০৮:৩৭ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ০৭ অক্টোবর ২০২৪, ২২ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

পলাশীর মা

সুভাষ কুমার রায়: পরিচিত কিংবা অপরিচিত দু’চারজন লোক দেখলে সেখানেই পলাশীর মা গিয়ে হাজির। যদি কোনো সুসংবাদ থাকে, অর্থাৎ, যদি রিলিফের কোনো সংবাদ থাকে! – যাকে আমরা প্রধানমন্ত্রীর উপহার  বলে জানি। স্কুল বন্ধ, যেখানে তিনি একটি ছোট দোকানে বাচ্চাদের খাবার বিক্রি করতেন! স্কুলে ঝাড়– দেয়ার  কাজটিও নেই! পলাশীর বাবার চানাচুর বাদামের দোকানও বন্ধ!

পলাশীর মা নামেই তিনি পরিচিত। প্রকৃত নামটা শুনলেও অনেকেরই মনে নেই । তবে কেউ যে জানেন না এমন নয় । নামটি রয়েছে ভোটার লিষ্টে, জাতীয় পরিচয় পত্রে আর  বয়স্ক ভাতার কার্ডে । কার্ড আছে একবারও ভাতা তুলতে পারেন নি , কারণ অজানা । ভোটার তালিকায় নাম আছে , ভোটের আগে প্রার্থীর লোকজন  বাড়িতে এসে ভোটার নাম্বার দিয়ে যায়  অথবা বাড়িতে না থাকলে জোড় গলায় ডেকে একটি সুগন্ধী সাবান বা কাপড় কাচার পাউডার কিংবা একটি আটার প্যাকেট   দিয়ে যায় । যথা সময়ে বাড়ির দোড়গোড়ায় রিক্শা অথবা ব্যাটারি চালিত গাড়ি এসে ডাক পড়ে – শান্তি রানী ভোট দিতে চলেন । তিনি এবং তার স্বামী নিখিল একটু পরিষ্কার কাপড় পরে ভোট দিতে যান । ভোটের লাইনে দাঁড়ানোর আগে সামিয়ানার নিচে এসে বসেন যেখানে চেয়ার পাতা আছে , চায়ের ব্যবস্থা আছে ,চাইলে পান কিংবা একটি সিগারেটও পাওয়া যায় । পলাশীর মায়ের পানের অভ্যাস নেই তবে পলাশীর বাবার ধোঁয়ার নেশাটা আছে । ধোঁয়ার সামগ্রী যখন তিনি নিজের পকেটের টাকা দিয়ে  কিনেন তখন আকিজ ম্যানুফ্যাক্সারিংয়ের বিড়ি কিনেন কিন্তু ভোটের সময় ফিল্টারওয়ালা সাদা রংয়ের লম্বা সিগারেট পকেটে থাকে । দুজনে দুকাপ ’র’ চা খেয়ে  চেয়ারে  আরাম করে  বসেন, এখনতো বেশ খাতির যতœ আছে,তাই কেউ উঠিয়ে দেবার সম্ভাবনা নেই । পলাশীর বাবা এবার সিগারেট ধরালেন । তিনি একটায় মাথায় আগুন ধরিয়ে আর একটি পকেটে রাখেন । সিগারেটের মাথায় ম্যাচ বা দিয়াশলাই দিয়ে আগুন ধরানো বেশ কঠিন কাজ , অনেক ছোট সময়ে তিনি এটি রপ্ত করেছেন । বাতাস থেকে আগুনটা আড়াল করে  হাতটা মুঠি করে একটি দিক দিয়ে আগুনটা দেখা যায়, সেখানে সিগারেটের অগ্রভাগ ভিতরে দিয়ে কাজটি সম্পন্ন করতে হয় । তার শেখা এই শৈল্পিক গুণটা আজ সম্পূর্ণই কাজে লাগিয়ে সিগারেট ধরিয়ে বেশ আরাম করে  ধোঁয়া বের করলেন, বিড়ি থেকে সিগারেটে কাশিটা একটু কম হয় । আজ  কেউ বলছেনা তোমরা উঠে যাও, অন্যসময়ে এসব লোকগুলোর সামনে চেয়ারে বসে থাকা সম্ভব নয়।

এবারও তিনি ঘর পাওয়ার আশায় আছেন, সকল প্রার্থীর কাছেই ঘরের দাবী তোলেন ।প্রতিবারই প্রার্থীর কর্মীরা এসে তাকে ঘর দেয়ার আশ্বাস দিয়ে  যায়। দুজন মেয়র বদল হলো , দুবারই ভাঙা ঘরসহ তার ছবি তোলা হয়েছিল।  ফরমে নাম লেখা,  জমির কাগজ দেয়া – সবই হলো , ঘরের একটি খুটি  কিংবা একটি টিনও চোখে দেখা গেলো না ।  গত ভোটের আগে কাউন্সিলর প্রার্থী আশ্বাস দিয়েছিলেন পাস করার পরই তার ঘরের কাজটি সবার আগে করে  দিবেন , কিন্তু পলাশীর মায়ের ভাগ্য এতো সুপ্রসন্ন নয় , তিনি সফল হতে  পারেন নি । ছোট সময় থেকে এই একটি কথা অনেকবার শুনেছেন, “ ভাগ্য ভালো না” । বোকা টাইপের একজনের সাথে বিয়ে হলো – এটা  তার ভাগ্য । পলাশীর বাবা সম্পত্তির ভাগটা বুঝে নিতে পারেন না এটা তার ভাগ্য, বাজারে  বা মেলায় বাদাম চানাচুর  ভালো বিক্রি হয় না এটা তার ভাগ্য, গরু ছাগল পালন করতে গিয়ে অসুখে মরে  যায় এটাও তার ভাগ্য ,  ছোট সময়ে পড়ালেখা হলো না  এটিও তার ভাগ্য।

