০২:২৯ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

চীনের তথ্য যুদ্ধের কৌশল

মেজর জেনারেল (অবঃ) হর্ষ কাকর: বিশ্বজুড়ে ইন্টারনেটের প্রভাব বদলে দিচ্ছে সাধারণ মানুষের জীবনযাপন ও কাজের ধরণ! রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও তৈরী হচ্ছে বড় ধরণের সম্ভাবনা এবং হুমকির। সাইবার যুদ্ধ এখন আর কোন বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী নয়, ইতোমধ্যে এরকম হামলার শিকার হয়েছে বিশ্বের বহু রাষ্ট্র। আজকের এই লিখাটি চীনের সাইবার যুদ্ধের কৌশল নিয়ে। তাই পাঠকমহলকে নতুন কিছু সম্পর্কে ধারণা দিতে পারবো বলে আশা করি।

চীন সাধারণত নিজের শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধের ক্ষেত্রে প্রথমে মনস্তাত্ত্বিক লড়াইয়ে নেমে পড়ে। সাইবার মাধ্যম কাজে লাগিয়ে নিজ সেনাবাহিনীর প্রকৃত সক্ষমতা গোপন পূর্বক তা কয়েক গুণ বাড়িয়ে পেশ করে। পাশাপাশি প্রতিপক্ষের তথ্যসমূহ যথাসম্ভব সংগ্রহ করে আইনী যুদ্ধের এবং বিভ্রান্তি ছড়ানোর সুযোগ তৈরী করে। এতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই চীনের প্রতিপক্ষ রাষ্ট্রগুলো যুদ্ধের আগেই মনোবল হারিয়ে বসে!

সম্প্রতি বেশ কিছু পর্যবেক্ষণে বেরিয়ে আসে, চীন নিজেদের পিপলস লিবারেশন আর্মির প্রকৃত সক্ষমতা গোপন করতে পশ্চিমা চলচ্চিত্রের যুদ্ধের দৃশ্যগুলোকেও নিজ সেনাবাহিনীর ক্লিপ হিসেবে ব্যবহার করেছে। আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষকদের একজন আনশুল সাক্সেনা কিছুদিন পূর্বেই তাঁর টুইটার হ্যান্ডলে চীনা তথ্য যুদ্ধের ফটোগ্রাফ এবং তাদের উত্সগুলোর একটি সংগ্রহ পোস্ট করেছেন।

আনশুলের মতে, চীন নিজের সামরিক শক্তি বাড়িয়ে পেশ করার জন্যে টপগান, ট্রান্সফরমার, রক এবং হার্ড লকার সহ পশ্চিমা চলচ্চিত্রের ভিডিও এবং ফটোগ্রাফ ব্যবহার করেছে। চীনের নৌবাহিনী নিজ সক্ষমতা প্রদর্শন করতে গিয়ে রাশিয়ান এবং মার্কিন যুদ্ধজাহাজের ছবি প্রদর্শন করেছে। এতে সহজেই বুঝা যায় চীন মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধে জয়লাভ করতে কতোটা নিচে নেমে আসতে পারে!

এরকমই আরেকটি ভিডিও সম্প্রতি নতুন বছরের শুরুতেই সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ভিডিওতে দেখা যায়, চীনের সেনারা গালওয়ান ভূখন্ডে চীনা পতাকা উত্তোলন করছে। ভিডিওটি ভারতের অভ্যন্তরে তোলপাড় সৃষ্টি করে। রাজনীতিবিদদের মধ্যেও এ নিয়ে ভীষণ বচসা তৈরী হয়। কিন্তু পরবর্তীতে ব্যাপক অনুসন্ধানের মাধ্যমে প্রমাণিত হয় যে গোটা ভিডিওটি ভুয়া! চীন নিজ ভূখন্ডের অভ্যন্তরে কোথাও শ্যুটিং পূর্বক নকল ভিডিওটি তৈরী করেছে। এর জন্য পেশাদার অভিনেতা নিয়োগের অভিযোগও উঠে চীনের বিরুদ্ধে। ভারতীয় সেনাবাহিনী যখন গালওয়ান সীমান্তের অভ্যন্তরে নিজ পতাকা উত্তোলন পূর্বক পাল্টা ভিডিও প্রকাশ করে, তখন এর কোনো প্রত্যুত্তর চীন দিতে পারেনি। এ থেকে প্রমাণিত হয় চীন প্রকৃত যুদ্ধের পূর্বে নিজ শত্রুকে মনস্তাত্ত্বিকভাবে দূর্বল করতে যেকোনো পন্থা অবলম্বন করতে পারে।

