
সম্প্রতি ইউনেস্কোর ক্রিয়েটিভ সিটিস নেটওয়ার্কে নৈপুণ্য এবং লোকশিল্প বিভাগে স্থান করে নিয়েছে শ্রীনগর। পাশাপাশি ভারতের সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন ৫০ টি শহরের মধ্যেও অন্যতম হিসেবে উঠে এসেছে শহরটির নাম। শিক্ষা সহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রেও অগ্রগণ্য রাজ্য হিসেবে উঠে এসেছে জম্মু ও কাশ্মীরের নাম। আর এই সব অর্জনই সম্ভবপর হচ্ছে বিতর্কিত ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের পর থেকে।
কাশ্মীরে পাক মদদপুষ্ট সন্ত্রাসের বিষয়টি গোটা বিশ্বের কাছেই পরিচিত। আর কয়েক দশকের এই জঙ্গিবাদে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কাশ্মীরের তরুণ সমাজ। শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যাপক পিছিয়ে পড়ে অঞ্চলটি। মুহুর্মুহু ধর্মঘট আর অবরোধে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয় অঞ্চলটির সামগ্রিক উন্নয়ন। কিন্তু পরিস্থিতির পরিবর্তন শুরু মোদী কর্তৃক ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের পর থেকে। এরই ধারাবাহিকতায় শান্তির সুবাতাস বইতে শুরু করেছে জম্মু ও কাশ্মীরে।
কেন্দ্রীয় শাসন জারির পর থেকেই অঞ্চলটির শিক্ষার্থীদের উন্নয়নে বেশ কিছু প্রকল্প হাতে নিয়েছে মোদী সরকার। এর আওতায় অত্র অঞ্চলে আদিবাসী ও তরুণ সম্প্রদায়ের জন্য ‘স্মার্ট স্কুল’ প্রকল্প চালু করা হয়েছে। কাশ্মীরে দায়িত্ব পালনরত লেফটেন্যান্ট গভর্নর মনোজ সিনহার এক টুইটে সম্প্রতি জানা যায়, দু দফায় প্রায় ২০০ টি স্কুলের আধুনিকায়ন করা হবে ‘স্মার্ট স্কুল’ প্রকল্পের অধীনে। প্রথম দফায় আগামী মার্চ মাসে প্রায় ১০০ টি স্কুলের আধুনিকায়নের কাজ শেষ করা হবে। বাকিগুলো আগামী ডিসেম্বর নাগাদ বাস্তবায়ন করার পরিকল্পনা ইতোমধ্যে ঘোষিত হয়েছে। এই প্রকল্পের জন্য ইতোমধ্যে ৪০ কোটি টাকা ব্যয় ঘোষণা করা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় সরকারের এই পদক্ষেপে যারপরনাই খুশি স্থানীয় জনগণ। এমনই একজন শ্রীনগরের উপকণ্ঠে উপজাতীয় এলাকা ফকির গুজরির বাসিন্দা আব্দুল আহাদ গনি। তিনি বলনে, “গোটা পদক্ষেপটি আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য অনেক ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে বলে বিশ্বাস করি। ইতোপূর্বে মানসম্মত শিক্ষা এবং অবকাঠামোর অভাবে আমাদের সন্তানদের অনেক ক্ষতি হয়েছে। স্মার্ট শিক্ষা প্রকল্প ঘোষণায় আমরা সবাই খুব খুশি।”
এছাড়াও, উপজাতীয় গাদ্দি, সিপ্পি, দর্দ এবং শিনা সম্প্রাদায়ের প্রায় ২১ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য বৃত্তি ঘোষণা করা হয়েছে। তাই স্বভাবতই কাশ্মীর অঞ্চলজুড়ে সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে এক স্বস্তি।
শিক্ষার পাশাপাশি কাশ্মীরের শিল্প ও উৎপাদন ব্যবস্থার দিকেও মনযোগ দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। ইতোমধ্যে ছয় হাজার একর জমি অধিগ্রহণ করে শিল্পাঞ্চল তৈরীর কাজ শুরু হয়েছে। শিল্প ব্যাংকও স্থাপন করা হচ্ছে। এরই মাঝে জম্মুতে ২১২৫ একর এবং কাশ্মীরে ১ হাজার একরের মতো জমি শিল্প ও বাণিজ্য বিভাগে স্থানান্তর করা হয়েছে। গোটা প্রক্রিয়াটি ভারতের ইন্ডাস্ট্রিয়াল পলিসি ২০১৬ এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে বলে ইন্ডিয়া নিউজ নেটওয়ার্ককে নিশ্চিত করেছেন একজন সিনিয়র সরকারী কর্মকর্তা। তাছাড়া, প্রশাসন রাজ্যটির বিভিন্ন জেলায় ২৯২ টি শিল্পাঞ্চল চিহ্নিত করেছে বলেও জানা গিয়েছে। এর মাঝে ১৫০ টি জম্মুতে এবং কাশ্মীরে ১৪২ টির অবস্থান।