ফরমে নাম স্বাক্ষরটা জরুরী । অনেক কষ্ট করে তিনি এটি শিখেছেন , নয়তো বয়স্ক ভাতার কার্ড হবে না, দুটি ঈদে চাল পাবার কথা তাও পাওয়া যাবে না,এনজিও থেকে  ঋণও পাওয়া যাবে না । এনজিওর লোকগুলো  টাকা দেয়ার সময় খুব ভালো ব্যবহার করে  , ভোটওয়ালাদের  মতো । যেই কিস্তির তারিখ দু’একদিন দেরী হলো অমনি তাদের  আসলরূপ দেখা যায় ।

অনেক কষ্টে শেখা নামটি মাঝে মাঝেই ভুলে যায় । একটি কাগজে নামটা লিখে তোষকের নিচে  পানি নিরোধক কাগজ যাকে  আমরা পানি কাগজ বলে থাকি, তাই দিয়ে মুড়িয়ে রেখে দিয়েছে । ভুলে গেলেই বের করে  নাম লেখাটা আবার ঝালাই করে  নেয় অথবা বলা যায় যখনই কোনো কিছু পাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয় তখনই আবার রপ্ত করে  নেয় । এখন আবার কাগজটি বের করে  লেখাটার চর্চা করলেন, বলাতো যায় না কখন লেগে যায় । পলাশীর বাবারটাও বের করে দিলেন । তিনি বলতে পারবেন না কোন বর্ণটা কী , স্বর বর্ণ বা ব্যঞ্জনবর্ণ কিংবা কোন কার (আকার , ই-কার) কিছুই জানেন না শুধু আঁচড়গুলো মনে রাখেন । প্রথমটায় দুটি গোল গোল দাগ আছে তারপর একটি দাগ আছে , তার পর মাথার উপর ছাতার মতো তার নিচে মোড়গের ঠোঁটের নিচে পেটমাটা গোল মত – শেষেরটা বেশ জটিল , এটিই মনে থাকে না । বার বার দেখে দেখে লিখতে হয় । পলাশীর বাবারটাও বেশ কঠিন । প্রথমটা ও শেষেরটা সহজেই হয়ে যায় মাঝেরটা জটিল । পলাশীর মা যে স্কুলটার সামনে ছোট একটি দোকান চালায় , সপ্তাহে একদিন স্কুলটা ঝাড়– দেয় ছেলেটা সেই স্কুলে ক্লাস থ্রি অবধি পড়েছিল । ছেলেটিই  নামদুটো শিখিয়েছে । স্যারের কাছ  থেকে দুটি শক্ত কাগজে  একটু পরিস্কার এবং সুন্দর করে নাম দুটো  লিখিয়ে নিয়েছে । এরপর থেকে ছেলেটিই প্রতি রাতে দু-একবার করে  চর্চা করাতো ।

অভাবের সংসারে দুজনকেই কাজ করতে হয় । স্কুলের পাশে পলাশীর মায়ের বাচ্চাদের খাবারের দোকান , বাজারে রাস্তার পাশে খোলা জায়গায় পলাশীর বাবার বাদাম – চানাচুরের দোকান । পলাশীর বাবার দোকান রোববার বৃহস্পতিবার এবং মৌসুমী মেলার মধ্যেই সীমিত ছিল। এখন প্রতিদিন বিকেলে ব্রীজের পশ্চিম পাশটায় রোদটাকে পিঠের  দিকে দিয়ে দোকান মেলে বসে । ভালোই বিক্রি হয় । আগে সপ্তাহে দু’দিন বাদাম ভেজে প্যাকেট করতে হতো এখন প্রতিদিনই বাদাম ভেজে প্যাকেট করতে হয় । সম্প্রতি ব্রীজের মধ্যে  বেড়ানোর জোয়ার সৃষ্টি হয়েছে । প্রথমদিকে অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা বেড়াতো , এখন সব বয়সী লোকজন বেড়াতে যায়।

কিন্তু সব বন্ধ হয়ে গেলো । প্রথম প্রথম দোকান নিয়ে বাজার কিংবা ব্রীজের পাশে দোকান মেলে বসতো । লোকজনের ভির নেই । যাও দু’চারজন আসে তারাও বাইরের খাবার খেতে চায় না ।‘করোনা’ , এটা নাকি শুধু বাংলাদেশে নয়, সব দেশেই হয়েছে। এক সময় পলাশীর মাকে মাটি কাটার দলে কাজ করতে হয়েছে । তখন শরীরে শক্তি ছিল , এখন আর কোদালে কোপ দিতে পারে না, বুকে ব্যথা হয় । কাজটিতে একটু সুবিধা ছিল , দিনে আট ঘন্টা কাজ । ওদের  ঘন্টার হিসেবটা বেশ মজার  ,ভোরের আযান থেকে দুপুরের আযান পর্যন্ত  ।

