নিজস্ব প্রতিবেদক: সম্প্রতি জাবি ৩০ ব্যাচের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী শামীম আহমেদ দুলুর উপর দুর্ব্যবহার ও যৌন হেনস্তার অভিযোগ এনে ফেসবুকে প্রমাণ সহ একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন জাবির একই ব্যাচের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী শামীমা আহমেদ।
গত ০১ জুলাই, ২০২০, শামীমা আহমেদ তার ফেসবুক ওয়ালে প্রমাণ হিসেবে কিছু ছবি সহ একটি বিস্তারিত বর্ণনা পোস্ট করেন। সেখানে তিনি দুলুর দুর্ব্যবহার, যৌন হেনস্তার হুমকি এবং অহেতুক সম্মানহানির অভিযোগ করেন।
তার ফেসবুক স্ট্যাটাসটি হুবহু তুলে ধরা হলো,
“আমি ২০১০ সালে বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় ৪৭ হাজার টাকা বেতন পেতাম। সেই ধারাবাহিকতায় চলতে চলতে বর্তমানে আমার বেতন কতো এবং তা আমার জীবন-জীবিকা নির্বাহের জন্য পর্যাপ্ত কী না, তা নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না! নিচে এ সম্পর্কে বিস্তারিত উল্লেখ করবো।
অপরদিকে, মহামারীর প্রকোপে এ বছরই মাসিক ২৫ হাজার টাকা বেতনের চাকুরী হারানো জাবি ৩০ ব্যাচের এক কুলাঙ্গার, যাকে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকেই একজন মাদকসেবী এবং ড্রাগ ডিলার হিসেবে জানতাম, সে আমাকে তার কাজের লোক হিসেবে রাখবে বলে হুমকি দিচ্ছে!
ঢাকা শহরের একটি ফ্ল্যাটে মাসে ১২ হাজার টাকা ভাড়া করে থাকা এই লোকটি গত কয়েক মাসে নিজের ঘরের আসবাবপত্র বিক্রি করে করে বাড়ি ভাড়া বহন করছেন বলে তার ফ্ল্যাটের মালিকের থেকে জানতে পারলাম! আর এই লোকটিই আমাকে তার কাজের লোক বানাতে চায়! আমার বড় বোনের সাথে রাত কাটানোর স্বপ্ন দেখে!
গত বছর দেশ থেকে আমার দুটো বইয়ের প্রয়োজন ছিলো এবং বইগুলো চেয়ে ফেসবুকে একটা পোস্ট করেছিলাম যে, আমার ফেসবুক বন্ধু তালিকার কেউ চাইলে আমাকে সাহায্য করতে পারেন! তখন এই জারজ শামীম আহমেদ দুলু আমাকে নক দেন এবং বইগুলো আমার অবধি পৌছাতে তিনি ৩৮০০ টাকা ব্যয় করেছিলেন।
বইগুলো সংগ্রহ করতে ড. ইমতিয়াজ আহমেদের অফিসে যেতে হতো। দুলু সেখানে যাবার আগেই আমি তাঁকে বললাম আমাকে তার একটি ব্যাংক একাউন্ট কিংবা বিকাশ নাম্বার দিতে যেনো আমি তাঁকে যাবতীয় খরচা পাঠাতে পারি।
তখন সে আমাকে উত্তরে জানালো যে বন্ধু হিসেবে সে এই খরচাটুকু বহন করতে ইচ্ছুক এবং সক্ষম। তারপরও আমি তাকে টাকাটা ফেরত দিতে চাই এবং সেই উদ্দেশ্যে তার এবং আমার সঙ্গে মিউচুয়াল কমপক্ষে ০৭ জনের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। তাঁদের সবাইকে পুরো ঘটনার ব্যখ্যা দিয়েছি। আর সবাই আমাকে একই উত্তর দিয়েছে যে যদি জারজটা টাকাটা না নিতে চায়, তাহলে এটা নিয়ে আর ঘাটাঘাটি না করাই ভালো হবে। তাই আমিও হাল ছেড়ে দিয়েছি। এমন একটা ইস্যুতে সময় নষ্ট করার মতো সময় আমার কাছে মোটেও নই।
বর্তমানে আমি একজন আর্থিক বিশ্লেষক হিসেবে কর্মরত রয়েছি। সপ্তাহে প্রায় ২০ ঘন্টা, মাসে প্রায় ৮০ ঘন্টার মতো কাজ করছি এবং প্রতি ঘন্টার জন্য ২৪ পাউন্ড করে বেতনও পাচ্ছি। ১৪০০ পাউন্ড আমি বাড়ি ভাড়া দিচ্ছি, বাদ বাকি লাইফস্টাইল নাইবা বললাম। সেখানে তার ৩৮০০ টাকা বকেয়া রাখার নিশ্চয়ই কোনো মানে আমার কাছে নেই? তাইনা?
