতে ভারত সর্বদাই নমনীয় গলায় কথা বলেছে। কিন্তু এতে লাভ তো হয়ইনি, ওল্টে আরও আগ্রাসী মনোভব নিয়ে ভারতকে বিপাকে ফেলেছে কমিউনিস্ট রাষ্ট্রটি। কিন্তু গত এক দশকে পরিস্থিতির মোড় ক্রমশ ঘুরতে আরম্ভ করেছে। চীনকেও পাল্টা জবাব দিতে আরম্ভ করেছে ভারতীয় নেতৃত্ব। ফলে, বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে চীনের দূর্বলতা।
সাম্প্রতিক এক ঘটনায় এর বিশেষ ছাপ লক্ষণীয়। সম্প্রতি বেইজিং শীতকালীন অলিম্পিক্স কূটনৈতিক বয়কটের সিদ্ধান্ত নেয় ভারত। অলিম্পিক্সের এক মশালবাহককে গালওয়ান হামলায় দেখা গিয়েছিলো, এই অভিযোগে অলিম্পিক্সের উদ্বোধনী ও সমাপনী অনুষ্ঠানে কোনও ভারতীয় কূটনীতিক উপস্থিত না থাকার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
এর আগে বেজিং অলিম্পিক্স কূটনৈতিকভাবে সর্বপ্রথম বয়কটের সিদ্ধান্ত নেয় আমেরিকা। তারাই প্রথম জানিয়েছিল যে অলিম্পিক্সে মার্কিন অ্যাথলেটরা যোগ দিলেও প্রশাসনের কোনও কর্মকর্তা সেখানে অংশ নেবেন না। এরপর একে একে কানাডা, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়াও একই সিদ্ধান্তের কথা জানায়। সম্প্রতি ডেনমার্ক এবং নেদারল্যান্ডসও একই কথা জানিয়েছে।
এতে ভীষণ বিপাকে পড়ে চীনা কর্তৃপক্ষ। বিশ্বমঞ্চে ব্যাপক ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয় দেশটির। এরপরই ডিফেন্সিভ প্লে শুরু করে দেয় বেইজিং এবং ঘটনার আদ্যোপান্ত বর্ণনায় লেগে যায়। তাই, কূটনৈতিক বয়কটের সিদ্ধান্ত যে ভারতের একটি মাস্টারস্ট্রোক, সেটি প্রমাণ হতেও বেশি দেরী লাগেনি। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মাত্র ২৪ জন রাষ্ট্রপ্রধানের উপস্থিতিও সে কথারই সাক্ষ্য দেয়।
উল্লেখ্য, বেইজিং শীতকালীন অলিম্পিক্সে উপস্থিত রাশিয়া ব্যতীত বাকি রাষ্ট্রপ্রধানদের বেশিরভাগই ঋণগ্রস্ত দেশের প্রতিনিধি। তাই স্বভাবতই চীনের আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে আরম্ভ করেছে। আর এই সুযোগটাই নিচ্ছে ভারত সহ চীনের প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলো। রক্ষণাত্মক ভঙ্গিমা ছেড়ে আক্রমণাত্মক আঙ্গিকে খেলার প্রস্তুতি নিচ্ছে নয়াদিল্লী সহ বাকিরা।
এছাড়া, ক্রমশ উজ্জ্বলতা হারাচ্ছে চীনের অর্থনীতির রঙ। গত ২৯ জানুয়ারি, চীনের আর্থিক প্রকাশনা Caixin -এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৬৬ টি রিয়েল এস্টেট কোম্পানির মধ্যে প্রায় ৩০ টি চলতি অর্থবছরে ক্ষতির আশঙ্কা জানিয়েছে। এছাড়া, ৫০০ চীনা ফরচুন কোম্পানির বেশিরভাগই ব্যবসায় লসের কথা জানিয়েছে। করোনা ধাক্কায় ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে চীনা এয়ারলাইন্সগুলোও।