শীত গ্রীষ্মের তারতম্যে কর্মঘন্টা একটু এদিক ওদিক হলেও মজুরীটা একই রকম। কাজ শেষে দুপুরে বাড়ীতে গেলে তখন মেজাজটা খিটকিটে হয়ে থাকতো । ভোরে একটি বোলে পান্তা আর বাশী তরকারী নয়তো কাঁচামরিচ পিয়াজ সংগে নিতো । দুপুরে স্নান শেষে রান্না করে  তবে খাওয়া। সকালে বাজার করা ছোট,পচা কিংবা একটু কম দামে কেনা সামুদ্রিক  মাছের ঝোল রান্না করতে হবে ।‘বলদা’কে মনের ঝাল মিটিয়ে কয়েকটি অদ্ভুত খিস্তি দিয়ে রান্না করতে যেতেন । বলদা ওনার স্বামীর ডাক নাম, ছোট থেকে এ নামেই সবাই ডেকে থাকে । দুপুরের খাবার খেতে খেতে পরবর্তী আযান হয়ে যেতো । হাটবার অর্থাৎ রোববার – বৃহস্পতিবার পলাশীর বাবা দু’চারটে রিটার্ণ খিস্তি দিতে কসুর করতো না । সেদিন একটু আগেভাগে খেয়ে বাদামের প্যাকেট নিয়ে হাটে যেতে হবে , তবেইনা ভালো বিক্রি হবে ।

দিনগুলোতো  ভালোই ছিল।  আর্থিক দৈন্যতা থাকলেও দিনে একবার অন্তত চুলা জ্বলতো । দুপুরে রান্না করে  , দুপুর – রাতে খাবার পর ভাতে পানি দিয়ে সকালের পান্তা । মাঝে মাঝে ছেলেটা পান্তা খেতে বিরক্ত হতো , তখন তাকে ১৫/২০টা টাকা দিতে হতো । বাজারে গিয়ে হোটেল থেকে দুটি তেলের পরোটা এবং ডাল-ভাজি দিয়ে নাস্তা সেরে  আসতো । পালাশীর বাবাও মাঝে মাঝে খেতো , পলাশীর মায়েরও মাঝে মাঝে ইচ্ছে হতো , ইচ্চাটা পূরণ হতে সময় নিয়েছিল অনেকটা বছর । এইতো ক’দিন আগে বছরের শুরুতে স্কুলের ছাত্রছাত্রী সহ সবাই মিলে সাফারী পার্কে পিকনিকে গেল। তাকেও সংগে নিয়ে গিয়েছিল । সকালের নাস্তা ছিল দোকান থেকে কেনা দুটি তেলেভাজা পরোটা আর ডাল-ভাজি। প্যাকেট বেশি হওয়ায় দুটি পেয়ে  মনভরে  খেয়েছিল ।

সবকিছু বন্ধ হবার পর ক’দিন তো ভালোই চলছিল , এখন আর চলে না । একবার রান্না করে তিনবার খাওয়া সে-তো আর হয় না । কতজনের আশায়  বসে থাকে, যেখানেই দু’চারজন লোক তা পরিচিতি কিংবা অপরিচিত সেখানেই ছুটে যান । তারাও কাছে দাড়াতে দেন না , স্বাস্থ্য বিধিমত ৩ ফুট দূরে দূরে  থাকতে হবে । ছেলেটা  সিগারেট কোম্পানীর ভ্যান চালিয়ে দিনে দু’শো টাকা পেতো , এখন সেটাও বন্ধ । পলাশীর বাবার দোকান চলে না , নিজের কোনো কাজ নেই । লোকমুখে শুনে সরকার চাল-ডাল-তেল-আলু-লবণ-সাবান দিবে , কিছুই পাচ্ছে না , আশায় থাকে হয়তো এগুলো আসতেও পারে  । হয়ত বেশি আসলে ’নামসই’  লাগতে পারে । দুজনে আবারও স্বাক্ষর চর্চা করে  নেয়, ওদের ভাষায় ‘ঝালাই’  করে  নেয়া ।

পলাশীর বাবা সারাদিন মাঠটার এপ্রান্ত সেপ্রান্ত বসে থেকে বিরক্ত হয়ে সন্ধ্যায় অদ্ভুত একটি মজা করে । মজা করে বলা যাবে না , মশার বিরক্তিকর গুন গুনানী আর কামড় থেকে মুক্তির জন্য  উঠানটার শেষ প্রান্তে যেখানে ঘরের বারান্দার পৈঠা সেখানে বসে আগুন জ্বালিয়ে দেয় । পলাশীর মায়ের কাজ হলো খড়কুটো জমিয়ে সেখানে দেয়া, না হলে বিশ্রিভাষায় গালি দিয়ে হৈচৈ বাঁধিয়ে দেয় । পলাশীর মা এখন আর রিটার্ণ খিস্তি  প্রয়োগ  করে  না, সময়টা খুব খারাপ চলছে । পলাশীর বাবার হাতে আকিজ কোম্পানীর বিড়ি, সেটা দিয়েই ফিল্টারওয়ালা সিগারেটের মতো আয়েশ করে টান দিয়ে খক খক করে  কাশি দেয় , অনেকদিন হলো বিড়ি টান দিলেই কাশি হয় । ছেলেটা বার বার নিষেধ করেছে – ‘আর বিড়ি খাইও না’। অনেকদিনের অভ্যাস ছাড়তে পারে  না , বহু কষ্টে শেখা আগুন ধরানোর কৌশল প্রয়োগ করে  বিড়ি ধারিয়ে আয়েশ করে  সুখ টান দেয় ।