আমার পুরো জীবনে কেউ আমাকে বলতে পারবেনা যে আমি অন্য কারুর পয়সায় এক কাপ চা অবধি খেয়েছি, তা সে আমার আপন ভাই বোন থেকে আরম্ভ করে কাজিন, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, প্রতিবেশি যেই হোন না কেনো! এমনকি আমার সঙ্গে রিক্সায় চড়া কাউকে কোনোদিন এক পয়সার রিক্সাভাড়া অবধি দিতে দিইনি। তাহলে এই বেজন্মার ৩৮০০ টাকা আমি কেনো দিবো না?
যাহোক, জারজটা প্রায়ই আমাকে কল দিতো, খোঁজ খবর নিতো। আমিও তার প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বরূপ সেসবের জবাব দিতাম এবং খোঁজ খবর নিতাম। কিন্তু বই পাঠানোর প্রায় ছ মাস পরের ঘটনা! একদিন মদপ্য অবস্থায় হঠাত সে আমাকে ফোন দিয়ে বলতে লাগলো যে সে আমাকে তার বিছানায় মিস করছে! এটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমি তাঁকে ফেসবুক, মেসেঞ্জার সহ যাবতীয় সব ধরণের কোন্টাক্ট লিস্ট থেকেই ব্লক দিই, কেননা কখনোই আমি এমন নোংরামোকে প্রশ্রয় দিইনি।
কিন্তু কিছুদিন পর আমি তার চাকুরী হারানোর খবরটি শুনলাম। আমার মনে হলো আমার প্রতি তার ঋণ শোধ করা প্রয়োজন, পূর্বেই যা উল্লেখ করেছি। তাই তাকে আমি ফেসবুকে আনব্লক করে আবার রিকুয়েস্ট পাঠাই এবং তাঁকে মেসেজে বলি যে, তোমার একাউন্ট নাম্বারটা আমাকে দাও, আমি কিছু টাকা পাঠাচ্ছি, এরপর আমাকে সেই টাকা দিয়ে একটা ক্যারম বোর্ড কিনে পাঠানোর ব্যবস্থা করো!
এটা মূলত করেছিলাম কেননা যেহেতু আমি জানতাম সে চাকুরী হারিয়েছে, তাই সে তার একাউন্ট নাম্বারটি দিবে বলে বিশ্বাস ছিল আর এই সুযোগে আমি তাকে তার পাওনাটা বুঝিয়ে দিতে পারতাম! এরপর যোগাযোগ বন্ধ করে দিতাম! নাহলে এই মহামারীতে বসে ক্যারম খেলার মতো মানসিকতা নিশ্চয়ই নেই আমার! আমার আশেপাশের সবাই মোটামুটি জানেন মহামারীর শুরু থেকেই আমি আমার সামর্থ্য মতো এখনও দেশে অসহায়দের সাহায্য করছি!যাকগে তখনও তার সাড়া পাওয়া যায়নি। কিন্তু গতকাল বাংলাদেশ সময় রাত সাড়ে নয়টায় হঠাত করেই জারজটা আমাকে ফোন দিলো এবং ফোনেই খারাপ কথা বলা আরম্ভ করলো! ফোনেই সে আমাকে চোর, প্রতারক ইত্যাদি বলে গালাগাল করতে লাগলো এই মর্মে যে আমি তাঁকে গত বছর আমার প্রতি করা তার সাহায্যের জন্য অর্থ পরিশোধ করিনি।
গতকালই প্রথম জারজটা ফোনেই গালাগালের সময় বলছিলো যে তার নাম্বারটিই একটা নগদ একাউন্ট। আমি কালক্ষেপণ না করে রাতের বেলাতেই তাকে টাকাটা পাঠানোর জন্য একজন নগদ একাউন্ট পরিষেবা প্রদানকারীকে খুজতে থাকি কিন্তু পাইনি! আজকে সকালেই তার ওই একাউন্টে আমি ৫ হাজার ৭৫ টাকা পাঠিয়ে দিয়েছি। কিন্তু এতো কিছুর পরও লোকটা আমাকে পাবলিক পোস্টে এসে বাজে মন্তব্য করেই চলেছে।