সর্বশেষ অরুণাচল প্রদেশ নিয়েও এক ঘৃণ্য খেলায় মেতে উঠেছে চীনা কর্তৃপক্ষ। কিছুদিন আগে জানা গিয়েছিলো, অরুণাচল প্রদেশে আস্ত একটা গ্রাম বানিয়ে ফেলেছে চীন। এরপর দেখা গেলো অরুণাচলের ১৫ এলাকার নাম পাল্টে দিয়েছে চীন। গত ২৯ ডিসেম্বর অরুণাচলের ওই এলাকাগুলোর নাম বদলে দেয় চীন। চীনের সরকারি গণমাধ্যম গ্লোবাল টাইমসে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, জংনান (অরুণাচলের চীনা নাম) প্রদেশের ১৫ স্থানের নামকরণ করা হয়েছে। চীনা, তিব্বতি ও রোমান হরফে ওই নামকরণ করা হয়েছে। এই ১৫ স্থানের মধ্যে ৮টি জনবসতি, ৪টি পাহাড়, ২টি নদী ও একটি গিরিখাত আছে।

বেজিংয়ের এ কর্মকাণ্ডের তীব্র বিরোধিতাও করে ভারত। জানিয়ে দেয়া হয়, অরুণাচল ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। কেবল নতুন নাম দিয়ে ওই সত্য বদলে দেয়া যাবে না। এর আগেও ২০১৭ সালে অরুণাচল প্রদেশের ছয় স্থানের নাম বদল করেছিল চীন। চীনের দাবি, অরুণাচল দক্ষিণ তিব্বতের অংশ।

চীনের এ ধরনের কর্মকাণ্ডের তীব্র বিরোধিতা করে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচি জানিয়েছেন, “‌বিষয়টা জানতে পেরেছি। এর আগেও চীন অরুণাচল প্রদেশের নানা অংশের নাম বদলাতে চেয়েছে। ২০১৭ সালে এপ্রিল থেকে এ কাজ করে আসছে চীন। কিন্তু অরুণাচল প্রদেশ যে ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল এবং থাকবে, এ সত্যটা এভাবে নাম বদল করে পাল্টে দেয়া যাবে না।”

কিছুদিন পূর্বে ভারতের চীনা দূতাবাসের রাজনৈতিক কাউন্সিলর অল-পার্টি ইন্ডিয়ান পার্লামেন্টারি ফোরাম ফর তিব্বতের (এপিআইপিএফটি) কয়েকজন সদস্যকে চিঠি লিখেছিলেন, যারা গত ২২শে ডিসেম্বর, ২০২১ তিব্বতের নির্বাসিত সরকার কর্তৃক আয়োজিত একটি নৈশভোজে অংশ নিয়েছিলেন। চিঠিতে লিখা ছিলো, “আমরা লক্ষ্য করেছি আপনারা তথাকথিত তিব্বতের নির্বাসিত সরকার কর্তৃক আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন। আমি এ বিষয়ে আমাদের উদ্বেগ প্রকাশ করছি।”

এই চিঠিরও তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায় ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। দপ্তরের পক্ষে বলা হয়, “চিঠির উপাদান, স্বর এবং টেনার অনুপযুক্ত। চীনা পক্ষের মনে রাখা উচিত যে ভারত একটি প্রাণবন্ত গণতন্ত্র এবং মাননীয় সাংসদরা জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে তাদের মতামত ও বিশ্বাস অনুযায়ী কার্যক্রম পরিচালনা করেন।”

