Notice: Undefined index: custom_code in /home/nabajugc/public_html/wp-content/themes/NewsFlash-Pro/header.php on line 27
Dhaka 6:02 pm, Sunday, 1 October 2023

  • Notice: Trying to access array offset on value of type int in /home/nabajugc/public_html/wp-content/themes/NewsFlash-Pro/template-parts/page/header_design_two.php on line 68

বাংলাদেশের বনাঞ্চলের দূরাবস্থা ও বসতবাড়িতে কৃষি বনায়ন

  • Reporter Name
  • Update Time : 04:57:53 am, Monday, 27 April 2020
  • 4 Time View

সাজিবুল আনাম পরাগ: ‘অরণ্য’ বা ‘বন’ শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘ফরেস্ট’। কোনো অঞ্চলের জীনগত সম্পদের সবচেয়ে বড় আধার হচ্ছে বনভূমি। একটি দেশের প্রাকৃতিক, পরিবেশগত ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অনেকাংশেই সেই দেশের বনাঞ্চলের উপর নির্ভরশীল। বলা হয়ে থাকে, কোনো অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য এবং প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য মোট আয়তনের কমপক্ষে ২৫% বনভূমি থাকা প্রয়োজন। বনভূমির পরিমাণ ২৫% এর কম হলে আবহাওয়া, জলবায়ু, প্রাকৃতিক ভারসাম্য ও জীববৈচিত্র্য বিঘ্নিত হয়। সরকারি হিসাবে বাংলাদেশে যদিও বনের আয়তন ১৫ থেকে ১৬% কিন্তু বেসরকারি হিসাবে এই পরিমাণ ১০% বা তারও কম।

ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা ও বনভূমি উজাড় বিবেচনার নিরিখে বেসরকারি হিসাবই এ দেশের প্রকৃত বনাঞ্চলের দূরাবস্থার প্রতিফলন। গতবছর পরিবেশ বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচ থেকে প্রকাশিত বিশ্বের বনভূমি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০১ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে বাংলাদেশের ৩ লাখ ৭৮ হাজার একর বনভূমি উজাড় হয়েছে, যা দেশের মোট বনভূমির প্রায় ৮ শতাংশ!

জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং আবাদযোগ্য জমির অন্য কোনো কাজে (যেমন নতুন বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, কলকারখানা নির্মাণ ইত্যাদি) ব্যবহার এর ফলে মানুষ বনের জায়গা দখলের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ফলে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে প্রতিনিয়তই বাংলাদেশের বনজসম্পদ ধ্বংস হচ্ছে এবং সেসঙ্গে কমে যাচ্ছে বনভূমির পরিমাণ। এতে নষ্ট হচ্ছে প্রাকৃতিক ভারসাম্য এবং জলবায়ুর উপর পড়ছে বিরূপ প্রতিক্রিয়া।  দেখা দিচ্ছে অতি বৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, খরা, বন্যা, সমুদ্রপৃষ্ঠের পানি বৃদ্ধি, উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা বৃদ্ধি প্রভৃতি নানা রকমের প্রতিকূলতা। ফলে আমাদের দেশে এই মূহুর্তে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্যের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি বনাঞ্চলের পরিমাণ বৃদ্ধি তথা বনাঞ্চল রক্ষা করা। এক্ষেত্রে বসতবাড়িতে কৃষি বনায়ন (এগ্রোফরেস্ট্রি) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

কৃষি বনায়ন বা এগ্রোফরেস্ট্রি বলতে বুঝায় একটি ভূমি ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি যেখানে বৃক্ষ, ফসল এবং পশুপাখিকে এমনভাবে সমন্বয়-একত্র করা হয় যাতে ভূমির সার্বিক ব্যবহার  এবং টেকসই ভূমি ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত হয়। বাস্তুসংস্থান ও অর্থনীতি এই দুইয়ের মাঝে মেলবন্ধনের কাজ করে কৃষি বনায়ন। কৃষি বনায়ন ধারণা অবশ্যই বৈজ্ঞানিকভাবে নিখুঁত, সামাজিকভাবে নির্ভরযোগ্য ও পরিবেশগতভাবে গ্রহণযোগ্য হতে হবে।

