শ্রীকান্ত কোন্ডাপল্লী: ইতিহাসের পাতা উল্টালেই দেখা যাবে, আমাদের সুপ্রাচীন ভারতবর্ষ সদা সর্বদাই বহিঃশত্রুর আক্রমণে বিধ্বস্ত হয়েছে। কিন্তু পরমুহূর্তেই প্রবল বিক্রমে ফিরে এসে কূটনীতিতে তাক লাগিয়ে দিয়েছে গোটা বিশ্বকে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নরেন্দ্র মোদীর ভারতের বিচরণ ছিলো অনেক বেশি দৃশ্যমান। তবে কূটনৈতিক বিশ্লেষক মাত্র স্বীকার করবেন, বিগত বছরগুলোয় ভারতের বৈশ্বিক পথচলা ছিলো অত্যন্ত বন্ধুর এবং কণ্টকাকীর্ণ। নিজের পশ্চিম সীমান্তে চীনের অব্যহত চাপের মাঝেই করোনা মহামারীর ভয়াল থাবা, ভারতকে সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষায় ফেলেছিলো।
বিশেষজ্ঞ রিপোর্ট মতে, চীনের সাথে সংঘর্ষে গালওয়ান সীমান্তে প্রায় ২০ ভারতীয় জওয়ান শহীদ হয়েছেন। একই সময়, উহান থেকে ছড়িয়ে পড়া বিশ্বব্যাপী মরণঘাতি ভাইরাস করোনায় নিহত হয়েছে প্রায় ৫ লক্ষের মতো ভারতীয় নাগরিক। কিন্তু, এতদসত্ত্বেও ভারত এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেছে অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে। সীমান্তে কঠোর নীতি গ্রহণ পূর্বক চীনকে মোক্ষম জবাব যেমন মোদীর সরকার দিতে পেরেছে, একই সঙ্গে দৃঢ় হাতে মহামারী মোকাবেলা করে ভারতের অর্থনীতির চাকাও আবারও ঘুরতে আরম্ভ করেছে।
আমরা বরাবরই লাইন অব একচুয়াল কন্ট্রোলে চীনের ঔদ্ধত আচরণ দেখে এসেছি। তবে এবার ভারতীয় সেনারা যে প্রবল চপেটাঘাত তাঁদের করেছে, সেটি হয়তো নিকট অতীতে খুঁজে পাওয়া যাবেনা। তবে সময় এসেছে, আন্তর্জাতিকভাবেও চীনকে টেক্কা দেয়ার। সীমান্তে অনবরত ভারতের বিরুদ্ধে আগ্রাসনে জড়িত থাকায় চীনকে অবশ্যই শাস্তি দিতে হবে।
পরিসংখ্যানগতভাবে বিবেচনা করলে ভারতের চেয়ে চীনের অবস্থান নিঃসন্দেহে অনেক উপরে। চীনের মোট দেশজ উৎপাদন যেখানে প্রায় ১৭ ট্রিলিয়ন ডলার, সেখানে ভারতের মাত্র ৩ ট্রিলিয়ন ডলার। প্রতিরক্ষা বাজেটেও ভারতের চেয়ে ঢের এগিয়ে চীন। প্রতিবছর নয়াদিল্লী যেখানে ৭০ বিলিয়ন ডলার খরচ করছে, সেখানে চীনের বাজেট প্রায় ৩০০ বিলিয়ন ডলার। পাশাপাশি কমিউনিস্ট রাষ্ট্রটির প্রায় ১০০০ পারমাণবিক ওয়ারহেড রয়েছে, যা ভারতের চেয়ে প্রায় দশ গুণ।
সংখ্যাগত এই বিশাল অসামঞ্জস্যতার কারণেই ভারতের উপর স্বেচ্ছাচারী মনোভব দেখাতে পারে চীন। কিন্তু তারপরও চীনকে টেক্কা দিতে হলে ভাবতে হবে চীনের মতো করেই। সীমান্তে কঠোর অবস্থান গ্রহণের ফলে যে উত্তেজনা ভারত এবং চীনের মধ্যে বিরাজমান, সেটি যুদ্ধের ময়দান থেকে বের করে আরও বৃহৎ পরিসরে এগিয়ে নিতে হবে। আইন, মিডিয়া এবং মনস্তাত্ত্বিক লড়াই -এই তিন ক্ষেত্রে চীনকে টেক্কা দিতে হবে এবং ছাপিয়ে যেতে হবে নয়াদিল্লীর। তবেই সমীহ পাবে ভারত। নিশ্চিত হবে সীমান্ত সুরক্ষা।