সেদিন সকাল থেকেই বেশ গরম। দুপুরের পর থেকে আকাশে মেঘ , বিকেলে উত্তর-পশ্চিম কোণ কালো হয়ে গেলো ।  বাতাস নেই  , সবকিছু যেনো থমকে আছে । বৃষ্টিতে ভিজে যেতে পারে , জিসিপত্র যার যার মতো নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে গেল ।  পলাশীর মা  শুকনো লাকড়ী কিংবা আরও প্রয়োজনীয় সামগ্রীগুলো ঘরে  নেয়ার ফাঁকে স্বভাব সূলভ সই অদ্ভুত খিস্তি আওড়ে আজ একটু জোড় গলায় বললেন,“পলাশীর বাপ, আইজ আগুন ধরাইও না কইয়া দিলাম ”। পলাশীর মা বার বার নিষেধ করার পরও সন্ধ্যায় কিছু খড়-কুটো একত্র করে  পলাশীর বাবার উদ্ভাবিত মশা তাড়ানোর কৌশল প্রয়োগ করলেন । পৈঠায় বসে বিড়ি ধরিয়ে আয়েশ করে  টান দিচ্ছে । প্রকৃতি সারাদিন কোনো সাড়া শব্দ না দিলেও সাঁঝ বেলায় আর চুপ থাকলো না । বেশ কিছু সময় নিয়েই জানান  দিচ্ছিল, আমি আস্ছি। পশ্চিম থেকে বাতাস উঠে এলো,  সবকিছু উড়িয়ে নেয়ার মতো এলোমেলো দমকা হাওয়া , ধুলা বালিতে চারদিক একাকার । চোখ বন্ধ করতে হলো , কোন্ দিকের বাতাস বুঝার উপায় নেই । প্রতিবেশিরা যার যার মতো নিজ নিজ ঘরে, বাইরে আগুন নেভানোর আপ্রাণ চেষ্টায় পলাশীর বাবা-মা। আগুন ছড়িয়ে গেলো চারদিক , পলাশীর মা দৌড়ে পানির কলস খুঁজতে গেলো । রান্নাঘরে অন্ধকারে  আর ধুলাবালিতে কিছুই দেখা গেল না । তার একটি চোখের সমস্যা, চোখে ছানি পড়েছে । অনেকবার চেষ্টা করেছে অপারেশন করানোর , টাকা জোগাড় করতে পারেনি । পায়ের ধাক্কায়  কলস কাত হয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে গেলো । পলাশীর বাবার চিৎকার, “ঘরে  আগুন ধইরা গেলো” । পলাশীর মা বাইরে এসে দেখে সর্বনাশ যা হবার হয়ে গেছে,ঘরের বেড়ায়-চালে আগুন। দৌড়ে ঘরের ভিতর গিয়ে কিছু সামগ্রী আনার চেষ্টা করলো । আগুনের তাপে কাছে যাওয়া যায় না , কাপড়ে ধরে যেতে পারে ,কখন ভিতরে চলে গেছে বলতে পারবেন না – ডান হাতের আঙ্গুল গুলো অবশ হয়ে আসছে, পা দুটো চলতে চায় না , এটুকুই মনে আছে।

বাতাসের গতি কমে বৃষ্টি নেমে এলো, আশপাশের লোকজন আগুন দেখে নেভানোর চেষ্টা করছে অবশিষ্ট যদি কিছু থাকে । শেষ পর্যন্ত যা রক্ষা করা গেল তা অনেক কিছুই, তবে ঘরে বসবাসের সুযোগ  নেই । নিখিল ফ্যাল ফ্যাল করে  তাকিয়ে আছে, পলাশীর মা চোখ মেলে আবার বিলাপ করে করে অদ্ভুত খিস্তি দিয়ে যাচ্ছে । পলাশীর মাকে হাসপাতালে নেয়া প্রযোজন, তার ডানহাত আর পা অনেকটা ঝলসে গেছে।

রাত পেরিয়ে  সকালে স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর, মেয়র সাহেব, উপজেলার পি আই অফিসার সহ আরও কিছু লোকজন আসলেন । সরেজমিনে পরিদর্শন শেষে তারা একটি ফরম বের করলেন , সেখানে একটি স্বাক্ষর দিতে হবে । পলাশীর মায়ের যে ঘরে আগুন লাগলো সেখানে একটি নতুন টিনের ঘর তৈরি করে দেয়া হবে, আরও কিছু সহযোগিতাও  পাবেন ।  সহযোগিতা পেতে হলে নাম সাইন করতে হবে । পলাশীর মাতো সেটা জানেন, তাইতো তিনি এতো কষ্ট করে নাম লেখা শিখেছেন। তার ডান হাত সম্পূর্ণই ব্যান্ডেজ করা ,নাম লেখা সম্ভব নয়। পলাশীর বাবা দিলেও হবে না , কারণ এর আগে সমস্ত কাগজপত্র পলাশীর মায়ের নামেই জমা করা আছে । আকাশ ভেঙ্গে পড়লো মাথায় , এতো বার রপ্ত করে  নাম লেখাটা শিখলেন, আজ একটি সাইনের জন্য কী ঘর পাওয়া হবে না ?

যা হয় হবে, ব্যান্ডেজ খুলে ফেললেন এক ঝটকায় , হাতে দগদগে পোড়া ঘা, অসহ্য যন্ত্রনায় সমস্ত শরীর শিউরে উঠছে । আঁচড়গুলো মনে করতে পারছেনা,যন্ত্রণায় কুকড়ে যাচ্ছে হাত – নাম লেখাটা ঠিকমতো হচ্ছে না । চেখে কিছুই দেখছে না , চারদিক অন্ধকার – হঠাৎ আলোর ঝলকানি , মনে হচ্ছে সামনে চকচকে টিনের ঘর । নিজেকে সামলে রাখতে পারলেন না, মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন । কালো ঠোঁট দুটো কাপছে, কিছু বলার চেষ্টা করছেন।

সেদিন অনেকেই শুনেছেন – পলাশীর মা বিরবির করে  বলছেন, ‘আমার ঘর নাইগ্বো, থাহনের নিগা একখান ঘর’।

লেখকঃ সিনিয়র শিক্ষক

ট্যাগ:

পলাশীর মা

প্রকাশ: ০৩:০৮:৩৬ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৮ ডিসেম্বর ২০২০
সুভাষ কুমার রায়: পরিচিত কিংবা অপরিচিত দু’চারজন লোক দেখলে সেখানেই পলাশীর মা গিয়ে হাজির। যদি কোনো সুসংবাদ থাকে, অর্থাৎ, যদি রিলিফের কোনো সংবাদ থাকে! – যাকে আমরা প্রধানমন্ত্রীর উপহার  বলে জানি। স্কুল বন্ধ, যেখানে তিনি একটি ছোট দোকানে বাচ্চাদের খাবার বিক্রি করতেন! স্কুলে ঝাড়– দেয়ার  কাজটিও নেই! পলাশীর বাবার চানাচুর বাদামের দোকানও বন্ধ!