বৃক্ষ ও অন্যান্য বহু বর্ষজীবী কাষ্ঠল উদ্ভিদ, মৌসুমি অথবা একবর্ষজীবী কৃষিজাত উদ্ভিদ ফসল এবং পশুপাখি ও মৎস্য এই তিনটি প্রধান উপাদানের সমন্বয়ে মূলত কৃষি বনায়ন গড়ে উঠে। অর্থাৎ একই জমিতে একসাথে কাষ্ঠল উদ্ভিদ ও কৃষিজাত ফসল চাষ করা যায় এই পদ্ধতিতে। সাথে পশুপাখির খামার ব্যবস্থাপনাও নিশ্চিত করা যায়। ফলে আমাদের খাদ্যের চাহিদা মেটার পাশাপাশি, কাষ্ঠল গাছ তথা বন্যপ্রজাতির গাছ দেশে বনের চাহিদা মেটাতে অনেকাংশে ভূমিকা রাখতে পারে।

বসতবাড়িতে কৃষি বনায়ন বা জীবন নির্বাহ কৃষি বনায়ন হলো এগ্রোফরেস্ট্রির একটা ধারা। যেখানে বসতবাড়ির নির্দিষ্ট ভূখন্ডে – বনজ বৃক্ষ, ফলদ বৃক্ষ, শোভাবর্ধনকারী বৃক্ষ, অন্যান্য উদ্ভিদ, বৃক্ষ ফসল, উদ্ভিদ ফসল, গবাদিপশু, হাঁস-মুরগি, মৎস্য ইত্যাদির সমন্বয়ে সমন্বিত উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে উঠে। এর প্রধান লক্ষ্য থাকে- পরিবারের খাদ্যের চাহিদা মেটানো। এ লক্ষ্য বাস্তবায়ন সম্ভব হলে তা প্রকৃতপক্ষে দেশের সামগ্রিক বনাঞ্চল রক্ষায় ভূমিকা রাখতে পারে। কারণ বসতবাড়ির কৃষি বনায়ন পরিবারের চাহিদা মেটানোর জন্য খাদ্য উৎপাদনের ফলে বনাঞ্চল উজাড় করে কৃষি জমি বানানোর প্রয়োজন অনেকাংশে হ্রাস পায়। অপরপক্ষে, এই ব্যবস্থাপনায় বনজ উদ্ভিদ বসতবাড়ির জমিতে বেড়ে উঠায় তা কোনো দেশের সামগ্রিক বনভূমি বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখতে পারে। বাংলাদেশের প্রায় ৬৩.৪% লোক গ্রামে বাস করে (সূত্রঃ ব্রিটানিয়া ডট কম) এবং মোট বনভূমির প্রায় ১.৮৮% ভিলেজ ফরেস্ট (সূত্রঃ আরণ্যক ফাউন্ডেশন)। আমাদের দেশে গ্রামে বসবাসরত লোক বেশি হওয়ায়, গ্রামের বাড়ির আঙিনায় এই কৃষিজ বনায়ন সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলতে পারে। এতে ভিলেজ ফরেস্টের পরিমাণ বাড়বে, যা সামগ্রিক বনাঞ্চল এর পরিমাণ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখবে।

আমাদের দেশের গ্রামাঞ্চলের মুটামুটি প্রতিটা বসতবাড়িই কৃষি বনায়নের উপযুক্ত। কিন্ত যথাযথ পরিকল্পনা ও এগ্রোফরেস্ট্রি সম্পর্কে কারিগরি জ্ঞান না থাকায় তা আশানুরূপ কোনো ফল দিতে পারছে না। বাংলাদেশের কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) একটি বসত বাড়িতে কৃষি বনায়ন ধারা গড়ে তোলার লক্ষ্যে নিম্নলিখিত কিছু প্রধান দিক বিবেচনায় রাখার কথা বলে-

১. বসতবাড়ির চারপাশের সীমানায় বেড়া হিসেবে মান্দার, ভেরেন্ডা, পলাশ, জিগা ইত্যাদি উদ্ভিদ ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে বসতবাড়ির সীমানা নির্ধারণ ছাড়াও সুরক্ষার কাজও করবে।

