৯২ বছরে শেষ হলো কিংবদন্তী কণ্ঠশিল্পী লতা মঙ্গেশকরের কর্মময় পথচলা। হাসপাতালে দীর্ঘ লড়াইয়ের পর চলে গেলেন উপমহাদেশের সংগীতের এই প্রবীণ মহাতারকা। গত ০৬ জানুয়ারী, রবিবার, সকাল ৮টা ১২ মিনিটে মধ্য মুম্বাইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। খবরটি নিশ্চিত করেছেন ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এন সান্থানাম।
জানুয়ারি মাসের শুরুতে করোনায় আক্রান্ত হন লতা মঙ্গেশকর। তখন থেকেই ভর্তি ছিলেন মুম্বাইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালের আইসিইউতে। ৮ জানুয়ারি থেকে সেখানেই ছিলেন তিনি। শুরু থেকে চিকিৎসক প্রতীত সামদানির চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। প্রথমে করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। একসময় কোভিড নেগেটিভ হলেও পরে নিউমোনিয়া ধরা পড়ে।
চিকিৎসায় সাড়া দিচ্ছিলেন লতা। এরপর প্রবাদপ্রতিম গায়িকার শারীরিক পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় ভেন্টিলেশন সাপোর্ট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। আশার আলো দেখছিলেন চিকিৎসকেরাও। তবে শনিবার লতা মঙ্গেশকরের শারীরিক পরিস্থিতির আবার অবনতি হয়। এদিন দুপুরে চিকিৎসকেরা জানান, গায়িকার অবস্থা অত্যন্ত সংকটজনক। সেই খবর প্রকাশ্যে আসতেই অনুরাগীরা তাঁর আরোগ্য কামনা করেছেন।
এদিকে শনিবার সন্ধ্যাবেলা বোন লতাকে দেখতে হাসপাতালে ছুটে যান আশা ভোসলে। তখন থেকে উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়ে। ভক্ত, পরিবারের সবাই তাঁর সুস্থতার জন্য প্রার্থনা করতে থাকেন। চিকিৎসকেরাও চেষ্টা করতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত সব চেষ্টা ব্যর্থ করে চলে যান কিংবদন্তিতুল্য এ শিল্পী। লতার মৃত্যুতে শোকস্তব্ধ হয়ে পড়েছে গোটা উপমহাদেশ।
গানকে আজীবন ভালোবাসা এই মানুষটির জন্ম হয় ভারতের মধ্যপ্রদেশের ইন্দোরে ১৯২৯ সালে। পিতা নাট্য অভিনেতা ও গায়ক পণ্ডিত দিননাথ মঙ্গেশকর। প্রথমে মেয়ের নাম রাখেন হেমা। পরে তা বদলে রাখা হয় লতা। ৫ ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। বাবার মৃত্যুর পর ১৯৪২ সালে মাত্র ১৩ বছর বয়সে মারাঠি সিনেমায় গান গেয়ে সংগীতজীবন শুরু হয় লতার। পরের বছর কণ্ঠে তোলেন হিন্দি সিনেমার গান।
১৯৪৯ সালে হিন্দি সিনেমা ‘মহলের’ এর ‘আয়েগা আনেওয়ালা’ গানটি আলোচনায় আসেন তিনি। ব্যাপক পরিচিতিও পান। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। লতার সুরেলা কণ্ঠের জাদুতে বুঁদ থেকেছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম।
সাত দশকের দীর্ঘ ক্যারিয়ারে ৩০ হাজারের বেশি গান রেকর্ড করার বিরল কৃতিত্ব আছে তার। ৭০ বছরের গানের জীবনে শুধু যে গুণী ব্যক্তিদের প্রশংসা কুড়িয়েছেন তা নয়, ছোটখাটো থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
জীবনে বিয়ে করেননি তিনি। আজীবন গানকেই ভালোবেসে গেছেন এই কিংবদন্তী। বহু পুরস্কার ও সম্মাননা আছে তাঁর অর্জনের ঝুলিতে। ২০০১ সালে তিনি ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ভারতরত্ন পান। ১৯৯৯ সালে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা পদ্মবিভূষণ এবং ১৯৬৯ সালে তৃতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা পদ্মভূষণ অর্জন করেন। ২০০৭ সালে ফ্রান্স সরকার দেশটির সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা লেজিওঁ দনরের অফিসার খেতাব প্রদান করে লতাকে।
এছাড়া দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার (১৯৮৯), মহারাষ্ট্র ভূষণ পুরস্কার (১৯৯৭), এনটিআর জাতীয় পুরস্কার (১৯৯৯), জি সিনে আজীবন সম্মাননা পুরস্কার (১৯৯৯) এএনআর জাতীয় পুরস্কার (২০০৯), শ্রেষ্ঠ নারী নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী বিভাগে ৩টি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং ১৫টি বাংলা চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি পুরস্কার ও ফিল্ম ফেয়ার আজীবন সম্মাননা পুরস্কারসহ অসংখ্য অর্জন আছে লতার।
মধুমতি সিনেমার ‘আজারে পরদেসি’ গানের জন্য ১৯৫৮ সালে শ্রেষ্ঠ সংগীতশিল্পীর পুরস্কার পান । বাংলায় তার অসংখ্য জনপ্রিয় গান আছে। তার কণ্ঠে স্থান পেয়েছে ৪০০ এরও বেশি বাংলা গান। ১৯৬৩ সাল; ভারত-চীন যুদ্ধে লিপ্ত, জীবন বিসর্জন দিচ্ছেন সৈন্যরা। লতা গাইলেন ‘ইয়ে মেরে ওয়াতান কি লোগো’ গানটি। তার এই গান শুনে কেঁদেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং জওহরলাল নেহরু।
‘পিয়া তোসে’ (গাইড), ‘আপ কি নজরো নে সমঝা’ (আনপড়), ‘লাগ জা গলে’, ‘নয়না বরসে রিমঝিম’ (উও কন থি), ‘তু জাহা জাহা চলে গা’ (মেরা সায়া), ‘চলতে চলতে’, ‘ইনহি লোগো নে’ (পাকিজা)-র মতো বিখ্যাত সব গানের জন্ম তার কণ্ঠেই।
জাদুকরী কণ্ঠের লতা মঙ্গেশকর চেয়েছিলেন নিজের মতো করে হারিয়ে যেতে। ৯২ বছর বয়সে তিনি চলে গেলেন পার্থিব এই মায়া ছেড়ে। কিন্তু যুগ যুগ ধরে তার কণ্ঠ বেঁচে থাকবে শ্রোতার মন-মননে। তার মারা যাওয়ার খবরে শোকাহত গুণী এই শিল্পীর ভক্ত অনুরাগীরা। খবর: ইন্ডিয়া নিউজ নেটওয়ার্ক