তাছাড়া, ভারতে অবস্থানরত নির্বাসিত তিব্বত সরকারও চিঠির কড়া জবাব দিয়েছে। তাঁরা জানিয়েছে, “এটা স্পষ্ট যে বিশ্বজুড়ে তিব্বত আন্দোলনের প্রতি ক্রমবর্ধমান সমর্থন দেখে চীন ভয় পেয়েছে। নির্বাসিত তিব্বত সরকারকে চীন কখনোই জবাব দিতে পারে না। গত বছর প্রধানমন্ত্রী মোদি দালাই লামাকে তার জন্মদিনে আনুষ্ঠানিকভাবে শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন।”

এতে স্পষ্ট যে চীনের কর্তৃপক্ষ এসব চিঠি লেখার মাধ্যমে ভারতীয় প্রশাসনকে সতর্ক করতে কিংবা ভয় দেখাতে চেয়েছিলো। কিন্তু নতুন ধারার ভারত এই ভয়কে অস্বীকার করেছে। তবে চীনের চিঠি লেখার এই অভ্যেস বেশ পুরোনো। এর আগেও ২০২০ সালের অক্টোবরে চীনের দূতাবাসের পক্ষে ভারতীয় মিডিয়াগুলোতে চিঠি দেয়া হয়। এতে বলা হয়েছে, “আমরা আশা করি ভারতীয় মিডিয়া তাইওয়ান প্রশ্নে ভারত সরকারের অবস্থানে অটল থাকবে এবং এক-চীন নীতি লঙ্ঘন করবে না। বিশেষ করে, তাইওয়ানকে ‘দেশ (জাতি) হিসেবে উল্লেখ করা হবে না।”

একই রকমভাবে গত ২৩ অক্টোবর চীনের ন্যাশনাল পিপলস কংগ্রেসের স্থায়ী কমিটি নতুন স্থল সীমান্ত আইন অনুমোদন দিয়েছে। বার্তা সংস্থা সিনহুয়া জানিয়েছে, চীনের সার্বভৌমত্ব এবং আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষার উদ্দেশ্যে আগামী ১ জানুয়ারি থেকে ওই নতুন আইন কার্যকর হবে।

নতুন আইন অনুযায়ী চীনের স্থল সীমান্তের নিরাপত্তার পক্ষে ক্ষতিকর এমন কোনও পদক্ষেপের ইঙ্গিত পেলে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে সংঘাতে পথে হাঁটবে পিপলস লিবারেশন আর্মি (পিএলএ)। পাশাপাশি, সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে পরিকাঠামো, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এছাড়া প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে সীমান্ত সমস্যার দীর্ঘস্থায়ী সমাধানের নির্দেশিকা রয়েছে ওই আইনে।

চীনের নতুন স্থল সীমান্ত আইন নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে ভারত। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচি এক বিবৃতিতে বলেছেন, “নতুন আইন প্রণয়নের বিষয়ে চীনের একতরফা সিদ্ধান্ত বর্তমান দ্বিপাক্ষিক সীমান্ত ব্যবস্থাপনায় প্রভাব ফেলতে পারে। সীমান্ত সংক্রান্ত বিষয়ে যা আমাদের উদ্বেগের কারণ।”

উল্লেখ্য, ভারত, ভূটানসহ কয়েকটি দেশের সঙ্গে স্থলসীমান্ত চূড়ান্ত হয়নি চীনের। পূর্ব লাদাখে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা (এলএসি)-য় চীনা বাহিনীর আগ্রাসী আচরণের স্মৃতি এখনও ভারতীয়দের মনে টাটকা। এই পরিস্থিতিতে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বের নতুন পদক্ষেপের ‘লক্ষ্য’ নয়াদিল্লি বলেই মনে করছেন ভারতের সামরিক বিশ্লেষক এবং কূটনীতিবিদদের একাংশ।

ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, নিয়ন্ত্রণরেখায় শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে চীনের সঙ্গে সহমতের ভিত্তিতে একাধিক দিপাক্ষিক চুক্তি প্রোটোকল এবং ব্যবস্থাপনা হয়েছে। নয়াদিল্লির আশা, বেইজিংয়ের নতুন আইন প্রণয়নের একতরফা পদক্ষেপ সেগুলোর পরিপন্থী হয়ে উঠবে না।

