মেজর জেনারেল (অবঃ) হর্ষ কাকর ।। ইন্ডিয়া নিউজ নেটওয়ার্ক: সম্প্রতি নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন তেহরিক-ই-লাব্বায়েক পাকিস্তান -টিএলপির সঙ্গে চুক্তিতে পৌঁছেছে ইমরান খানের সরকার। এর মধ্য দিয়ে অবসান হচ্ছে টিএলপির দশ দিনের বিক্ষোভের। গত রোববার (৩১ অক্টোবর) এক সংবাদ সম্মেলনে চুক্তির কথা প্রকাশ করলেও বিস্তারিত কিছু জানানো হয়নি পাক সরকারের তরফে।
টিএলপির সাথে এই আলোচনায় অংশ নেন পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কোরেশি এবং ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রী মুফতি মুনিবুর রেহমান। সপ্তাহখানেকের মধ্যে এই চুক্তি নিয়ে বিস্তারিত জাতির সামনে তুলে ধরা হবে বলে জানান তারা। চুক্তিতে টিএলপি নেতা সাদ রিজভির অনুমোদন রয়েছে বলেও জানান নেতৃদ্বয়।
উল্লেখ্য, গতবছর ফ্রান্সবিরোধী বিক্ষোভের সময় গ্রেফতার হয়েছিলেন সাদ রিজভি। রিজভির মুক্তি ও ফরাসি রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কারের দাবিতে ২২ অক্টোবর লাহোর থেকে ইসলামাবাদ অভিমুখে ‘লং মার্চ’ শুরু করে হাজারো টিএলপি সমর্থক। পুলিশ-টিএলপি সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে এ পর্যন্ত সাত পুলিশ কর্মকর্তাসহ ১১ জন নিহত হয়েছে।
পরিস্থিতি এতোটাই ভয়াবহ হয়ে উঠেছিলো যে, টিএলপির সাথে পুলিশের সঙ্ঘাতের পর বিক্ষোভ দমনে মোতায়েন করা হয় রেঞ্জার্স সদস্যদের। পাক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মন্ত্রী শেখ রশিদ এর অনুরোধে ইতোমধ্যে মাঠেও নেমেছিলো তাঁরা। এমনকি টিএলপির দাবির প্রেক্ষিতে রশিদ টুইট করতে বাধ্য হোন যে, “যেখানে আমরা বলছি ফরাসী রাষ্ট্রদূত ইতোমধ্যে পাকিস্তান ছেড়েছেন, সেখানে আপনারা কেনো আমাদের কথা বিশ্বাস করছেন না?”
এদিকে, ফ্রান্স সূত্র আমাদের জানাচ্ছে, পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে দেশটিতে নতুন কোনো রাষ্ট্রদূতের নাম ঘোষণা করেনি তারা। পূর্ববর্তী রাষ্ট্রদূত স্বীয় মেয়াদ শেষ করে নিজ দেশের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছেন। কিন্তু পাক সরকার এটাকেই ভিন্ন ভাবে প্রচার করছে।
এছাড়া, টিএলপির কাছে মেশিনগান রয়েছে বলে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মহলের সকলেই জানেন। এটি পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ পরিবেশ নষ্ট করার ক্ষেত্রেও বড় ধরণের হুমকির উদ্রেক ঘটাতে পারে। কিন্তু তারপরও পাক সরকার তাদের ভয়ে টতস্থ হয়ে পড়ার মানে হচ্ছে সন্ত্রাসের কাছে নতি স্বীকার। অর্থাৎ, বলতে দ্বিধা নেই যে, পাকিস্তান সরকার নিজ দেশের অভ্যন্তরে শান্তি শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে।
ধারণা করি, ইমরানের সরকারের সঙ্গে টিএলপি এমন কোনো চুক্তি করেছে কিংবা করতে বাধ্য হয়েছে যা প্রকাশ্যে এলে ইমরানের রাজনৈতিক মৃত্যু ঘটতে পারে কিংবা বিরোধীরা ধারালো অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারে সেই চুক্তির বিষয়বস্তু। সেজন্যেই হয়তো চুক্তির বিশদ বিবরণ প্রকাশ্যে নিয়ে আসা হচ্ছে না।
পাকিস্তানের বহুল প্রচারিত সংবাদপত্র দ্যা ডন এর সম্পাদকমন্ডলীর একজন, ফাহদ হুসেন লিখেছেন, “প্রতিবারই সরকারের নম্র আচরণ টিএলপিকে উগ্র হওয়ার সাহস দিয়েছে। অনেক বেশি হিংস্র হয়েছে তাঁরা। এই গোষ্ঠীটি তো তারাই যারা ২০১৭ সালেও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শহীদ খাকান আব্বাসির সরকারকে পিছু হটতে বাধ্য করেছিলো। আইএসআইকে নিজেদের মতো আচরণ করতে বাধ্য করেছিলো।”