সম্প্রতি এক নিবন্ধে লেফটেন্যান্ট জেনারেল পিআর কুমার চীনের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী লু জিওয়েইকে উদ্ধৃত করে লিখেছেন, সর্বজনীনভাবে উপলব্ধ ডেটা কখনই দেখায় না যে গত বছরের প্রথম ১১ মাসে প্রায় সাড়ে চার মিলিয়ন ক্ষুদ্র ব্যবসা ও মাইক্রো ফার্ম নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে। মাত্র ১.৩২ মিলিয়ন নতুন মাইক্রো সংস্থা খোলা হয়েছে। তথ্যটি নিঃসন্দেহে বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক, কেননা, বেইজিং নিজেদের মাইক্রো ও ছোট সংস্থাসমূহকে নিজেদের বেসরকারি খাতের মেরুদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করে।
এদিকে, সম্প্রতি রুশ-ইউক্রেন ইস্যুতেও স্বভাবতই বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ ও সংস্থা ইউক্রেনকে সমর্থন করছে এবং রুশ কার্যক্রমে বিরক্তি প্রকাশ করছে। ভারত সঙ্গত কারণে এখানে নিরপেক্ষ থাকলেও চীন কূটনৈতিক সমীকরণে রাশিয়াকে সমর্থন দিয়েছে। এতে আন্তর্জাতিক মহলেও প্রশ্নের সম্মুখীন বেইজিং। ন্যায়ভিত্তিক যুদ্ধে চীনের অবস্থান তাই ক্রমশ দূর্বল হচ্ছে।
এদিকে, সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার অনুসন্ধানী পত্রিকা ‘দ্য ক্ল্যাক্সন’ ভারত-চীন সংঘর্ষ ইস্যুতে এক চাঞ্চল্যকর প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে গালওয়ান সীমান্তে নিহত চীনা সৈন্যের সংখ্যা প্রায় চল্লিশোর্ধ্ব হিসেবে ধরা হয়। অথচ এর আগে চীন মাত্র চার জন সেনার নিহতের ঘটনা প্রকাশ করেছিলো। এমনকি, এই সেনারা যে ভারতের তাড়া খেয়ে নদীতে ডুবে মরেছিলো, সেটিও তুলে ধরে পত্রিকাটি। ফলত, সাধারণ জনগণের কাছে ইমেজ সঙ্কটে ভুগছে চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি।
এসবের উপর যোগ হয়েছে চীনের বিশাল জনসংখ্যা ও এতে বয়স্কদের বাড়ন্ত। গত বছর চীনে ১৯৪৯ সালের পর সবচেয়ে কম জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। এমতাবস্থায়, বার্ধক্যজনিত জনসংখ্যার চীনের অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি দীর্ঘমেয়াদে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হবে বলে মনে করছে বিশ্লেষকেরা।
সম্প্রতি ক্লদ আরপি নামের এক ফরাসি সাংবাদিক লিখেছেন, “তাইওয়ান, হংকং, তিব্বত, জিনজিয়াং -এর মতো গুরুত্বপূর্ণ সব সমস্যা চীনকে মোকাবেলা করতে হবে ও হচ্ছে। কিন্তু অর্থনীতি এবং জনসংখ্যার সমস্যা সমাধান করা সবচেয়ে কঠিন বলে মনে হচ্ছে।”
এসব বহুমুখী সমস্যার মাঝেই কূটনৈতিকভাবে চীনকে অব্যহত চাপ দিচ্ছে ভারত। কোয়াড গঠন সহ পরবর্তী কর্মকান্ড এবং সাম্প্রতিক কোয়াড পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের শীর্ষ সম্মেলন স্বাভাবিকভাবেই চীনের জন্য মাথাব্যথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই ক্রমাগত কোয়াড গঠন ও এর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে চীনের কর্মকর্তারা। এমনকি কোয়াডকে এশিয়ান ন্যাটো হিসেবেও আখ্যা দেয় দেশটি। কিন্তু ভারতের ক্ষুরধার কূটনীতির কাছে এই ইস্যুতে মার খাচ্ছে বেইজিং।