আমি আমার পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড, আমার নিজের চরিত্র, মনোভাব এবং আমার একাডেমিক ও প্রফেশনাল ক্যারিয়ার সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন ও আত্মবিশ্বাসী। তাই আমি এই লজ্জাজনক ঘটনাটা প্রমাণ সহ পাবলিক করলাম, সবার সম্মুখে নিয়ে এলাম। আমার সকল ব্যাচমেট, বন্ধুবান্ধব, সিনিয়র-জুনিয়ার সবাই আমাকে খুব ভালো করে চিনেন এবং জানেন। তাই এই হ্যারেসমেন্টের ঘটনাটি পাবলিক করতে আমি কোনো ইমেজ সংকটে ভুগছি না।
এই কুলাঙ্গার থেকে অনবরত হ্যারেসমেন্টের শিকার হয়ে এক পর্যায়ে আমি নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারিনি এবং তার ভাষাতেই কমেন্টগুলোর উত্তর দিই। আমরা সবাই জীবনে ভালো এবং মন্দ দুই দিকটাই শিখি। তাই আমি জানি যে আমি কাজটি ঠিক করেছি এবং কোথায় কী ভাষার প্রয়োগ করতে হয়। আর এই আত্মবিশ্বাসটাই আমাকে ইনবক্সের আলোচনাকেও প্রকাশ্য পাবলিক করতে উৎসাহ দিয়েছে।
প্রতিটা গল্পেরই একটা শিক্ষা এবং নৈতিকতা বোধ থাকে। আর উপরের পুরো ঘটনাটির শিক্ষণীয় দিকটি হলো, আমাদের ব্যবহার এমন এক আয়না যা আমাদের পারিবারিক স্ট্যাটাস, ব্যাকগ্রাউন্ড, ব্যাক্তিত্ব, সাফল্য এবং ব্যর্থতার রূপায়ন করে।
আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছদ্মবেশি এই লোকদেরকে অবশ্যই চিহ্নিত করা প্রয়োজন এবং তাঁদের থেকে যেকোনো সাহায্য নেবার পূর্বে শতবার ভাবা প্রয়োজন। মনে রাখবেন, ধর্ষণকারীরা কেবল শারীরীকভাবেই নয়, সম্ভাব্য সকল উপায়ে একটি সমাজকে ধর্ষণ করে।”
তার ফেসবুক স্ট্যাটাসের লিঙ্কটি, https://www.facebook.com/shamima.ahmed.963/posts/10163655300090153
পোস্টে অভিযুক্তের ছবি, স্ক্রিনশট সহ যাবতীয় সব কিছুর উল্লেখ রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে, শামীমা আহমেদ নবযুগ প্রতিনিধিকে জানান,
“আমি ২০১৩ থেকেই উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের নিমিত্তে দেশের বাইরে রয়েছি। সম্প্রতি গত বছর দেশ থেকে আমার দুটো বই আনার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। তখন ফেসবুকে একটি উন্মুক্ত পোস্ট করি যে, কেউ চাইলে বইগুলো দিয়ে আমায় সহযোগিতা করুন। তখন এই দুলু আমাকে বইগুলো পাঠাতে সাহায্য করে এবং আমি তাকে বারবার বারংবার যাবতীয় খরচা (৩৮০০ টাকা) পাঠানোর জন্য তার ব্যাংক একাউন্ট নাম্বার/বিকাশ নাম্বার চাইতে থাকি! কিন্তু তখন সে এই টাকা নিবে না, নিবেই না বলে বারবার ব্যাপারটি এড়িয়ে যায় এবং বন্ধু হিসেবে সে কাজটি করেছে বলে প্রকাশ করতে থাকে।””
কিন্তু এভাবে ঋণী হয়ে থাকার কোনো ইচ্ছে তার ছিলো না বলে জানান শামীমা আহমেদ। তার ভাষায়,
“” যখন সে কোনোভাবেই টাকা ফেরত নিবেই না, তাকে টাকাগুলো ফেরত দেয়ার জন্য আমি আমাদের মিউচুয়াল কিছু বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করি যেনো তার নাম্বারটি যোগাড় করতে পারি। কিন্তু বন্ধুরাও তখন আমায় জানায় যে যদি দুলু টাকা নিতে না-ই চায়, তাহলে যেনো আমিও ব্যাপারটি ভুলে যাই! এই কথাগুলোর প্রমাণও কিন্তু রয়েছে আমার কাছে, যা আমি আমার স্ট্যাটাসেও উল্লেখ করেছি!”