২. বাড়ির আঙিনায় শাকসবজির চাষ করতে হবে।

৩. বসতবাড়ির আঙিনার ফাঁকা স্থানে আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, পেয়ারা, বেল, পেঁপে, নিম, বহেড়া, হরীতকী, তুলসী, সজিনা, নারিকেল, সুপারি, বকুল ইত্যাদি গাছ রোপণ করা যায়।

৪. বসতবাড়ির সীমানায় পুকুর থাকলে সেখানে বিভিন্ন ধরনের মাছের চাষ করতে হবে। পুকুরের পাড়ে বিভিন্ন ধরনের বৃক্ষরোপণ (নারিকেল, সুপারি, ইপিল-ইপিল, মেহগণি, খেজুর, কড়ই ইত্যাদি) করতে হবে। এতে গরমের সময় মাছের উপকার হয়। এখানে বেশি শিকড় বিশিষ্ট গাছ লাগালে পুকুরের পাড়ের মাটি ভাঙবে না।

৫. বিভিন্ন ছায়াসহ্যকারী উদ্ভিদ যেমন- আদা, হলুদ ইত্যাদি দুই বৃক্ষের মাঝে লাগতে হবে।

৬. বসতবাড়িতে যতটুকু সম্ভব গবাদিপশু-পাখি (হাঁস-মুরগি, কোয়েল, কবুতর, গরু, ছাগল, মৌমাছি ইত্যাদি) পালন করতে হবে।

৭. সর্বোপরি স্থান-অবস্থান, উদ্দেশ্য, প্রয়োজনীয়তা, সামর্থ্য, সহজ প্রাপ্যতা ইত্যাদি বিবেচনা করে বসতবাড়ির কৃষি বনায়ন ধারার উপাদানগুলো নির্বাচন করতে হবে এবং যথাযথ নিয়মে এর পরিচর্যা করতে হবে।

এই বসতবাড়িতে কৃষি বনায়ন ধারণারও অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তবুও পুরোপুরি না হলেও অনেকাংশে দেশের ক্রমশ ধ্বংস হতে থাকা বনাঞ্চল রক্ষায় এটি পরোক্ষ এবং প্রত্যক্ষভাবে ভূমিকা রাখতে পারে। গ্রামাঞ্চলের প্রায় ৮০% লোকের খাদ্যের চাহিদা বসতবাড়ির কৃষিজ বনায়ন থেকে মেটানো সম্ভব। খাদ্যের চাহিদা মেটানো সম্ভব হলে কৃষি জমির উপর চাপ হ্রাস পাবে, ফলে কলকারখানা ও বিভিন্ন শিল্প স্থাপন অধিকতর সহজ হবে৷ কৃষিজমি বা কারখানা স্থাপনের জন্য মানুষ বনাঞ্চল উজাড় করবে না। এটি হলো বনাঞ্চল রক্ষায় পরোক্ষ প্রভাব। অপরদিকে, এগ্রোফরেস্ট্রিতে কাষ্ঠল তথা ফলজ, বনজ উদ্ভিদ বসতবাড়ির আঙিনায় লাগানো হয় বলে তা প্রত্যক্ষভাবে সামগ্রিক বনভূমির পরিমাণ বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে।

বসতবাড়িতে কৃষি বনায়ন ধারণাকে ফলপ্রসূ করার জন্য নিম্ন লিখিত ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে-

১. এগ্রোফরেস্ট্রির সঠিক ধারণা প্রচার ও প্রসারের জন্য সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে আসতে হবে।

২. কৃষকদের বিশেষ ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করা।

৩. প্রতিটি গ্রামে তরুণদের নিয়ে কয়েক সদস্যের দল করা, যারা মাঠপর্যায়ে কৃষককে কারিগরি সহায়তা করবে।

৪. কৃষকদের বসতবাড়িতে কৃষি বনায়নে উৎসাহ বৃদ্ধি করার জন্য অল্প সুদে ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা করা।

৫. আধুনিক ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা।

৬. বসতবাড়িতে কৃষি বনায়ন জনপ্রিয় করে তুলার লক্ষ্যে গণমাধ্যম ও সোসাল মিডিয়ার সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা।

লেখক: সাজিবুল আনাম পরাগ, শিক্ষার্থী, ফরেস্ট্রি বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।