তাছাড়া, বিশ্ব গণতন্ত্র সম্মেলন নিয়ে চীনের সমালোচনা, নিজ দেশে গণতন্ত্রের কোনো অস্তিত্ব না থাকলেও চীনা গণতন্ত্রকে বিশ্বের বৃহৎ গণতন্ত্র হিসেবে আখ্যা দেয়া, প্রতিবেশী দেশগুলোকে অনবরত চাপে রাখা সহ নানান পন্থা চীন ক্রমাগত অবলম্বন করে যাচ্ছে এবং সেগুলোকে বিশ্বব্যাপী প্রচারের বন্দোবস্তও করছে।

ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ক্ষেত্রেও চীন বিশ্বব্যাপী নিজ সেনাবাহিনীকে অপরাজেয় হিসেবে তুলে ধরার নীতি অবলম্বন করছে। বিশেষ করে গালওয়ান সীমান্তে নিজ সৈন্যদের হতাহতের বিবরণ গোপন করার মাধ্যমে চীনের এই নীতি প্রকাশ্যে চলে আসে। আর তাই এখন আমাদেরকেও চীনের এসব ভ্রান্ত নীতির মোকাবেলা করতে হবে শক্ত হাতে। মনস্তাত্ত্বিকভাবে পিছিয়ে না থেকে বরং এক ধাপ এগিয়ে চীনের মোকাবেলা করতে হবে। তবেই ব্যর্থ হবে চীনের তথ্য তথা সাইবার যুদ্ধের কৌশল।

লেখক: ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল এবং নিরাপত্তা বিষয়ক বিশেষজ্ঞ। (প্রকাশিত লেখনী ইন্ডিয়া নিউজ নেটওয়ার্ক থেকে গৃহীত। সম্পূর্ণ নিবন্ধ লেখকের নিজস্ব অভিমত)

ট্যাগ:

চীনের তথ্য যুদ্ধের কৌশল

প্রকাশ: ০৭:৪৯:০৮ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১০ জানুয়ারী ২০২২

মেজর জেনারেল (অবঃ) হর্ষ কাকর: বিশ্বজুড়ে ইন্টারনেটের প্রভাব বদলে দিচ্ছে সাধারণ মানুষের জীবনযাপন ও কাজের ধরণ! রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও তৈরী হচ্ছে বড় ধরণের সম্ভাবনা এবং হুমকির। সাইবার যুদ্ধ এখন আর কোন বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী নয়, ইতোমধ্যে এরকম হামলার শিকার হয়েছে বিশ্বের বহু রাষ্ট্র। আজকের এই লিখাটি চীনের সাইবার যুদ্ধের কৌশল নিয়ে। তাই পাঠকমহলকে নতুন কিছু সম্পর্কে ধারণা দিতে পারবো বলে আশা করি।

চীন সাধারণত নিজের শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধের ক্ষেত্রে প্রথমে মনস্তাত্ত্বিক লড়াইয়ে নেমে পড়ে। সাইবার মাধ্যম কাজে লাগিয়ে নিজ সেনাবাহিনীর প্রকৃত সক্ষমতা গোপন পূর্বক তা কয়েক গুণ বাড়িয়ে পেশ করে। পাশাপাশি প্রতিপক্ষের তথ্যসমূহ যথাসম্ভব সংগ্রহ করে আইনী যুদ্ধের এবং বিভ্রান্তি ছড়ানোর সুযোগ তৈরী করে। এতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই চীনের প্রতিপক্ষ রাষ্ট্রগুলো যুদ্ধের আগেই মনোবল হারিয়ে বসে!

সম্প্রতি বেশ কিছু পর্যবেক্ষণে বেরিয়ে আসে, চীন নিজেদের পিপলস লিবারেশন আর্মির প্রকৃত সক্ষমতা গোপন করতে পশ্চিমা চলচ্চিত্রের যুদ্ধের দৃশ্যগুলোকেও নিজ সেনাবাহিনীর ক্লিপ হিসেবে ব্যবহার করেছে। আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষকদের একজন আনশুল সাক্সেনা কিছুদিন পূর্বেই তাঁর টুইটার হ্যান্ডলে চীনা তথ্য যুদ্ধের ফটোগ্রাফ এবং তাদের উত্সগুলোর একটি সংগ্রহ পোস্ট করেছেন।