পলাশীর মা নামেই তিনি পরিচিত। প্রকৃত নামটা শুনলেও অনেকেরই মনে নেই । তবে কেউ যে জানেন না এমন নয় । নামটি রয়েছে ভোটার লিষ্টে, জাতীয় পরিচয় পত্রে আর  বয়স্ক ভাতার কার্ডে । কার্ড আছে একবারও ভাতা তুলতে পারেন নি , কারণ অজানা । ভোটার তালিকায় নাম আছে , ভোটের আগে প্রার্থীর লোকজন  বাড়িতে এসে ভোটার নাম্বার দিয়ে যায়  অথবা বাড়িতে না থাকলে জোড় গলায় ডেকে একটি সুগন্ধী সাবান বা কাপড় কাচার পাউডার কিংবা একটি আটার প্যাকেট   দিয়ে যায় । যথা সময়ে বাড়ির দোড়গোড়ায় রিক্শা অথবা ব্যাটারি চালিত গাড়ি এসে ডাক পড়ে – শান্তি রানী ভোট দিতে চলেন । তিনি এবং তার স্বামী নিখিল একটু পরিষ্কার কাপড় পরে ভোট দিতে যান । ভোটের লাইনে দাঁড়ানোর আগে সামিয়ানার নিচে এসে বসেন যেখানে চেয়ার পাতা আছে , চায়ের ব্যবস্থা আছে ,চাইলে পান কিংবা একটি সিগারেটও পাওয়া যায় । পলাশীর মায়ের পানের অভ্যাস নেই তবে পলাশীর বাবার ধোঁয়ার নেশাটা আছে । ধোঁয়ার সামগ্রী যখন তিনি নিজের পকেটের টাকা দিয়ে  কিনেন তখন আকিজ ম্যানুফ্যাক্সারিংয়ের বিড়ি কিনেন কিন্তু ভোটের সময় ফিল্টারওয়ালা সাদা রংয়ের লম্বা সিগারেট পকেটে থাকে । দুজনে দুকাপ ’র’ চা খেয়ে  চেয়ারে  আরাম করে  বসেন, এখনতো বেশ খাতির যতœ আছে,তাই কেউ উঠিয়ে দেবার সম্ভাবনা নেই । পলাশীর বাবা এবার সিগারেট ধরালেন । তিনি একটায় মাথায় আগুন ধরিয়ে আর একটি পকেটে রাখেন । সিগারেটের মাথায় ম্যাচ বা দিয়াশলাই দিয়ে আগুন ধরানো বেশ কঠিন কাজ , অনেক ছোট সময়ে তিনি এটি রপ্ত করেছেন । বাতাস থেকে আগুনটা আড়াল করে  হাতটা মুঠি করে একটি দিক দিয়ে আগুনটা দেখা যায়, সেখানে সিগারেটের অগ্রভাগ ভিতরে দিয়ে কাজটি সম্পন্ন করতে হয় । তার শেখা এই শৈল্পিক গুণটা আজ সম্পূর্ণই কাজে লাগিয়ে সিগারেট ধরিয়ে বেশ আরাম করে  ধোঁয়া বের করলেন, বিড়ি থেকে সিগারেটে কাশিটা একটু কম হয় । আজ  কেউ বলছেনা তোমরা উঠে যাও, অন্যসময়ে এসব লোকগুলোর সামনে চেয়ারে বসে থাকা সম্ভব নয়।

এবারও তিনি ঘর পাওয়ার আশায় আছেন, সকল প্রার্থীর কাছেই ঘরের দাবী তোলেন ।প্রতিবারই প্রার্থীর কর্মীরা এসে তাকে ঘর দেয়ার আশ্বাস দিয়ে  যায়। দুজন মেয়র বদল হলো , দুবারই ভাঙা ঘরসহ তার ছবি তোলা হয়েছিল।  ফরমে নাম লেখা,  জমির কাগজ দেয়া – সবই হলো , ঘরের একটি খুটি  কিংবা একটি টিনও চোখে দেখা গেলো না ।  গত ভোটের আগে কাউন্সিলর প্রার্থী আশ্বাস দিয়েছিলেন পাস করার পরই তার ঘরের কাজটি সবার আগে করে  দিবেন , কিন্তু পলাশীর মায়ের ভাগ্য এতো সুপ্রসন্ন নয় , তিনি সফল হতে  পারেন নি । ছোট সময় থেকে এই একটি কথা অনেকবার শুনেছেন, “ ভাগ্য ভালো না” । বোকা টাইপের একজনের সাথে বিয়ে হলো – এটা  তার ভাগ্য । পলাশীর বাবা সম্পত্তির ভাগটা বুঝে নিতে পারেন না এটা তার ভাগ্য, বাজারে  বা মেলায় বাদাম চানাচুর  ভালো বিক্রি হয় না এটা তার ভাগ্য, গরু ছাগল পালন করতে গিয়ে অসুখে মরে  যায় এটাও তার ভাগ্য ,  ছোট সময়ে পড়ালেখা হলো না  এটিও তার ভাগ্য।