দুর্ব্যবহার এর প্রসঙ্গে শামীমা বলেন,
“এরপর প্রায়ই দুলু নক দিয়ে খোজ খবর জানতে চাইতো। আমিও বন্ধু হিসেবে সে খোজ খবর তাকে দিতাম, তার খবরাদি নিতাম। কিন্তু হঠাত একদিন সে আমাকে ফোন দিয়ে আমাকে বাজে কথা বলতে থাকে এবং আমি সাথে সাথে তার সঙ্গে সব ধরণের যোগাযোগ বন্ধ করে দিই, তাকে ব্লক করে দিই।”
এরপরের ঘটনা বলতে গিয়ে শামীমা জানান,
“হঠাত একদিন কোনো মারফতে আমি জানতে পারলাম সে করোনায় চাকুরি হারিয়েছে। বাসার জিনিসপত্র বিক্রি করে বাড়ি ভাড়া দিচ্ছে, খুব কষ্টে দিন যাপন করছে। আমার মনে হয়েছিলো তখন তাকে তার পাওনাটা বুঝিয়ে দিলে তার উপকার হতো! এরপর বাদবাকি বিস্তারিত তো স্ট্যাটাসে এবং সেখানে যুক্ত স্ক্রিনশটে দেয়া আছে। আমি যেখানে লাখ টাকার উপর আয় করছি, অগুনতি মানুষকে দেশে হেল্প করছি নিজের মতো করে, সেখানে সে আমাকে চোর অপবাদ দিচ্ছে, আমায় নিয়ে অশ্লীল মন্তব্য করেছে, আমার বড় বোন-পরিবার জড়িয়ে যৌন হেনস্তার মতো হুমকি দিয়েছে! আমি এর জবাব চাই। এ ধরণের বাজে মানসিকতার লোকগুলো আমাদের দেশে পাড় পেয়ে যায় বলেই পরবর্তীতে ধর্ষণের মত ঘটনা ঘটে।”
সবশেষে তার করা ফেসবুক পোস্টটি নিয়ে শামীমা বলেন,
“আমি আমার পোস্ট এবং অভিযোগ সম্পর্কে আমাদের সিনিয়র-ব্যাচমেট শিক্ষার্থীদের অবহিত করেছি এবং তাদের কারুর কারুর ফেসবুক ওয়ালেও পোস্টটি রয়েছে। এদিকে, আমার বাংলা ও ড্রামাটিকস বিভাগের কিছু ব্যাচমেট, বন্ধু পোস্টখানা ফেসবুক থেকে সরিয়ে নিতে বারংবার অনুরোধ করছেন। তবে আমি সাফ জানিয়ে দিয়েছি, যদি দুলু নিঃশর্তভাবে এই হেনস্তার জন্য ক্ষমা চায়, তাহলে আমি ক্ষমা করে দিবো এবং অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্য নিজের দুঃখ প্রকাশ করবো।”
এ বিষয়ে অভিযুক্ত দুলুর সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়ে উঠেনি। তবে জানা গিয়েছে, চাকুরী হারিয়ে তিনি বর্তমানে ঢাকা ছেড়ে ঠাকুরগাওয়ে গ্রামের বাড়ি অবস্থান করছেন।