আনশুলের মতে, চীন নিজের সামরিক শক্তি বাড়িয়ে পেশ করার জন্যে টপগান, ট্রান্সফরমার, রক এবং হার্ড লকার সহ পশ্চিমা চলচ্চিত্রের ভিডিও এবং ফটোগ্রাফ ব্যবহার করেছে। চীনের নৌবাহিনী নিজ সক্ষমতা প্রদর্শন করতে গিয়ে রাশিয়ান এবং মার্কিন যুদ্ধজাহাজের ছবি প্রদর্শন করেছে। এতে সহজেই বুঝা যায় চীন মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধে জয়লাভ করতে কতোটা নিচে নেমে আসতে পারে!

এরকমই আরেকটি ভিডিও সম্প্রতি নতুন বছরের শুরুতেই সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ভিডিওতে দেখা যায়, চীনের সেনারা গালওয়ান ভূখন্ডে চীনা পতাকা উত্তোলন করছে। ভিডিওটি ভারতের অভ্যন্তরে তোলপাড় সৃষ্টি করে। রাজনীতিবিদদের মধ্যেও এ নিয়ে ভীষণ বচসা তৈরী হয়। কিন্তু পরবর্তীতে ব্যাপক অনুসন্ধানের মাধ্যমে প্রমাণিত হয় যে গোটা ভিডিওটি ভুয়া! চীন নিজ ভূখন্ডের অভ্যন্তরে কোথাও শ্যুটিং পূর্বক নকল ভিডিওটি তৈরী করেছে। এর জন্য পেশাদার অভিনেতা নিয়োগের অভিযোগও উঠে চীনের বিরুদ্ধে। ভারতীয় সেনাবাহিনী যখন গালওয়ান সীমান্তের অভ্যন্তরে নিজ পতাকা উত্তোলন পূর্বক পাল্টা ভিডিও প্রকাশ করে, তখন এর কোনো প্রত্যুত্তর চীন দিতে পারেনি। এ থেকে প্রমাণিত হয় চীন প্রকৃত যুদ্ধের পূর্বে নিজ শত্রুকে মনস্তাত্ত্বিকভাবে দূর্বল করতে যেকোনো পন্থা অবলম্বন করতে পারে।

সর্বশেষ অরুণাচল প্রদেশ নিয়েও এক ঘৃণ্য খেলায় মেতে উঠেছে চীনা কর্তৃপক্ষ। কিছুদিন আগে জানা গিয়েছিলো, অরুণাচল প্রদেশে আস্ত একটা গ্রাম বানিয়ে ফেলেছে চীন। এরপর দেখা গেলো অরুণাচলের ১৫ এলাকার নাম পাল্টে দিয়েছে চীন। গত ২৯ ডিসেম্বর অরুণাচলের ওই এলাকাগুলোর নাম বদলে দেয় চীন। চীনের সরকারি গণমাধ্যম গ্লোবাল টাইমসে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, জংনান (অরুণাচলের চীনা নাম) প্রদেশের ১৫ স্থানের নামকরণ করা হয়েছে। চীনা, তিব্বতি ও রোমান হরফে ওই নামকরণ করা হয়েছে। এই ১৫ স্থানের মধ্যে ৮টি জনবসতি, ৪টি পাহাড়, ২টি নদী ও একটি গিরিখাত আছে।

বেজিংয়ের এ কর্মকাণ্ডের তীব্র বিরোধিতাও করে ভারত। জানিয়ে দেয়া হয়, অরুণাচল ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। কেবল নতুন নাম দিয়ে ওই সত্য বদলে দেয়া যাবে না। এর আগেও ২০১৭ সালে অরুণাচল প্রদেশের ছয় স্থানের নাম বদল করেছিল চীন। চীনের দাবি, অরুণাচল দক্ষিণ তিব্বতের অংশ।

চীনের এ ধরনের কর্মকাণ্ডের তীব্র বিরোধিতা করে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচি জানিয়েছেন, “‌বিষয়টা জানতে পেরেছি। এর আগেও চীন অরুণাচল প্রদেশের নানা অংশের নাম বদলাতে চেয়েছে। ২০১৭ সালে এপ্রিল থেকে এ কাজ করে আসছে চীন। কিন্তু অরুণাচল প্রদেশ যে ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল এবং থাকবে, এ সত্যটা এভাবে নাম বদল করে পাল্টে দেয়া যাবে না।”