তাছাড়া, এবারই প্রথমবারের মতো আমরা লক্ষ্য করছি, দেশীয় ইস্যুর গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক ইস্যুতে চীনের কর্মকান্ডের নিন্দা জানাচ্ছে ভারত। সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার উপর চীনের অর্থনৈতিক বল প্রয়োগের বিরুদ্ধে সরব হোন ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। আক্রমণাত্মক ভঙ্গিমায় তীরবিদ্ধ করেন চীনকে। ফলত, নিজেকে রক্ষা করতে বাধ্য হয় চীন। পাল্টা বিবৃতি দিয়ে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করতে বাধ্য হয় দেশটি।
এসবের পাশাপাশি, লাদাখে চীনের কার্যকলাপের প্রতিক্রিয়ায় অনেক বেশি সরব ছিল মোদী সরকার। পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর নিজেই সরাসরি আক্রমণের তীরে বিদ্ধ করেন বেইজিংকে। এমনকি, চীনের আক্রমণের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বেইজিং এর উপর পাল্টা আক্রমণের হুশিয়ারি দেখান তিনি। তাছাড়া, চীনকে কমান্ডার পর্যায়ে আলোচনার টেবিলে আনতে বাধ্য করে ভারত সরকার।
এদিকে, চীনের বিরুদ্ধে ক্রমাগত চুক্তি লঙ্ঘনের অভিযোগও শানাচ্ছে ভারত। ভারতের এসব শাণিত চালের বিপরীতে নিজের কূটনৈতিক পূর্বাবস্থা ফিরে পেতে তীব্র চেষ্টা চালাচ্ছে বেইজিং। তবে যুক্তরাষ্ট্র সহ অন্য পশ্চিমা শক্তির ক্রমাগত চাপও মোকাবেলা করতে হবে দেশটিকে।
তবে সবচেয়ে মজার বিষয়, সম্প্রতি কোয়াড ইস্যু সহ বেশ কিছু ইস্যুতে চীনের মন্তব্যকে পাত্তাই দিচ্ছে না ভারত! এটা মোদী জমানার সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয়। চীনের সকল আপত্তিকে দূরে সরিয়ে রেখে আঞ্চলিক উন্নয়ন ও সবার জন্য নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধির দিকে জোর দিচ্ছে ভারত। এমনকি, সম্প্রতি ভারতকে কোয়াদের মূল চালিকা শক্তির স্বীকৃতি দেয় আমেরিকা।
একই সঙ্গে, অস্ত্র রপ্তানির দিকেও চীনের জন্য হুমকি হচ্ছে ভারত। ফিলিপাইনের কাছে ব্রহ্মোস ক্ষেপণাস্ত্র বিক্রির মাধ্যমে চীনের একচেটিয়া আধিপত্যের বাজারেও হানা দিয়েছে নয়াদিল্লী। পাশাপাশি দক্ষিণ চীন সাগরেও অবস্থান সুসংহত করার দিকে মনোযোগ দিয়েছে মোদী সরকার। তাই এশিয়ার সবচেয়ে বড় শক্তি হওয়া সত্ত্বেও কিছুটা হলেও মুশকিলে পড়েছে শি জিনপিং এর নেতৃত্ব।
পরিশেষে এটুকুই বলবো, ভারত কেন চীনের বিরুদ্ধে শক্ত পদক্ষেপ নিচ্ছে, এর কারণ বিশ্বের কাছে অজানা নয়। আলোচনায় চীনের অবহেলা এবং অবাধ্য চীনকে বাগে আনা, দুটোর জন্যেই ভারতের শক্তিশালী অবস্থান জরুরী। তাছাড়া, ভারতের সার্বভৌমত্ব রক্ষার ক্ষেত্রেও এটি অত্যাবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই ভারতের এমন আন্তর্জাতিক অবস্থান একদমই অপ্রত্যাশিত নয়, বরং বহুল আকাঙ্ক্ষিত। এখন দেখার বিষয়, ভারত কীভাবে নিজের অবস্থান ধরে রেখে চীনকে ক্রমাগত মোকাবেলা করতে পারে, আর বেইজিং কীভাবে নয়াদিল্লীর দাবার চালে বাগড়া দেয়!
লেখক: ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এবং নিরাপত্তা বিষয়ক বিশেষজ্ঞ।
(লেখাটি ইন্ডিয়া নিউজ নেটওয়ার্ক থেকে গৃহীত)