প্রজাতন্ত্র দিবস বরাবরই গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যেক ভারতবাসীর কাছে। স্বাধীনতা দিবসের মতোই যথাযোগ্য মর্যাদায় দিনটি উদযাপন করে থাকে ভারত সরকার। দীর্ঘ আন্দোলনের পর ১৯৪৭ সালে ১৫ আগস্ট স্বাধীনতা লাভ করে ভারত। এরপর ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি কার্যকর হয় ভারতের সংবিধান। সেই সূত্র ধরেই ২৬ জানুয়ারি পালিত হয় প্রজাতন্ত্র দিবস হিসেবে। দিল্লির রাজপথে কুচকাওয়াজ, বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পালিত হয় দিনটি। এবছর ভারতের ৭৩ তম প্রজাতন্ত্র দিবস।
বিগত কয়েক দশক ধরেই প্রজাতন্ত্র দিবসে বিশেষ প্রদর্শনী ও কুচকাওয়াজ করে থাকে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীগুলো। এবারের ৭৩ তম প্রজাতন্ত্র দিবসেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। এবারের অনুষ্ঠানে অন্যতম আকর্ষণ ছিল ভারতীয় বিমান বাহিনীর ফ্লাইপাস্ট। স্বাধীনতার ৭৫ বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে ৭৫টি বিমান ও হেলিকপ্টার নিয়ে বিশেষ ফ্লাইপাস্টের আয়োজন করে ভারতীয় বিমানবাহিনী। তবে বিমানবাহিনীর বিশেষ প্রদর্শনী ছাড়াও প্রথমবারের মতো আরও কয়েকটি বিশেষ ঘটনার সাক্ষী হয়েছে এবারের অনুষ্ঠানটি।
কোভিড পরিস্থিতির কারণে গত দু বছর ধরে প্রজাতন্ত্র দিবস পালনের অনুষ্ঠানে কিছু কাঁটছাঁট করা হলেও কমেনি এর জৌলুস। সকল ধরণের প্রোটোকল মেনেই এবারও দিনটি উদযাপন করছে ভারতীয়রা। এর মধ্যে রয়েছে ন্যাশনাল ক্যাডেট কর্পস কর্তৃক ‘শহীদন কো শত শত নমন’ কর্মসূচির সূচনা; দেশব্যাপী ‘বন্দে ভারতম নৃত্য’ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নির্বাচিত ৪৮০ জন নৃত্যশিল্পীর সাংস্কৃতিক পরিবেশনা; ১০ টি স্ক্রোলের একটি প্রদর্শনী, যার প্রতিটি ৭৫ মিটার দৈর্ঘ্যের।
এছাড়াও, নিয়মতান্ত্রিক কিছু বিষয় যেমন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর জাতীয় যুদ্ধ স্মৃতিসৌধ পরিদর্শন পূর্বক পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে নিহত বীরদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো, রাজপথে স্যালুটিং মঞ্চে জাতীয় পতাকা উত্তোলন, ২১ বন্দুকের তোপধ্বনীর মাধ্যমে স্যালুট সহ জাতীয় সঙ্গীত বাজানো এবং রাষ্ট্রপতি কোভিন্দকে অভিবাদন জানানোর মাধ্যমে কুচকাওয়াজ শুরু -সবই ছিলো এবারের আয়োজনে।
এবারের কুচকাওয়াজের নেতৃত্ব দেন প্যারেড কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল বিজয় কুমার মিশ্র এবং মেজর জেনারেল অলোক কাকার। উভয়েই স্বীয় কর্মক্ষেত্রে নিজ কর্ম গুণে বিশেষ মর্যাদার অধিকারী। তাদের সঙ্গে অংশ নেন দেশের পরম বীর চক্র এবং অশোক চক্র সহ সর্বোচ্চ বীরত্ব পুরস্কারে বিজয়ীরা।
সেনা, বিমান এবং নৌবাহিনীর প্রতিনিধি দল