ফরমে নাম স্বাক্ষরটা জরুরী । অনেক কষ্ট করে তিনি এটি শিখেছেন , নয়তো বয়স্ক ভাতার কার্ড হবে না, দুটি ঈদে চাল পাবার কথা তাও পাওয়া যাবে না,এনজিও থেকে  ঋণও পাওয়া যাবে না । এনজিওর লোকগুলো  টাকা দেয়ার সময় খুব ভালো ব্যবহার করে  , ভোটওয়ালাদের  মতো । যেই কিস্তির তারিখ দু’একদিন দেরী হলো অমনি তাদের  আসলরূপ দেখা যায় ।

অনেক কষ্টে শেখা নামটি মাঝে মাঝেই ভুলে যায় । একটি কাগজে নামটা লিখে তোষকের নিচে  পানি নিরোধক কাগজ যাকে  আমরা পানি কাগজ বলে থাকি, তাই দিয়ে মুড়িয়ে রেখে দিয়েছে । ভুলে গেলেই বের করে  নাম লেখাটা আবার ঝালাই করে  নেয় অথবা বলা যায় যখনই কোনো কিছু পাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয় তখনই আবার রপ্ত করে  নেয় । এখন আবার কাগজটি বের করে  লেখাটার চর্চা করলেন, বলাতো যায় না কখন লেগে যায় । পলাশীর বাবারটাও বের করে দিলেন । তিনি বলতে পারবেন না কোন বর্ণটা কী , স্বর বর্ণ বা ব্যঞ্জনবর্ণ কিংবা কোন কার (আকার , ই-কার) কিছুই জানেন না শুধু আঁচড়গুলো মনে রাখেন । প্রথমটায় দুটি গোল গোল দাগ আছে তারপর একটি দাগ আছে , তার পর মাথার উপর ছাতার মতো তার নিচে মোড়গের ঠোঁটের নিচে পেটমাটা গোল মত – শেষেরটা বেশ জটিল , এটিই মনে থাকে না । বার বার দেখে দেখে লিখতে হয় । পলাশীর বাবারটাও বেশ কঠিন । প্রথমটা ও শেষেরটা সহজেই হয়ে যায় মাঝেরটা জটিল । পলাশীর মা যে স্কুলটার সামনে ছোট একটি দোকান চালায় , সপ্তাহে একদিন স্কুলটা ঝাড়– দেয় ছেলেটা সেই স্কুলে ক্লাস থ্রি অবধি পড়েছিল । ছেলেটিই  নামদুটো শিখিয়েছে । স্যারের কাছ  থেকে দুটি শক্ত কাগজে  একটু পরিস্কার এবং সুন্দর করে নাম দুটো  লিখিয়ে নিয়েছে । এরপর থেকে ছেলেটিই প্রতি রাতে দু-একবার করে  চর্চা করাতো ।

অভাবের সংসারে দুজনকেই কাজ করতে হয় । স্কুলের পাশে পলাশীর মায়ের বাচ্চাদের খাবারের দোকান , বাজারে রাস্তার পাশে খোলা জায়গায় পলাশীর বাবার বাদাম – চানাচুরের দোকান । পলাশীর বাবার দোকান রোববার বৃহস্পতিবার এবং মৌসুমী মেলার মধ্যেই সীমিত ছিল। এখন প্রতিদিন বিকেলে ব্রীজের পশ্চিম পাশটায় রোদটাকে পিঠের  দিকে দিয়ে দোকান মেলে বসে । ভালোই বিক্রি হয় । আগে সপ্তাহে দু’দিন বাদাম ভেজে প্যাকেট করতে হতো এখন প্রতিদিনই বাদাম ভেজে প্যাকেট করতে হয় । সম্প্রতি ব্রীজের মধ্যে  বেড়ানোর জোয়ার সৃষ্টি হয়েছে । প্রথমদিকে অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা বেড়াতো , এখন সব বয়সী লোকজন বেড়াতে যায়।

কিন্তু সব বন্ধ হয়ে গেলো । প্রথম প্রথম দোকান নিয়ে বাজার কিংবা ব্রীজের পাশে দোকান মেলে বসতো । লোকজনের ভির নেই । যাও দু’চারজন আসে তারাও বাইরের খাবার খেতে চায় না ।‘করোনা’ , এটা নাকি শুধু বাংলাদেশে নয়, সব দেশেই হয়েছে। এক সময় পলাশীর মাকে মাটি কাটার দলে কাজ করতে হয়েছে । তখন শরীরে শক্তি ছিল , এখন আর কোদালে কোপ দিতে পারে না, বুকে ব্যথা হয় । কাজটিতে একটু সুবিধা ছিল , দিনে আট ঘন্টা কাজ । ওদের  ঘন্টার হিসেবটা বেশ মজার  ,ভোরের আযান থেকে দুপুরের আযান পর্যন্ত  ।

