হোমায়রা তাসনিম: লোকমুখে পানামসিটির কথা অনেক শুনেছি। কিন্তু ব্যস্ততার ভীড়ে আর যাওয়া হয়ে উঠেনি। দিন যতই যাচ্ছিল পানামসিটিতে যাওয়ার ইচ্ছেটা ততই তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছিল। তাই ২৭ডিসেম্বর, ২০১৯ইং রাতে হুট করেই পানামসিটিতে যাওয়ার পরিকল্পনা করে বসি। খুব সকালে উঠেই দ্রুত তৈরি হয়েই সকাল ৮.০০টায় মাকে নিয়ে বেরিয়ে পরি গুলিস্তান বাসস্ট্যান্ডের উদ্দেশ্য। গুলিস্তান থেকে সকাল ৯.৩০টায় দোয়েল বাসে করে পানামসিটির উদ্দেশ্যে যাত্রা করি। গুলিস্তান থেকে নারায়ণগঞ্জের মুগরাপাড়ায় যেতে বাসের টিকেট ৪৩টাকা। মুগরাপাড়ায় পৌছাতে সময় লাগে মাত্র ৪০মিনিট। মুগরাপাড়া স্ট্যান্ড থেকে অটোরিকশায় করে সকাল ১১.০০টার মধ্যেই পৌছে যাই, আমার সেই প্রত্যাশিত গন্তব্য পানামসিটি। মুগরাপাড়া থেকে পানামসিটির অটোরিকশা ভাড়া ১০টাকা।
এবার আসি,পানামনগরীতে ঘুরে আমার জ্ঞানভান্ডারে যুক্ত হওয়া কিছু ইতিহাসের বর্ণনায়ঃ যেখানে ইতিহাস কথা বলে, শত শত বছরের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস, ধ্বংসপ্রায় নগরীর ইতিহাস। বলছি সোনারগাঁয়ের ঐতিহাসিক পানাম নগরীর কথা। লোনা ইট-কালো পাথরের ধূসর স্মৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এই পানামনগর বাংলাদেশের মানুষের কাছে “হারানো নগরী” হিসেবেই সুপরিচিত। ভ্রমণপিপাসুদেরকে দূর থেকেই অজানা আকর্ষণে টানাবে পানাম….!!!
পানামাসিটি বাংলার প্রাচীন শহর।একসময় ধনীহিন্দু সম্প্রদায়ের লোকদের বসবাস ছিল এই পানামে।ছিল মসলিনের জমজমাট ব্যবসা।
ঈশা খাঁ-এর আমলে বাংলার রাজধানী ছিল পানাম।বড় নগর,খান নগর,পানাম নগর প্রাচীন সোনারগাঁও-এর এই তিন নগরীর মধ্যে পানামনগর ছিল সবচেয়ে আকর্ষণীয়।এখানে কয়েক শতাব্দী পুরনো অনেক ভবন রয়েছে যা বার ভুইঁয়াদের ইতিহাস বহন করে।জানা যায়,এখানে ১৪০০ শতাব্দীতে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়।যেখানে পৃথিবীর নামি-দামি শিক্ষকেরা পড়াতে আসতেন।আরো জানা যায়,২০০৬ সালে পানামনগরকে বিশ্বে ধ্বংসপ্রায় ১০০টি ঐতিহাসিক স্থাপনার তালিকায় স্থান দেওয়া হয়।
পানামনগরীর নির্মাণশৈলী অপূর্ব এবং নগর পরিকল্পনা দূর্ভেদ্য ও সুরক্ষিত। এটি মূলত বঙ্গ আমলের তাঁত ব্যবসায়ীদের মূল কেন্দ্রবিন্দু ও আবাস্থল ছিল। এস্থান থেকে ব্যবসায়ীরা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তাঁত ব্যবসা পরিচালনা করতো। বাংলার মসলিনসহ অন্যান্য তাঁত শিল্পের প্রচার প্রসার ও ব্যবসায়ের তীর্থস্থান ছিল এ পানামনগরী। এ নগরীতে মূলত ব্যবসায়ী ও জমিদাররা বসবাস করতেন। এর পাশাপাশি রাজাদের আমির-ওমরাদের জন্য পানামনগরী ও এর আশেপাশের গ্রামগুলোতে গড়ে উঠেছিল নিপুণ কারুকার্য খচিত পাকা ইমারতরাজি। পানাম ও তার আশপাশকে ঘিরে পঞ্চদশ শতক থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত এক সমৃদ্ধ জনজীবন ছিল। এখানে রাস্তার দুইধারে গড়ে উঠেছিল অট্টালিকা, সরাইখানা, মসজিদ,মন্দির,নাচঘর,টাকশাল,মঠ, কূপ,গুপ্তপথ, প্রমোদালয় ইত্যাদি। এখানে প্রায় ৪০০বছরের পুরনো মঠবাড়ি দেখা যায়।
পানামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে পঙ্খীরাজ খাল।এখাল পানামের গুরুত্বপূর্ণ ভবনগুলো ছুঁয়ে পূর্বদিকে মেনিখাল নদ হয়ে মেঘনাতে মিশেছে।৫মিটার প্রশস্ত ও ৬০০মিটার দীর্ঘ একটি সড়কের দুইপাশে একতলা,দুতলা,তিনতলা দালান রয়েছে।মোট ৫২টি ভবন।তারমধ্যে,মূলরাস্তার উত্তরদিকে ৩১টি এবিং দক্ষিণ দিকে ২১টি ভবন রয়েছে।
আশেপাশে রয়েছে ছোট সর্দার বাড়ি,ঈশা খাঁর তোরণ,নীলকুঠী, বণিকবসতি,পানামনগর সেতু ইত্যাদি। প্রবেশমুখেই হাতের বামে একটি বড় ফলক রয়েছে।যাতে সংক্্ষিপ্ত আকারে ইতিহাস লিখা আছে। প্রবেশ করলেই মনে হবে যেন,এক মৃত নগরীতে প্রবেশ করেছেন।ঘুরতে ঘুরতে বার বার কল্পনায় আজকের পানাম আর জীবন্ত পানাম মনের ভিতর এঁকে নিচ্ছিলাম।সব ঘুরে দেখার পর হাঁটি হাঁটি পা পা করে বের হওয়ার সময় প্রাইমারিতে পড়া সেই কবিতার লাইন বারবার মনে হচ্ছিলো,
“বহুদিন ধরে বহুক্রোশ দূরে,বহুব্যয় করি বহুদেশ ঘুরে,
দেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা, দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু।
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া,ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া,
একটি ধানের শিষের উপর,একটি শিশির বিন্দু।”
ঢাকার আশেপাশে পরিবার পরিজন নিয়ে একদিনের ট্যুর দেওয়ার জন্য পানামসিটিই সেরা।
লেখক: হোমায়রা তাসনিম, মনোবিজ্ঞান বিভাগ, ২য় বর্ষ, সরকারি তিতুমীর কলেজ, ঢাকা।