
কাউন্টারিং আমেরিকা’স অ্যাডভার্সারিজ থ্রু স্যাঙ্কশনস অ্যাক্ট (সিএএটিএসএ বা ক্যাটসা) যুক্তরাষ্ট্রের একটি কঠোর আইন। রাশিয়ার থেকে অস্ত্র কিনলেই যেকোনো দেশের বিরুদ্ধে এই আইন প্রয়োগ করা হয়। এ মিসাইল সিস্টেম কেনার জন্য তুরস্কের ওপর ক্যাটসা নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
২০১৪ সালে রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখল ও ২০১৬ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রুশ হস্তক্ষেপের অভিযোগের পর এই আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল। ২০১৮ সালের অক্টোবর মাসে ৫টি এস-৪০০ কেনার জন্য রাশিয়ার সঙ্গে ৫০০ কোটি মার্কিন ডলারের চুক্তি সই করে ভারত। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের প্রচ্ছন্ন হুমকির পরও ওই চুক্তি থেকে পিছপা হয়নি দেশটি।
এস-৪০০ মূলত একটি মিসাইল সিস্টেম বা ক্ষেপণাস্ত্র যা রাশিয়ার সব থেকে আধুনিক শক্তিশালী দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা হিসেবে পরিচিত। এ ব্যবস্থায় ভূমি থেকে আকাশে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা যায়। চুক্তির পর ইতোমধ্যে এস-৪০০-এর একাধিক চালান হাতে পেয়েছে ভারত। চীন ও পাকিস্তান সীমান্তে খুব শিগগিরই এ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা মোতায়েন করা হবে জানা গেছে।
সম্প্রতি চীনের মোকাবিলার লক্ষ্যে ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে চায়ছে আমেরিকা। রাশিয়া থেকে ক্ষেপণাস্ত্র ছাড়াও সম্প্রতি তেল কিনছে ভারত। তা সত্ত্বেও ভারতের বিরোধিতা করছে না ওয়াশিংটন। তারই ধারাবাহিকতায় এবার আইন সংশোধন করে ভারতকে এই বিশেষ ছাড় দেয়া হলো।
ভারতকে নিষেধাজ্ঞার বাইরে রাখতে সম্প্রতি মার্কিন কংগ্রেসে ক্যাটসা আইন সংশোধনের প্রস্তাব আনে ক্যালিফোর্নিয়ার ভারতীয় বংশোদ্ভূত আইনপ্রণেতা রো খান্না। প্রস্তাবে তিনি বলেন, চীনা আগ্রাসনের মোকাবিলায় ভারতের পাশে দাঁড়ানো উচিত আমেরিকার।’
মার্কিন কংগ্রেসে ভারতীয় ককাসের ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে দীর্ঘদিন ধরেই কাজ করছেন খান্না। ২০০৪ সালে তৈরি হয়েছিল ভারতীয় ককাস। সন্ত্রাসদমন, গণতন্ত্র সুরক্ষিত রাখা-সহ নানা বিষয়ে ওয়াশিংটনের সঙ্গে নয়াদিল্লির দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক মজবুত করতেই তৈরি হয়েছিল এই জোট।
পারমাণবিক শক্তিসম্পন্ন দূরপাল্লার আন্তমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র (আইসিবিএম) অগ্নি–৫ ভারতীয় বাহিনীর সামরিক ক্ষমতা ২০১৮–১৯ সালেই বাড়িয়ে দিয়েছে। হঠাৎ তার ‘প্রকাশ্য সফল উৎক্ষেপণের ঘোষণার’ নেপথ্য কারণ কী? প্রশ্নটি আলোচনার পর্যায়ে উঠে এসেছে। ভারতের প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের ধারণা, সাম্প্রতিক বৈশ্বিক ভূরাজনীতি ভারতের প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত চিন্তাভাবনা ও মনোযোগকে পাকিস্তানের দিক থেকে অনেকটাই সরিয়ে চীন সীমান্তে টেনে এনেছে। প্রস্তুতির বেশিরভাগ হয়ে উঠেছে চীনকেন্দ্রিক। অগ্নি–৫ উৎক্ষেপণের সফল ঘোষণাও সেই লক্ষ্যে।
চীনের সাম্প্রতিক কয়েকটি পদক্ষেপ ভারতকে বেশ সতর্ক করে তুলেছে। সেই কারণে প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত মনোযোগের বেশিরভাগ আগে যেখানে ছিল পশ্চিমে, পাকিস্তানকেন্দ্রিক; এখন তা ক্রমশ চীন সীমান্তে কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। বিশেষ করে পূর্ব লাদাখ ও ভুটান–তিব্বত লাগোয়া অরুণাচল সীমান্তে, যেখানে চীন ক্রমাগত ভারতীয় সেনাদের চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