শীত গ্রীষ্মের তারতম্যে কর্মঘন্টা একটু এদিক ওদিক হলেও মজুরীটা একই রকম। কাজ শেষে দুপুরে বাড়ীতে গেলে তখন মেজাজটা খিটকিটে হয়ে থাকতো । ভোরে একটি বোলে পান্তা আর বাশী তরকারী নয়তো কাঁচামরিচ পিয়াজ সংগে নিতো । দুপুরে স্নান শেষে রান্না করে  তবে খাওয়া। সকালে বাজার করা ছোট,পচা কিংবা একটু কম দামে কেনা সামুদ্রিক  মাছের ঝোল রান্না করতে হবে ।‘বলদা’কে মনের ঝাল মিটিয়ে কয়েকটি অদ্ভুত খিস্তি দিয়ে রান্না করতে যেতেন । বলদা ওনার স্বামীর ডাক নাম, ছোট থেকে এ নামেই সবাই ডেকে থাকে । দুপুরের খাবার খেতে খেতে পরবর্তী আযান হয়ে যেতো । হাটবার অর্থাৎ রোববার – বৃহস্পতিবার পলাশীর বাবা দু’চারটে রিটার্ণ খিস্তি দিতে কসুর করতো না । সেদিন একটু আগেভাগে খেয়ে বাদামের প্যাকেট নিয়ে হাটে যেতে হবে , তবেইনা ভালো বিক্রি হবে ।

দিনগুলোতো  ভালোই ছিল।  আর্থিক দৈন্যতা থাকলেও দিনে একবার অন্তত চুলা জ্বলতো । দুপুরে রান্না করে  , দুপুর – রাতে খাবার পর ভাতে পানি দিয়ে সকালের পান্তা । মাঝে মাঝে ছেলেটা পান্তা খেতে বিরক্ত হতো , তখন তাকে ১৫/২০টা টাকা দিতে হতো । বাজারে গিয়ে হোটেল থেকে দুটি তেলের পরোটা এবং ডাল-ভাজি দিয়ে নাস্তা সেরে  আসতো । পালাশীর বাবাও মাঝে মাঝে খেতো , পলাশীর মায়েরও মাঝে মাঝে ইচ্ছে হতো , ইচ্চাটা পূরণ হতে সময় নিয়েছিল অনেকটা বছর । এইতো ক’দিন আগে বছরের শুরুতে স্কুলের ছাত্রছাত্রী সহ সবাই মিলে সাফারী পার্কে পিকনিকে গেল। তাকেও সংগে নিয়ে গিয়েছিল । সকালের নাস্তা ছিল দোকান থেকে কেনা দুটি তেলেভাজা পরোটা আর ডাল-ভাজি। প্যাকেট বেশি হওয়ায় দুটি পেয়ে  মনভরে  খেয়েছিল ।

সবকিছু বন্ধ হবার পর ক’দিন তো ভালোই চলছিল , এখন আর চলে না । একবার রান্না করে তিনবার খাওয়া সে-তো আর হয় না । কতজনের আশায়  বসে থাকে, যেখানেই দু’চারজন লোক তা পরিচিতি কিংবা অপরিচিত সেখানেই ছুটে যান । তারাও কাছে দাড়াতে দেন না , স্বাস্থ্য বিধিমত ৩ ফুট দূরে দূরে  থাকতে হবে । ছেলেটা  সিগারেট কোম্পানীর ভ্যান চালিয়ে দিনে দু’শো টাকা পেতো , এখন সেটাও বন্ধ । পলাশীর বাবার দোকান চলে না , নিজের কোনো কাজ নেই । লোকমুখে শুনে সরকার চাল-ডাল-তেল-আলু-লবণ-সাবান দিবে , কিছুই পাচ্ছে না , আশায় থাকে হয়তো এগুলো আসতেও পারে  । হয়ত বেশি আসলে ’নামসই’  লাগতে পারে । দুজনে আবারও স্বাক্ষর চর্চা করে  নেয়, ওদের ভাষায় ‘ঝালাই’  করে  নেয়া ।

পলাশীর বাবা সারাদিন মাঠটার এপ্রান্ত সেপ্রান্ত বসে থেকে বিরক্ত হয়ে সন্ধ্যায় অদ্ভুত একটি মজা করে । মজা করে বলা যাবে না , মশার বিরক্তিকর গুন গুনানী আর কামড় থেকে মুক্তির জন্য  উঠানটার শেষ প্রান্তে যেখানে ঘরের বারান্দার পৈঠা সেখানে বসে আগুন জ্বালিয়ে দেয় । পলাশীর মায়ের কাজ হলো খড়কুটো জমিয়ে সেখানে দেয়া, না হলে বিশ্রিভাষায় গালি দিয়ে হৈচৈ বাঁধিয়ে দেয় । পলাশীর মা এখন আর রিটার্ণ খিস্তি  প্রয়োগ  করে  না, সময়টা খুব খারাপ চলছে । পলাশীর বাবার হাতে আকিজ কোম্পানীর বিড়ি, সেটা দিয়েই ফিল্টারওয়ালা সিগারেটের মতো আয়েশ করে টান দিয়ে খক খক করে  কাশি দেয় , অনেকদিন হলো বিড়ি টান দিলেই কাশি হয় । ছেলেটা বার বার নিষেধ করেছে – ‘আর বিড়ি খাইও না’। অনেকদিনের অভ্যাস ছাড়তে পারে  না , বহু কষ্টে শেখা আগুন ধরানোর কৌশল প্রয়োগ করে  বিড়ি ধারিয়ে আয়েশ করে  সুখ টান দেয় ।