চীন নিঃসন্দেহে নিজের প্রতিরক্ষা এবং আভ্যন্তরীণ খরচা মেটাতে অনেক বেশি অর্থ ব্যয় করে। ভারতের সঙ্গে সীমান্তে প্রায় ৬০ হাজার নিয়মিত চীনা সৈন্য মোতায়েন করে এই খরচের একটা ছোট্ট নমুনা ইতোমধ্যে বিশ্বকে দেখিয়েছে দেশটি। শি জিনপিং এর সরকার ভেবেছিলো হয়তো এতেই ভারত ঘাবড়ে যাবে। কিন্তু ভারত যখন সবাইকে অবাক করে দিয়ে চীনা সৈন্য মোকাবেলায় পশ্চিমাঞ্চলীয় সেক্টরে প্রায় ৯০ হাজার সৈন্য মোতায়েন করে এবং প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখার অন্যান্য অংশে আরও ৫০ হাজার সৈন্য মোতায়েন করে, তখন নিঃসন্দেহে ধাক্কা লাগে চীনা অহমিকায়। ভেস্তে যায় তাদের সব পরিকল্পনা।
চীন ভেবেছিলো ভারতের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে কিছু ভূখন্ড দখলে নিয়ে আন্তর্জাতিক ও আভ্যন্তরীণ উভয় ক্ষেত্রেই ভারতকে কোনঠাসা করে ফেলবে, কিন্তু ভারতের যুদ্ধংদেহী প্রতিক্রিয়ায় নিঃসন্দেহে বিপাকে পড়ে চীনের কূটনৈতিক নীতি নির্ধারকেরা।
তাছাড়া, যুদ্ধ এড়িয়ে আলোচনার মাধ্যমে সংঘাত এড়ানোর চেষ্টায় ভারত আন্তর্জাতিকভাবেও ব্যাপক সমর্থন আদায় করে। মূলত ভারতের ইচ্ছের প্রেক্ষিতেই বেশ কয়েকবার মন্ত্রী পর্যায়ে এবং পরবর্তীতে সেনা কমান্ডার পর্যায়ে বৈঠকে বসে চীন। যদিও এসব আলোচনার কাঙ্ক্ষিত ফল এখনও আসেনি, তথাপি দৃশ্যমান কিছু অগ্রগতি ইতোমধ্যে অর্জিত হয়েছে।
সীমান্তে সংঘাতের পাশাপাশি চীন ভারতকে চাপ দিতে প্রতিনিয়তই নিত্য নতুন কৌশল অবলম্বন করছে। কিছুদিন পূর্বেই আমরা দেখলাম, ভারত সীমান্তের পাশে থাকা তিব্বত এবং জিনজিয়াং প্রদেশের সীমান্ত ঘেষে আধুনিকায়নের কাজ আরম্ভ করেছে বেইজিং। সেখানে ভারী সামরিক যান ও অস্ত্রের আনাগোনাও লক্ষ্য করা যায়।
এটি যে ভারতকে মনস্তাত্ত্বিকভাবে বিপাকে ফেলার ষড়যন্ত্র, তা বুঝতে হলে অনেক বড় বিশেষজ্ঞ না হলেও চলে! তবে এই প্রতিকূল পরিবেশে নরেন্দ্র মোদীর সরকার যে পদক্ষেপ নিয়েছে, তা নিঃসন্দেহে অমর হয়ে থাকবে ইতিহাসে! চীনের সীমান্ত ঘেষা প্রদেশ আধুনিকায়নের নীতি মেনে ভারতও পাল্টা হিসেবে অরুণাচল, লাদাখ সহ সীমান্ত ঘেষা সকল অঞ্চলে অবকাঠামোগত উন্নয়নের নীতি অবলম্বন করে, যা রীতিমতো চমকে দিয়েছে চীনা কর্তৃপক্ষকে।
এছাড়াও, ভারতকে বিপাকে ফেলতে চীনের সাম্প্রতিক বেশ কিছু পদক্ষেপ, যেমনঃ অরুণাচল প্রদেশের নাম পরিবর্তন করে মানচিত্র প্রকাশ, গালওয়ান সীমান্তে ভুয়া পতাকা উত্তোলনের ভিডিও ছড়িয়ে দেয়া এবং ভারত সীমান্তের ভেতর ঢুকে গ্রাম প্রতিষ্ঠার গুজব – সবই অত্যন্ত সুচারু পরিকল্পনার অংশ। কিন্তু তারপরও ভারত যে দৃঢ়তায় এবং দক্ষতার সঙ্গে এসব চক্রান্ত মোকাবেলা করছে এবং সব অপকর্মে ন্যসাৎ করে দিচ্ছে, সেটি নিশ্চয়ই প্রশংসার দাবিদার।