গত ২৩ অক্টোবর চীনের সংসদে নতুন স্থলসীমান্ত আইন পাস হওয়ার পর ভারত প্রতিরক্ষা প্রস্তুতি সম্পর্কে নতুন ভাবনাচিন্তায় বাধ্য হয়েছে। লক্ষণীয়, ওই আইন রূপায়ণের আনুষ্ঠানিক বিরোধিতা করার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ভারত অগ্নি–৫ ক্ষেপণাস্ত্রের সফল উৎক্ষেপণের কথা ঘোষণা করে। পারমাণবিক শক্তিসম্পন্ন এই ক্ষেপণাস্ত্রের আওতায় রয়েছে চীনের ভূখণ্ড।
চীনের অভিসন্ধির প্রতি ভারতের সন্দিহান হওয়ার প্রথম লক্ষণ ছিল দোকলাম। ২০১৭ সালের জুনে চীন–ভুটান–ভারত সীমান্তের দোকলামকে কেন্দ্র করে চীনের তৎপরতার পর থেকে প্রতি বছরই চীন সংলগ্ন সীমান্ত নিয়ে ভারতকে ব্যস্ত থাকতে হয়েছে। দোকলামের পর ভারত–চীন সেনারা জড়িয়ে পরে পূর্ব লাদাখের গালওয়ানের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে। ২০২০ সালের সেই সংঘাতের পর বারবার সীমান্তে উত্তেজনা দেখা দিয়েছে।
চীন কিছুদিন পরপর প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর বিভিন্ন এলাকায় নতুন নতুন দাবি জানিয়ে আসছে। অরুণাচল প্রদেশে ভারতীয় নেতাদের যাওয়া–আসাকে কেন্দ্র করে আনুষ্ঠানিক আপত্তি জানিয়েছে দেশটি। সবচেয়ে বড় কথা, সেনাপর্যায়ে ১৩ দফা বৈঠক সত্ত্বেও পূর্ব লাদাখের বিবাদ অমীমাংসিত রেখেছে বেইজিং। এই পরিস্থিতিতে সাম্প্রতিক দুটি ঘটনা ভারতকে প্রতিরক্ষা প্রস্তুতি নিয়ে নতুনভাবে চিন্তা করার রশদ জুগিয়েছে।
দুটি ঘটনাই ঘটেছে চলতি অক্টোবর মাসে। প্রথমটি মাসের মাঝামাঝি। এ সময় চীন ভুটানের সঙ্গে সীমান্ত বিরোধ মীমাংসার জন্য সমঝোতা চুক্তি সই করে। ভারতের সঙ্গে ভুটানের নিরাপত্তাসংক্রান্ত চুক্তি রয়েছে। এখন ভুটানের সঙ্গে সীমান্ত চুক্তি করার মধ্য দিয়ে এটা স্পষ্ট হয় যে, ভারতকে বাদ দিয়ে চীন এখন ভুটানের সঙ্গে সরাসরি সীমান্তসংক্রান্ত বিরোধ মিটিয়ে ফেলতে চাইছে।
এই চুক্তি সইয়ের ১৫ দিন না যেতে চীনা সংসদে পাস হয়েছে স্থলসীমান্ত আইন। এই আইন সীমান্তবর্তী এলাকায় চীনা লাল ফৌজকে প্রবল ক্ষমতাধর করে তুলবে। এই আইন ফলে চীনা সেনাবাহিনী সীমান্তবর্তী এলাকায় সেনা অবকাঠামো উন্নয়ন ত্বরান্বিত করবে। প্রতিরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নতুন করে তৈরি করবে। সীমান্ত গ্রাম গড়ে তুলবে (তিব্বতে ইতিমধ্যেই ৬০০ এমন গ্রাম তৈরি হয়েছে) এবং সেই গ্রামবাসীদের প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ দেবে।
ভারত এই আইন পাসের পর আপত্তি জানিয়েছে ঠিকই, কিন্তু তাতে কতটা কাজের কাজ হবে ভারতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের তা জানা নেই। এই মন্ত্রণালয়ের এক সূত্রের মতে, ‘চীনের সঙ্গে ভারতের বিশ্বাসের ঘাটতি বৃদ্ধির যুক্তিসঙ্গত কারণ রয়েছে।’ ওই সূত্রের আশঙ্কা, ‘এই আইন লাল ফৌজকে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা অবমাননায় উৎসাহিত করবে। যা আগামী দুই দেশের মধ্যে সংঘাত ও সংঘর্ষের পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে।’