কিছুদিন পূর্বে ভারতের চীনা দূতাবাসের রাজনৈতিক কাউন্সিলর অল-পার্টি ইন্ডিয়ান পার্লামেন্টারি ফোরাম ফর তিব্বতের (এপিআইপিএফটি) কয়েকজন সদস্যকে চিঠি লিখেছিলেন, যারা গত ২২শে ডিসেম্বর, ২০২১ তিব্বতের নির্বাসিত সরকার কর্তৃক আয়োজিত একটি নৈশভোজে অংশ নিয়েছিলেন। চিঠিতে লিখা ছিলো, “আমরা লক্ষ্য করেছি আপনারা তথাকথিত তিব্বতের নির্বাসিত সরকার কর্তৃক আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন। আমি এ বিষয়ে আমাদের উদ্বেগ প্রকাশ করছি।”

এই চিঠিরও তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায় ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। দপ্তরের পক্ষে বলা হয়, “চিঠির উপাদান, স্বর এবং টেনার অনুপযুক্ত। চীনা পক্ষের মনে রাখা উচিত যে ভারত একটি প্রাণবন্ত গণতন্ত্র এবং মাননীয় সাংসদরা জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে তাদের মতামত ও বিশ্বাস অনুযায়ী কার্যক্রম পরিচালনা করেন।”

তাছাড়া, ভারতে অবস্থানরত নির্বাসিত তিব্বত সরকারও চিঠির কড়া জবাব দিয়েছে। তাঁরা জানিয়েছে, “এটা স্পষ্ট যে বিশ্বজুড়ে তিব্বত আন্দোলনের প্রতি ক্রমবর্ধমান সমর্থন দেখে চীন ভয় পেয়েছে। নির্বাসিত তিব্বত সরকারকে চীন কখনোই জবাব দিতে পারে না। গত বছর প্রধানমন্ত্রী মোদি দালাই লামাকে তার জন্মদিনে আনুষ্ঠানিকভাবে শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন।”

এতে স্পষ্ট যে চীনের কর্তৃপক্ষ এসব চিঠি লেখার মাধ্যমে ভারতীয় প্রশাসনকে সতর্ক করতে কিংবা ভয় দেখাতে চেয়েছিলো। কিন্তু নতুন ধারার ভারত এই ভয়কে অস্বীকার করেছে। তবে চীনের চিঠি লেখার এই অভ্যেস বেশ পুরোনো। এর আগেও ২০২০ সালের অক্টোবরে চীনের দূতাবাসের পক্ষে ভারতীয় মিডিয়াগুলোতে চিঠি দেয়া হয়। এতে বলা হয়েছে, “আমরা আশা করি ভারতীয় মিডিয়া তাইওয়ান প্রশ্নে ভারত সরকারের অবস্থানে অটল থাকবে এবং এক-চীন নীতি লঙ্ঘন করবে না। বিশেষ করে, তাইওয়ানকে ‘দেশ (জাতি) হিসেবে উল্লেখ করা হবে না।”

একই রকমভাবে গত ২৩ অক্টোবর চীনের ন্যাশনাল পিপলস কংগ্রেসের স্থায়ী কমিটি নতুন স্থল সীমান্ত আইন অনুমোদন দিয়েছে। বার্তা সংস্থা সিনহুয়া জানিয়েছে, চীনের সার্বভৌমত্ব এবং আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষার উদ্দেশ্যে আগামী ১ জানুয়ারি থেকে ওই নতুন আইন কার্যকর হবে।

নতুন আইন অনুযায়ী চীনের স্থল সীমান্তের নিরাপত্তার পক্ষে ক্ষতিকর এমন কোনও পদক্ষেপের ইঙ্গিত পেলে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে সংঘাতে পথে হাঁটবে পিপলস লিবারেশন আর্মি (পিএলএ)। পাশাপাশি, সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে পরিকাঠামো, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এছাড়া প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে সীমান্ত সমস্যার দীর্ঘস্থায়ী সমাধানের নির্দেশিকা রয়েছে ওই আইনে।