এখানে আশ্চর্য রকম মজার বিষয় হচ্ছে, অতীতে এই টিএলপির কাছে নমনীয় হওয়ার অভিযোগ এনে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন জোরদার করে ইমরানের নেতৃত্বাধীন তেহরিক ই ইনসাফ।
এ কথা অলিখিত সত্য যে, টিএলপি আদতে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর দ্বারাই সমর্থিত একটি গোষ্ঠী যা নির্বাচিত সরকারকে চাপ দেয়ার জন্য ক্ষেত্রবিশেষে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। আর এজন্যেই আমরা দেখতে পারি, যদিও ইমরানের নেতৃত্বাধীন সরকার টিএলপিকে নিষিদ্ধ সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করেছে, তথাপি তাদেরকে নির্বাচনে লড়াই করার অনুমোদন দেয়া হয়েছে।
পাকিস্তানের অনেকেই দাবি করেন ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ টিএলপির পৃষ্ঠপোষকতা করে থাকে। আদতে যার প্রমাণ কোনোদিনই তাঁরা দিতে পারেনি কিংবা পারবেও না। অসত্য দাবি শেষ পর্যন্ত মুখ থুবড়েই পড়ে। পড়তে বাধ্য হয়।
আমরা সম্প্রতি দেখতে পাচ্ছি, পাকিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলে তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) এবং নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ বাড়ছে। নিষিদ্ধ সংগঠনটি সম্প্রতি তাদের নেতা মুফতি নূর ওয়ালি মেহসুদের একটি ছবি পোস্ট করেছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে তিনি পূর্ব আফগানিস্তানের ডুরান্ড লাইনের ওপারে বিভিন্ন ক্যাম্পে যোদ্ধাদের পরিদর্শন করছেন।
শুরু থেকেই পাকিস্তানের পশ্চিম সীমান্ত বরাবর একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করতে চায় টিটিপি। সেখানে শরীয়া আইনের প্রয়োগ ঘটানোর অঙ্গীকার করেছে তাঁরা। সম্প্রতি কাবুল সফরের সময়, তৎকালীন আইএসআই প্রধান ফয়েজ হামিদ তালেবান সরকারকে অনুরোধ করেছিলেন যেনো সেখানকার ভূখন্ড ব্যবহার করে টিটিপি কোনো কার্যক্রম পরিচালনা না করতে পারে।
কিন্তু পাকিস্তানের এই দাবি প্রকাশিত হওয়ার পরই পাক সেনাদের লক্ষ্য করে একের পর এক হামলা করে চলেছে টিটিপি। এখনও অবধি প্রায় আটজন পাক সেনা নিহত হবার খবর এসেছে। বস্তুত, টিটিপি আফগান তালেবান এবং হাক্কানি নেটওয়ার্ক –উভয়ের সঙ্গেই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে।
ওদিকে, বেলুচিস্তান ইস্যুতেও কোনঠাসা হচ্ছে পাকিস্তান। পাকিস্তানেই ঘাঁটি গেড়ে বসা জঙ্গী সংগঠনগুলো এখন বেলুচ ময়দানেও নিজেদের প্রসার বাড়াতে উদ্যত। দিনকে দিন হামলা বাড়ছে গোটা অঞ্চল জুড়ে। চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর বরাবর বেশ কিছু হামলার খবর ইতোমধ্যে আমাদের কানে এসেছে। নিরাপত্তা ইস্যু প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে অত্র এলাকায়।
আফগান তালেবানরা ক্ষমতা দখলের পূর্ব অবধি পাকিস্তান এসব কাজের জন্য ঢালাওভাবে ভারতকে দোষারোপ করতো। পাক পররাষ্ট্রমন্ত্রী তো বেশ কয়েকবারই আফগানিস্তানের ভারতীয় কনস্যুলেটগুলোকে এসব সমস্যার ইন্ধনদাতা হিসেবে দায়ী করেছেন। টেলো নিউজের সাক্ষাৎকারেও তিনি এটা জানিয়েছিলেন। এমনকি আফগান ভূখন্ড ব্যবহার করে ভারত পাকিস্তানে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড চালাচ্ছে, এমন হাস্যকর দাবিও করেন তিনি।