এবারের প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজে ভারতীয় সেনাবাহিনীর মার্চিং কন্টিনজেন্টের থিম ছিল গত ৭৫ বছরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইউনিফর্ম এবং সদস্যদের অস্ত্রের বিবর্তন প্রদর্শন। এর মধ্যে ১৯৪৭ সালের ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইউনিফর্ম পরিধান করেছিল রাজপুত রেজিমেন্টের প্রতিনিধি দল। পাশাপাশি .৩০৩ রাইফেলও বহন করে দলটি।
১৯৬২ সালের ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইউনিফর্ম পরিধান করেছিল আসাম রেজিমেন্ট। ১৯৭১ সালের ইউনিফর্ম পড়েছিলো জম্মু ও কাশ্মীর লাইট রেজিমেন্ট। ৭.৬২ এমএম রাইফেলও বহন করে তাঁরা। বর্তমান সময়কার ইউনিফর্ম পরিধান করেছিলো শিখ লাইট রেজিমেন্ট এবং আর্মি অর্ডন্যান্স কর্পস এর কন্টিনজেন্ট। ৫.৫৬ এমএম ইনসাস রাইফেল বহন করে তাঁরা। আর গত ১৫ জানুয়ারী উন্মোচিত ভারতীয় সেনাবাহিনীর নতুন কমব্যাট ইউনিফর্ম পরিধান করে প্যারেডে আসে প্যারাসুট রেজিমেন্টের দল। ৫.৫৬এমএম x ৪৫এমএম ট্যাভোর রাইফেল বহন করে এই দলটি।
অন্যদিকে, নৌবাহিনীর কন্টিনজেন্ট কমান্ডার হিসেবে ছিলেন লেফটেন্যান্ট সিডিআর আঁচল শর্মা। তাঁর নেতৃত্বে নৌবাহিনীর ৯৬ জন তরুণ নাবিক এবং চারজন অফিসার প্যারেডে অংশ নেয়। এটি ভারতীয় নৌবাহিনীর বহুমাত্রিক ক্ষমতা প্রদর্শনের লক্ষ্যে বিশেষভাবে ডিজাইন করা নৌ মূর্তির মতো আকারে এগিয়ে যায়।
এদিকে, ভারতীয় বিমানবাহিনীর কন্টিনজেন্টের নেতৃত্ব দেন স্কোয়াড্রন লিডার প্রশান্ত স্বামীনাথন। ৯৬ জন এয়ারম্যান এবং চারজন অফিসার ছিলেন এই প্রতিনিধি দলে। ‘ইন্ডিয়ান এয়ার ফোর্স: ট্রান্সফর্মিং ফর দ্য ফিউচার’ শিরোনামের একটি মূকনাট্য পরিচালনা করে তাঁরা। এয়ার ফোর্সের MiG-21, Gnat, Light Combat Helicopter এবং Rafale বিমানের পাশাপাশি Aslesha রাডারের স্কেল ডাউন মডেল দেখানো হয়েছে সেখানে। এতে ভারতের প্রথম মহিলা রাফালে ফাইটার জেট পাইলট ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শিবাঙ্গী সিংও অংশ নিয়েছিলেন।
দুর্ধর্ষ ‘ফ্লাইপাস্ট’
স্বাধীনতার ৭৫ বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে ৭৫টি বিমান ও হেলিকপ্টার নিয়ে বিশেষ ফ্লাইপাস্টের আয়োজন করে ভারতীয় বিমানবাহিনী। এসব বিমানের মধ্যে ছিলো বিশেষ রাফাল বিমান, সুখোই, জাগুয়ার, এমআই-১৭, সারং, অ্যাপাচি এবং ডাকোটা। এই বিমানগুলো রাহাত, মেঘনা, একলব্য, ত্রিশূল, তিরঙ্গা, বিজয় এবং অমৃত এর মতো প্রদর্শনীতে অংশ নেয়।
সবশেষে, জাতীয় সঙ্গীত বাজিয়ে এবং তিরঙা বেলুন উড়িয়ে সমাপ্তি ঘটে অনুষ্ঠানের। গোটা অনুষ্ঠান দূরদর্শনে প্রদর্শিত হয়। অনুষ্ঠানে যথারীতি অংশ নিয়েছিলো ভারতের রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল গুলো। ভারতের বাইরেও বিশ্বব্যাপী ভারতীয় মিশনে দিনটিকে বিশেষভাবে পালন করা হয়েছে। সর্বোপরি, এবারের অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে নতুন এক ভারতের জন্মই যেনো দেখলো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়।
খবর: ইন্ডিয়া নিউজ নেটওয়ার্ক