Tag :

Notice: Trying to access array offset on value of type int in /home/nabajugc/public_html/wp-content/themes/NewsFlash-Pro/template-parts/common/single_two.php on line 177

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

Popular Post

Notice: Undefined index: footer_custom_code in /home/nabajugc/public_html/wp-content/themes/NewsFlash-Pro/footer.php on line 87

বাংলাদেশের বনাঞ্চলের দূরাবস্থা ও বসতবাড়িতে কৃষি বনায়ন

Update Time : 04:57:53 am, Monday, 27 April 2020

সাজিবুল আনাম পরাগ: ‘অরণ্য’ বা ‘বন’ শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘ফরেস্ট’। কোনো অঞ্চলের জীনগত সম্পদের সবচেয়ে বড় আধার হচ্ছে বনভূমি। একটি দেশের প্রাকৃতিক, পরিবেশগত ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অনেকাংশেই সেই দেশের বনাঞ্চলের উপর নির্ভরশীল। বলা হয়ে থাকে, কোনো অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য এবং প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য মোট আয়তনের কমপক্ষে ২৫% বনভূমি থাকা প্রয়োজন। বনভূমির পরিমাণ ২৫% এর কম হলে আবহাওয়া, জলবায়ু, প্রাকৃতিক ভারসাম্য ও জীববৈচিত্র্য বিঘ্নিত হয়। সরকারি হিসাবে বাংলাদেশে যদিও বনের আয়তন ১৫ থেকে ১৬% কিন্তু বেসরকারি হিসাবে এই পরিমাণ ১০% বা তারও কম।

ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা ও বনভূমি উজাড় বিবেচনার নিরিখে বেসরকারি হিসাবই এ দেশের প্রকৃত বনাঞ্চলের দূরাবস্থার প্রতিফলন। গতবছর পরিবেশ বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচ থেকে প্রকাশিত বিশ্বের বনভূমি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০১ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে বাংলাদেশের ৩ লাখ ৭৮ হাজার একর বনভূমি উজাড় হয়েছে, যা দেশের মোট বনভূমির প্রায় ৮ শতাংশ!

জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং আবাদযোগ্য জমির অন্য কোনো কাজে (যেমন নতুন বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, কলকারখানা নির্মাণ ইত্যাদি) ব্যবহার এর ফলে মানুষ বনের জায়গা দখলের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ফলে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে প্রতিনিয়তই বাংলাদেশের বনজসম্পদ ধ্বংস হচ্ছে এবং সেসঙ্গে কমে যাচ্ছে বনভূমির পরিমাণ। এতে নষ্ট হচ্ছে প্রাকৃতিক ভারসাম্য এবং জলবায়ুর উপর পড়ছে বিরূপ প্রতিক্রিয়া।  দেখা দিচ্ছে অতি বৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, খরা, বন্যা, সমুদ্রপৃষ্ঠের পানি বৃদ্ধি, উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা বৃদ্ধি প্রভৃতি নানা রকমের প্রতিকূলতা। ফলে আমাদের দেশে এই মূহুর্তে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্যের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি বনাঞ্চলের পরিমাণ বৃদ্ধি তথা বনাঞ্চল রক্ষা করা। এক্ষেত্রে বসতবাড়িতে কৃষি বনায়ন (এগ্রোফরেস্ট্রি) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

কৃষি বনায়ন বা এগ্রোফরেস্ট্রি বলতে বুঝায় একটি ভূমি ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি যেখানে বৃক্ষ, ফসল এবং পশুপাখিকে এমনভাবে সমন্বয়-একত্র করা হয় যাতে ভূমির সার্বিক ব্যবহার  এবং টেকসই ভূমি ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত হয়। বাস্তুসংস্থান ও অর্থনীতি এই দুইয়ের মাঝে মেলবন্ধনের কাজ করে কৃষি বনায়ন। কৃষি বনায়ন ধারণা অবশ্যই বৈজ্ঞানিকভাবে নিখুঁত, সামাজিকভাবে নির্ভরযোগ্য ও পরিবেশগতভাবে গ্রহণযোগ্য হতে হবে।