কিন্তু বর্তমানে গোটা অঞ্চলজুড়ে ভারতের উপস্থিতি শুন্যের কোটায়। আফগানিস্তান ছেড়েছে ভারত, তাও প্রায় দু মাস পেরিয়ে গেছে। কিন্তু এখনও যেহেতু এসব সমস্যা অব্যহত রয়েছে, তার মানে নিশ্চয়ই পাকিস্তানের সমীকরণে গড়মিল রয়েছে।
এদিকে, ইসলামাবাদের জন্য বড় একটি সমস্যা হচ্ছে, তাঁরা এসব সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের জন্য বর্তমান আফগান তালেবানকেও ঢালাওভাবে দায়ী করে বিবৃতি দিতে পারছে না। কেননা বৈশ্বিক জনমত উপেক্ষা করে তারাই ঢাকঢোল পিটিয়ে আফগানিস্তানের মসনদে তালেবানকে বসিয়েছে। এমন অবস্থায় হয়তো নিজের গাল নিজেই পেটাচ্ছে পাক সামরিক কর্তাগণ।
যেকোনো আভ্যন্তরীণ ইস্যুতে ভারতকে টেনে আনা এবং ভারতকে দোষারোপ করা পাকিস্তানের পুরোনো অভ্যেস। পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান থেকে আরম্ভ করে হালের ইমরান অবধি সকলেই এই পন্থা মেনে এগিয়েছেন। ভারতকে দোষারোপের আপ্ত বাক্য মেনে তাঁরা নিজেদের দূর্বলতা ঢাকার চেষ্টা করে গিয়েছেন অনবরত। কিন্তু এসব করতে গিয়ে পাকিস্তান আদতে নিজেদের কবর নিজেরাই খুড়ে নিয়েছেন। এজন্যেই টিএলপির মতো সংগঠনগুলো মাথা চাড়া দেয়ার সাহস পায়।
এসব সমস্যার পাশাপাশি পাকিস্তান জুড়ে দেখা দিয়েছে চরম মুদ্রাস্ফীতি। এসবের জন্য ক্ষোভ আরও বাড়ছে। সৌদীর নিকট থেকে বিশাল অঙ্কের ঋণ সত্ত্বেও দক্ষিণ এশিয়ার সর্বোচ্চ মুদ্রাস্ফীতির দেশ পাকিস্তান। বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের হারও আশঙ্কাজনক সেখানে। এসব ইস্যু ঢাকতেও ইমরান আভ্যন্তরীণ সমস্যা দূরে রাখার নীতি নিয়েছেন। ফলস্বরূপ, মদীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যে প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়েছিলেন নিজের নির্বাচনী ইশতেহারে, সেটা কেবল স্বপ্ন না, অলীক কল্পনায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে পাকিস্তানীদের জন্য।
এমতাবস্থায়, পাকিস্তানের বিরোধী জোটগুলো একাট্টা হচ্ছে। পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট (পিডিএম) এবং ভুট্টোর নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) রক্তের গন্ধ পেতে শুরু করেছে। ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতির প্রতিবাদে রাজপথে নেমেছে তাঁরা। বিক্ষোভ চলছে সারা দেশ জুড়েই।
আর এসব অস্থিরতার মাঝেও পাক সেনাবাহিনীর চোখ রাঙানী তো রয়েছেই। সম্প্রতি আইএসআই এর নতুন ডিজি নিয়োগ নিয়েও মতপার্থক্য তৈরী হয়েছে পাক প্রধানমন্ত্রী এবং সেনাপ্রধানের মধ্যে। ফলস্বরূপ টিএলপির সঙ্গে সরকারের সমঝোতা তৈরীতে কোনো পদক্ষেপই নেয়নি সেনাবাহিনী। তাই আভ্যন্তরীণ এক বাড়তি চাপে পড়েছেন ইমরান খান।
সুতরাং বলাই যায়, আভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীলতার অন্ধকার সময়ের দিকে যাচ্ছে পাকিস্তান। আর এমনটা যদি ঘটে, তবে তা গোটা উপমহাদেশের জন্যেই কল্যাণ বয়ে আনবেনা। আর এর সবথেকে বড় দূর্ভোগ পোহাতে হবে ভারতকে।
এমন ভয়াল দূর্যোগ থেকে রক্ষা পেতে এখন কেবল মাত্র চলমান টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে জয়ী হওয়ার প্রার্থনাই করতে হবে ইমরান সরকারের আমলাদের। তবেই দেশের জনগণের সকল রাগ, ক্ষোভ এবং হতাশা মুহূর্তে আনন্দে পরিণত হবে। নতুবা কঠিন বিপদ অপেক্ষা করছে পাক সরকার ও জনগণের জন্যে।
লেখক: ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল, কৌশলগত কূটনীতি এবং নিরাপত্তা বিষয়ক বিশেষজ্ঞ। (প্রকাশিত লেখনী সম্পূর্ণই তাঁর নিজস্ব অভিমত)