চীনের নতুন স্থল সীমান্ত আইন নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে ভারত। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচি এক বিবৃতিতে বলেছেন, “নতুন আইন প্রণয়নের বিষয়ে চীনের একতরফা সিদ্ধান্ত বর্তমান দ্বিপাক্ষিক সীমান্ত ব্যবস্থাপনায় প্রভাব ফেলতে পারে। সীমান্ত সংক্রান্ত বিষয়ে যা আমাদের উদ্বেগের কারণ।”

উল্লেখ্য, ভারত, ভূটানসহ কয়েকটি দেশের সঙ্গে স্থলসীমান্ত চূড়ান্ত হয়নি চীনের। পূর্ব লাদাখে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা (এলএসি)-য় চীনা বাহিনীর আগ্রাসী আচরণের স্মৃতি এখনও ভারতীয়দের মনে টাটকা। এই পরিস্থিতিতে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বের নতুন পদক্ষেপের ‘লক্ষ্য’ নয়াদিল্লি বলেই মনে করছেন ভারতের সামরিক বিশ্লেষক এবং কূটনীতিবিদদের একাংশ।

ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, নিয়ন্ত্রণরেখায় শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে চীনের সঙ্গে সহমতের ভিত্তিতে একাধিক দিপাক্ষিক চুক্তি প্রোটোকল এবং ব্যবস্থাপনা হয়েছে। নয়াদিল্লির আশা, বেইজিংয়ের নতুন আইন প্রণয়নের একতরফা পদক্ষেপ সেগুলোর পরিপন্থী হয়ে উঠবে না।

তাছাড়া, বিশ্ব গণতন্ত্র সম্মেলন নিয়ে চীনের সমালোচনা, নিজ দেশে গণতন্ত্রের কোনো অস্তিত্ব না থাকলেও চীনা গণতন্ত্রকে বিশ্বের বৃহৎ গণতন্ত্র হিসেবে আখ্যা দেয়া, প্রতিবেশী দেশগুলোকে অনবরত চাপে রাখা সহ নানান পন্থা চীন ক্রমাগত অবলম্বন করে যাচ্ছে এবং সেগুলোকে বিশ্বব্যাপী প্রচারের বন্দোবস্তও করছে।

ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ক্ষেত্রেও চীন বিশ্বব্যাপী নিজ সেনাবাহিনীকে অপরাজেয় হিসেবে তুলে ধরার নীতি অবলম্বন করছে। বিশেষ করে গালওয়ান সীমান্তে নিজ সৈন্যদের হতাহতের বিবরণ গোপন করার মাধ্যমে চীনের এই নীতি প্রকাশ্যে চলে আসে। আর তাই এখন আমাদেরকেও চীনের এসব ভ্রান্ত নীতির মোকাবেলা করতে হবে শক্ত হাতে। মনস্তাত্ত্বিকভাবে পিছিয়ে না থেকে বরং এক ধাপ এগিয়ে চীনের মোকাবেলা করতে হবে। তবেই ব্যর্থ হবে চীনের তথ্য তথা সাইবার যুদ্ধের কৌশল।

লেখক: ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল এবং নিরাপত্তা বিষয়ক বিশেষজ্ঞ। (প্রকাশিত লেখনী ইন্ডিয়া নিউজ নেটওয়ার্ক থেকে গৃহীত। সম্পূর্ণ নিবন্ধ লেখকের নিজস্ব অভিমত)


Fatal error: Uncaught wfWAFStorageFileException: Unable to save temporary file for atomic writing. in /home/nabajugc/public_html/wp-content/plugins/wordfence/vendor/wordfence/wf-waf/src/lib/storage/file.php:34 Stack trace: #0 /home/nabajugc/public_html/wp-content/plugins/wordfence/vendor/wordfence/wf-waf/src/lib/storage/file.php(658): wfWAFStorageFile::atomicFilePutContents('/home/nabajugc/...', '<?php exit('Acc...') #1 [internal function]: wfWAFStorageFile->saveConfig('livewaf') #2 {main} thrown in /home/nabajugc/public_html/wp-content/plugins/wordfence/vendor/wordfence/wf-waf/src/lib/storage/file.php on line 34