বৃক্ষ ও অন্যান্য বহু বর্ষজীবী কাষ্ঠল উদ্ভিদ, মৌসুমি অথবা একবর্ষজীবী কৃষিজাত উদ্ভিদ ফসল এবং পশুপাখি ও মৎস্য এই তিনটি প্রধান উপাদানের সমন্বয়ে মূলত কৃষি বনায়ন গড়ে উঠে। অর্থাৎ একই জমিতে একসাথে কাষ্ঠল উদ্ভিদ ও কৃষিজাত ফসল চাষ করা যায় এই পদ্ধতিতে। সাথে পশুপাখির খামার ব্যবস্থাপনাও নিশ্চিত করা যায়। ফলে আমাদের খাদ্যের চাহিদা মেটার পাশাপাশি, কাষ্ঠল গাছ তথা বন্যপ্রজাতির গাছ দেশে বনের চাহিদা মেটাতে অনেকাংশে ভূমিকা রাখতে পারে।

বসতবাড়িতে কৃষি বনায়ন বা জীবন নির্বাহ কৃষি বনায়ন হলো এগ্রোফরেস্ট্রির একটা ধারা। যেখানে বসতবাড়ির নির্দিষ্ট ভূখন্ডে – বনজ বৃক্ষ, ফলদ বৃক্ষ, শোভাবর্ধনকারী বৃক্ষ, অন্যান্য উদ্ভিদ, বৃক্ষ ফসল, উদ্ভিদ ফসল, গবাদিপশু, হাঁস-মুরগি, মৎস্য ইত্যাদির সমন্বয়ে সমন্বিত উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে উঠে। এর প্রধান লক্ষ্য থাকে- পরিবারের খাদ্যের চাহিদা মেটানো। এ লক্ষ্য বাস্তবায়ন সম্ভব হলে তা প্রকৃতপক্ষে দেশের সামগ্রিক বনাঞ্চল রক্ষায় ভূমিকা রাখতে পারে। কারণ বসতবাড়ির কৃষি বনায়ন পরিবারের চাহিদা মেটানোর জন্য খাদ্য উৎপাদনের ফলে বনাঞ্চল উজাড় করে কৃষি জমি বানানোর প্রয়োজন অনেকাংশে হ্রাস পায়। অপরপক্ষে, এই ব্যবস্থাপনায় বনজ উদ্ভিদ বসতবাড়ির জমিতে বেড়ে উঠায় তা কোনো দেশের সামগ্রিক বনভূমি বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখতে পারে। বাংলাদেশের প্রায় ৬৩.৪% লোক গ্রামে বাস করে (সূত্রঃ ব্রিটানিয়া ডট কম) এবং মোট বনভূমির প্রায় ১.৮৮% ভিলেজ ফরেস্ট (সূত্রঃ আরণ্যক ফাউন্ডেশন)। আমাদের দেশে গ্রামে বসবাসরত লোক বেশি হওয়ায়, গ্রামের বাড়ির আঙিনায় এই কৃষিজ বনায়ন সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলতে পারে। এতে ভিলেজ ফরেস্টের পরিমাণ বাড়বে, যা সামগ্রিক বনাঞ্চল এর পরিমাণ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখবে।

আমাদের দেশের গ্রামাঞ্চলের মুটামুটি প্রতিটা বসতবাড়িই কৃষি বনায়নের উপযুক্ত। কিন্ত যথাযথ পরিকল্পনা ও এগ্রোফরেস্ট্রি সম্পর্কে কারিগরি জ্ঞান না থাকায় তা আশানুরূপ কোনো ফল দিতে পারছে না। বাংলাদেশের কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) একটি বসত বাড়িতে কৃষি বনায়ন ধারা গড়ে তোলার লক্ষ্যে নিম্নলিখিত কিছু প্রধান দিক বিবেচনায় রাখার কথা বলে-

১. বসতবাড়ির চারপাশের সীমানায় বেড়া হিসেবে মান্দার, ভেরেন্ডা, পলাশ, জিগা ইত্যাদি উদ্ভিদ ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে বসতবাড়ির সীমানা নির্ধারণ ছাড়াও সুরক্ষার কাজও করবে।