সেদিন সকাল থেকেই বেশ গরম। দুপুরের পর থেকে আকাশে মেঘ , বিকেলে উত্তর-পশ্চিম কোণ কালো হয়ে গেলো ।  বাতাস নেই  , সবকিছু যেনো থমকে আছে । বৃষ্টিতে ভিজে যেতে পারে , জিসিপত্র যার যার মতো নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে গেল ।  পলাশীর মা  শুকনো লাকড়ী কিংবা আরও প্রয়োজনীয় সামগ্রীগুলো ঘরে  নেয়ার ফাঁকে স্বভাব সূলভ সই অদ্ভুত খিস্তি আওড়ে আজ একটু জোড় গলায় বললেন,“পলাশীর বাপ, আইজ আগুন ধরাইও না কইয়া দিলাম ”। পলাশীর মা বার বার নিষেধ করার পরও সন্ধ্যায় কিছু খড়-কুটো একত্র করে  পলাশীর বাবার উদ্ভাবিত মশা তাড়ানোর কৌশল প্রয়োগ করলেন । পৈঠায় বসে বিড়ি ধরিয়ে আয়েশ করে  টান দিচ্ছে । প্রকৃতি সারাদিন কোনো সাড়া শব্দ না দিলেও সাঁঝ বেলায় আর চুপ থাকলো না । বেশ কিছু সময় নিয়েই জানান  দিচ্ছিল, আমি আস্ছি। পশ্চিম থেকে বাতাস উঠে এলো,  সবকিছু উড়িয়ে নেয়ার মতো এলোমেলো দমকা হাওয়া , ধুলা বালিতে চারদিক একাকার । চোখ বন্ধ করতে হলো , কোন্ দিকের বাতাস বুঝার উপায় নেই । প্রতিবেশিরা যার যার মতো নিজ নিজ ঘরে, বাইরে আগুন নেভানোর আপ্রাণ চেষ্টায় পলাশীর বাবা-মা। আগুন ছড়িয়ে গেলো চারদিক , পলাশীর মা দৌড়ে পানির কলস খুঁজতে গেলো । রান্নাঘরে অন্ধকারে  আর ধুলাবালিতে কিছুই দেখা গেল না । তার একটি চোখের সমস্যা, চোখে ছানি পড়েছে । অনেকবার চেষ্টা করেছে অপারেশন করানোর , টাকা জোগাড় করতে পারেনি । পায়ের ধাক্কায়  কলস কাত হয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে গেলো । পলাশীর বাবার চিৎকার, “ঘরে  আগুন ধইরা গেলো” । পলাশীর মা বাইরে এসে দেখে সর্বনাশ যা হবার হয়ে গেছে,ঘরের বেড়ায়-চালে আগুন। দৌড়ে ঘরের ভিতর গিয়ে কিছু সামগ্রী আনার চেষ্টা করলো । আগুনের তাপে কাছে যাওয়া যায় না , কাপড়ে ধরে যেতে পারে ,কখন ভিতরে চলে গেছে বলতে পারবেন না – ডান হাতের আঙ্গুল গুলো অবশ হয়ে আসছে, পা দুটো চলতে চায় না , এটুকুই মনে আছে।

বাতাসের গতি কমে বৃষ্টি নেমে এলো, আশপাশের লোকজন আগুন দেখে নেভানোর চেষ্টা করছে অবশিষ্ট যদি কিছু থাকে । শেষ পর্যন্ত যা রক্ষা করা গেল তা অনেক কিছুই, তবে ঘরে বসবাসের সুযোগ  নেই । নিখিল ফ্যাল ফ্যাল করে  তাকিয়ে আছে, পলাশীর মা চোখ মেলে আবার বিলাপ করে করে অদ্ভুত খিস্তি দিয়ে যাচ্ছে । পলাশীর মাকে হাসপাতালে নেয়া প্রযোজন, তার ডানহাত আর পা অনেকটা ঝলসে গেছে।

রাত পেরিয়ে  সকালে স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর, মেয়র সাহেব, উপজেলার পি আই অফিসার সহ আরও কিছু লোকজন আসলেন । সরেজমিনে পরিদর্শন শেষে তারা একটি ফরম বের করলেন , সেখানে একটি স্বাক্ষর দিতে হবে । পলাশীর মায়ের যে ঘরে আগুন লাগলো সেখানে একটি নতুন টিনের ঘর তৈরি করে দেয়া হবে, আরও কিছু সহযোগিতাও  পাবেন ।  সহযোগিতা পেতে হলে নাম সাইন করতে হবে । পলাশীর মাতো সেটা জানেন, তাইতো তিনি এতো কষ্ট করে নাম লেখা শিখেছেন। তার ডান হাত সম্পূর্ণই ব্যান্ডেজ করা ,নাম লেখা সম্ভব নয়। পলাশীর বাবা দিলেও হবে না , কারণ এর আগে সমস্ত কাগজপত্র পলাশীর মায়ের নামেই জমা করা আছে । আকাশ ভেঙ্গে পড়লো মাথায় , এতো বার রপ্ত করে  নাম লেখাটা শিখলেন, আজ একটি সাইনের জন্য কী ঘর পাওয়া হবে না ?

যা হয় হবে, ব্যান্ডেজ খুলে ফেললেন এক ঝটকায় , হাতে দগদগে পোড়া ঘা, অসহ্য যন্ত্রনায় সমস্ত শরীর শিউরে উঠছে । আঁচড়গুলো মনে করতে পারছেনা,যন্ত্রণায় কুকড়ে যাচ্ছে হাত – নাম লেখাটা ঠিকমতো হচ্ছে না । চেখে কিছুই দেখছে না , চারদিক অন্ধকার – হঠাৎ আলোর ঝলকানি , মনে হচ্ছে সামনে চকচকে টিনের ঘর । নিজেকে সামলে রাখতে পারলেন না, মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন । কালো ঠোঁট দুটো কাপছে, কিছু বলার চেষ্টা করছেন।

সেদিন অনেকেই শুনেছেন – পলাশীর মা বিরবির করে  বলছেন, ‘আমার ঘর নাইগ্বো, থাহনের নিগা একখান ঘর’।

লেখকঃ সিনিয়র শিক্ষক