এসব কারণে ভারতের প্রতিরক্ষা প্রস্তুতির বেশিরভাগ এখন উত্তরের প্রতিবেশীর দিকে। ফ্রান্স থেকে কেনা অত্যাধুনিক রাফায়েল যুদ্ধবিমানের সিংহভাগ পূর্ব ভারতে মোতায়েন করা হয়েছে। অরুণাচল প্রদেশের সীমান্তে মোতায়েন করা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি চিনুক যুদ্ধ হেলিকপ্টার, অত্যাধুনিক কামান, উন্নতমানের এল–৭০ এয়ার ডিফেন্স ব্যবস্থা এবং সুপারসনিক ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র। জোরদার করা হয়েছে নজরদারি ব্যবস্থা। শীতে বরফ ঢাকা পাহাড়ে যুদ্ধ করার জন্য যে নতুন মাউন্টেন স্ট্রাইক কোর গড়া হয়েছিল, যুদ্ধ প্রস্তুতি প্রশিক্ষণ পর্ব শেষ করে তা এখন কাজ শুরু করে দিয়েছে। এক হাজার ৩৫০ কিলোমিটারের সীমান্তজুড়ে অবকাঠামো নির্মাণের কাজ জোরদার করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে সেতু, সড়ক, সুরঙ্গ ও যুদ্ধোপযোগী বিমানঘাঁটি তৈরির কাজ।
ইনস্টিটিউট অব ডিফেন্স স্টাডিজ অ্যান্ড অ্যানালিসিসের (আইডিএসএ) গবেষক ও চীন বিশেষজ্ঞ জগন্নাথ পান্ডা প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভারত সম্পর্কে চীন বরাবরই সতর্ক ও সজাগ। ইদানিং তা বেড়েছে। এশিয়ায় ভারত শুধু চীনের প্রবল প্রতিপক্ষই নয় বরং পশ্চিমা জোটের অন্যতম বড় শক্তি ভারত। বেইজিং মনে করে, কোয়াড–এর মূল লক্ষ্য চীনের অগ্রগতি প্রতিহত করা। আর ভারত এই জোটের অন্যতম সদস্য। চীন সরকার এটাও মনে করে যে, সদ্যগঠিত ত্রিদেশীয় কৌশলগত নিরাপত্তা জোট অকাস–এর আসল লক্ষ্য চীন। এসব কারণে ভারতকে চাপে রাখতে চাইছে চীন।’
এই বিষয়ে জগন্নাথ পান্ডা আরও বলেন, ‘ভারতের প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত বিপদ পাকিস্তানের দিক থেকে যতটা তার চেয়েও অনেক বেশি চীনের দিক থেকে। সেই কারণেই এত প্রস্তুতি দিল্লির।;
প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞেরা মনে করছেন, চীনের বর্তমান শাসকের সম্প্রসারণবাদী মনোভাব আগামী দিনে বিশ্বশান্তির পক্ষে রীতিমতো চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে। আগামী ১৫ থেকে ২০ বছরের মধ্যে চীন একে একে তিনটি ক্ষেত্রে নিজেদের প্রাধান্য প্রশ্নাতীত করতে চাইছে। প্রথমেই তাদের নজরে রয়েছে তাইওয়ানের সংযুক্তি। ২০২৫ সালের মধ্যে এই লক্ষপূরণ তারা করে ফেলতে চায়। এরপর তাদের নজরে রয়েছে দক্ষিণ চীন সাগরের ছোট ছোট কিছু দ্বীপ, যেগুলো সামরিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ মনে কো হয়। এসব দ্বীপের নিয়ন্ত্রণ কিছুতেই ছাড়তে চায় না চীন। তৃতীয় লক্ষ্য, পূর্ব লাদাখের কিছু অংশের সঙ্গে গোটা অরুণাচল প্রদেশ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়া।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল দীপঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় এই প্রসঙ্গে প্রথম আলোকে বলেন, ‘অরুণাচল প্রদেশ নিয়ে চীন বরাবর স্পর্শকাতর। সেই লক্ষ্যপূরণের প্রথম ধাপ হিসেবে ভুটানকে কাছে টানতে দেশটি চুক্তি করেছে। শক্তিও জাহির করছে নানাভাবে, যার অন্যতম হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা।
এই বিষয়ে দীপঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় আরও বলেন, ‘এখনকার ভারত চীনকে মোকাবিলায় সক্ষম। গত কয়েক বছর ধরে ভারত নিজেকে যোগ্য করে তুলেছে। প্রতিরক্ষার সংক্রান্ত মনোযোগ চীন সীমান্তে টেনে এনেছে। ভারতের ঘাড়ের ওপর রয়েছে পাকিস্তান। কিন্তু চীন মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্বস্তি এটাই যে, ভারত এই বিষয়টি সময় থাকতেই অনুধাবন করতে পেরেছে।’ খবর: ইন্ডিয়া নিউজ নেটওয়ার্ক