২. বাড়ির আঙিনায় শাকসবজির চাষ করতে হবে।

৩. বসতবাড়ির আঙিনার ফাঁকা স্থানে আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, পেয়ারা, বেল, পেঁপে, নিম, বহেড়া, হরীতকী, তুলসী, সজিনা, নারিকেল, সুপারি, বকুল ইত্যাদি গাছ রোপণ করা যায়।

৪. বসতবাড়ির সীমানায় পুকুর থাকলে সেখানে বিভিন্ন ধরনের মাছের চাষ করতে হবে। পুকুরের পাড়ে বিভিন্ন ধরনের বৃক্ষরোপণ (নারিকেল, সুপারি, ইপিল-ইপিল, মেহগণি, খেজুর, কড়ই ইত্যাদি) করতে হবে। এতে গরমের সময় মাছের উপকার হয়। এখানে বেশি শিকড় বিশিষ্ট গাছ লাগালে পুকুরের পাড়ের মাটি ভাঙবে না।

৫. বিভিন্ন ছায়াসহ্যকারী উদ্ভিদ যেমন- আদা, হলুদ ইত্যাদি দুই বৃক্ষের মাঝে লাগতে হবে।

৬. বসতবাড়িতে যতটুকু সম্ভব গবাদিপশু-পাখি (হাঁস-মুরগি, কোয়েল, কবুতর, গরু, ছাগল, মৌমাছি ইত্যাদি) পালন করতে হবে।

৭. সর্বোপরি স্থান-অবস্থান, উদ্দেশ্য, প্রয়োজনীয়তা, সামর্থ্য, সহজ প্রাপ্যতা ইত্যাদি বিবেচনা করে বসতবাড়ির কৃষি বনায়ন ধারার উপাদানগুলো নির্বাচন করতে হবে এবং যথাযথ নিয়মে এর পরিচর্যা করতে হবে।

এই বসতবাড়িতে কৃষি বনায়ন ধারণারও অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তবুও পুরোপুরি না হলেও অনেকাংশে দেশের ক্রমশ ধ্বংস হতে থাকা বনাঞ্চল রক্ষায় এটি পরোক্ষ এবং প্রত্যক্ষভাবে ভূমিকা রাখতে পারে। গ্রামাঞ্চলের প্রায় ৮০% লোকের খাদ্যের চাহিদা বসতবাড়ির কৃষিজ বনায়ন থেকে মেটানো সম্ভব। খাদ্যের চাহিদা মেটানো সম্ভব হলে কৃষি জমির উপর চাপ হ্রাস পাবে, ফলে কলকারখানা ও বিভিন্ন শিল্প স্থাপন অধিকতর সহজ হবে৷ কৃষিজমি বা কারখানা স্থাপনের জন্য মানুষ বনাঞ্চল উজাড় করবে না। এটি হলো বনাঞ্চল রক্ষায় পরোক্ষ প্রভাব। অপরদিকে, এগ্রোফরেস্ট্রিতে কাষ্ঠল তথা ফলজ, বনজ উদ্ভিদ বসতবাড়ির আঙিনায় লাগানো হয় বলে তা প্রত্যক্ষভাবে সামগ্রিক বনভূমির পরিমাণ বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে।

বসতবাড়িতে কৃষি বনায়ন ধারণাকে ফলপ্রসূ করার জন্য নিম্ন লিখিত ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে-

১. এগ্রোফরেস্ট্রির সঠিক ধারণা প্রচার ও প্রসারের জন্য সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে আসতে হবে।

২. কৃষকদের বিশেষ ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করা।

৩. প্রতিটি গ্রামে তরুণদের নিয়ে কয়েক সদস্যের দল করা, যারা মাঠপর্যায়ে কৃষককে কারিগরি সহায়তা করবে।

৪. কৃষকদের বসতবাড়িতে কৃষি বনায়নে উৎসাহ বৃদ্ধি করার জন্য অল্প সুদে ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা করা।

৫. আধুনিক ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা।

৬. বসতবাড়িতে কৃষি বনায়ন জনপ্রিয় করে তুলার লক্ষ্যে গণমাধ্যম ও সোসাল মিডিয়ার সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা।

লেখক: সাজিবুল আনাম পরাগ, শিক্ষার্থী, ফরেস্ট্রি বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।