শিক্ষা, শিল্প ও উৎপাদনের পাশাপাশি অবকাঠামোগত উন্নয়নেও ব্যাপক পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। দ্রুত বাস্তবায়ন ঘটছে জম্মু-শ্রীনগর মহাসড়কের কাজিগুন্ড-বানিহাল টানেল প্রকল্পের কাজ। এই টানেলটি নির্মাণের ফলে জম্মু থেকে শ্রীনগর যাত্রার সময় প্রায় দেড় ঘণ্টা কমে আসে। একই সঙ্গে প্রায় ১৬ কিলোমিটার পথ কম ভ্রমণ করেই গন্তব্যে পৌছাতে পারছে নাগরিকেরা। এর সবই কার্যকর হয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের তত্ত্বাবধানে।
সরকারের এসব উন্নয়ন কর্মকান্ডের সুফল ভোক্তাদের একজন কাশ্মীরের বাসিন্দা শাল ব্যবসায়ী আশিক হোসেন। ইন্ডিয়া নিউজ নেটওয়ার্কের সঙ্গে কথোপকথনের সময় তিনি বলেন, “আমি দিল্লিতে ব্যবসা করি। ব্যবসায়িক ও পারিবারিক কারণে প্রায়ই জম্মু ও কাশ্মীরে যাওয়া আসা করতে হয়। টানেলটি নির্মাণ হওয়ায় আমাদের অসংখ্য দূর্ভোগ শেষ হয়েছে।”
উল্লেখ্য, টানেলটি নির্মাণ সহ জম্মু ও কাশ্মীরের সড়ক উন্নয়নে ভারত সরকার প্রায় বারো হাজার কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এর আওতায় ইতোমধ্যে ২৫ টি মহাসড়ক নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপণ করা হয়েছে। একইভাবে দৃশ্যমান পরিবর্তন এসেছে কাশ্মীরের সরবরাহ চেইনে।
তাছাড়া, বিদ্যুৎ সরবরাহ বর্তমানে বেশিরভাগ এলাকাতেই ২৪ ঘন্টা চলমান। শুধুমাত্র ২০২১ সালেই প্রায় ১১৯ কোটি রুপি মূল্যের ১৭ টি বিদ্যুৎ প্রকল্পের উদ্বোধন করা হয়েছে। এর উপর অঞ্চলজুড়ে বিদ্যুৎ উদ্ধৃত করার জন্যে ৫৪ হাজার কোটি টাকার বিদ্যুৎ প্রকল্পের অনুমোদন করা হয়েছে। এর আওতায় আগামী তিন থেকে চার বছরে প্রায় সাড়ে তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন করা হবে বলে জানা গিয়েছে।
এদিকে, গত বছর কাশ্মীর পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন লিমিটেড (কেপিডিসিএল) প্রায় ৩৫৮ লাখ ইউনিট বিদ্যুৎ সরবরাহ করেছে, যা এর পূর্বের বছরের সরবরাহ করা শক্তির তুলনায় সাড়ে সতেরো শতাংশ বেশি। এটি এখন পর্যন্ত কাশ্মীরে পরিবেশিত সর্বোচ্চ পিক লোড বলে ধারণা করা হচ্ছে। আর এসবই সম্ভবপর হচ্ছে বিতর্কিত ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের পর থেকে।
উক্ত খাতগুলোর পাশাপাশি দিনকে দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে জম্মু ও কাশ্মীরের রিয়েল এস্টেট সেক্টর। ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের ফলে অঞ্চলজুড়ে সম্পত্তি কেনার অধিকার পেয়েছে ভারতের অন্য অঞ্চলের নাগরিকবৃন্দ। ফলে দ্রুত প্রসার ঘটছে রিয়েল এস্টেট ব্যবসার। এই খাতে ইতোমধ্যে প্রায় উনিশ হাজার কোটি রুপির ৩৯ টি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে বলে জানা গিয়েছে।
এসবের পাশাপাশি কাশ্মীরের বিনোদন ব্যবস্থা, শিশু ও কিশোরদের বিকাশ, পর্যটন সকল খাতই নতুন মাত্রা পেয়েছে। ফলে অঞ্চলজুড়েই বইছে তৃপ্তির সুবাতাস। খবর: ইন্ডিয়া নিউজ নেটওয়ার্ক