ইতোপূর্বে, ১৯৯৩, ১৯৯৬, ২০০৫ এবং ২০১৩ সালেও চীন ভারতের উপর অব্যহত লাগামহীন আক্রমণ শাণিত করলেও এবারের মতো কঠোর প্রতিরোধের মুখোমুখি হয়নি। ভারত বরাবরই সীমান্তে শান্তির বার্তা দিলেও কোনো এক অজানা কারণে কিংবা ভারতেরই আরেকটি প্রতিবেশীকে খুশি করতে চীন সবসময়ই এমন এক তরফা আচরণ করে আসছে। কিন্তু এবার নরেন্দ্র মোদীর সরকার যে পদক্ষেপসমূহ নিয়েছে, তাতে অন্ততপক্ষে এটুকু বেইজিং বুঝে গিয়েছে যে ভারত আর আগের সেই নরম ফুলের মতো নেই!
তবে সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক বিষয় এই যে, ভারত এবার আর শুধু তাৎক্ষণিক জবাব দিয়েই থেমে নেই! বরং বৃহৎ প্রস্তুতির অংশ হিসেবে জরুরী যুদ্ধাস্ত্র ক্রয় এবং উৎপাদন শুরু করে দিয়েছে পুরোদমে। এস-৪০০ ব্যালিস্টিক মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ক্রয় তারই ইঙ্গিতবাহী। ইতোমধ্যে নতুন অনেক যুদ্ধাস্ত্র যোগ হয়েছে ভারতের অস্ত্রসম্ভারে। এর মধ্যে রয়েছে ৮০০ কিলোমিটার পাল্লার পারমাণবিক সক্ষম শৌর্য ক্ষেপণাস্ত্র, লেজার-গাইডেড অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক গাইডেড মিসাইল, রাডার ধ্বংস করার জন্য রুদ্রম-১ অ্যান্টি-রেডিয়েশন মিসাইল, এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম এবং কমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক, অভয়াস মিসাইল, হাইপারসনিক প্রযুক্তির পরীক্ষামূলক গাড়ি এবং ব্রহ্মোস সুপারসনিক ক্রুজ মিসাইলের নৌ সংস্করণ।
শুধুমাত্র গতবছরই এলএসি জুড়ে প্রায় ৪৪ টি রাস্তা নির্মাণ করেছে বা করার সূচনা করেছে ভারত। পাশাপাশি অঞ্চলটিতে মাত্র এক দিনে ৩৬ কিলোমিটার রাস্তা তৈরীর মাধ্যমে এক বিশ্বরেকর্ডও তৈরী করে ভারতীয় সেনারা। ফলত মনোবল ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে ভারতীয়দের মাঝে। এর প্রতিফলন আমরা দেখতে পাচ্ছি আমাদের সেনাদের কার্যকলাপেও। যেখানে ১৯৮৭ সালে প্রতি এক চীনা সৈন্যের বিপরীতে দশজন ভারতীয় সৈন্য মারা যেতো, সেখানে এই হার বর্তমানে প্রায় সমান সমান।
আর তাই বলতেই হবে, ভারত যেমন দিনকে দিন নিজের নামের প্রতি সুবিচার করছে, তেমনই ভারতের এই কঠোর অবস্থান চীনের যাবতীয় অসৎ পরিকল্পনাকে দিয়েছে ভন্ডুল করে।
লেখক: প্রফেসর, চীনা অধ্যয়ন বিভাগ, জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় (প্রকাশিত লেখনী সম্পুর্ণ তাঁর নিজস্ব মতামত)