সাদিয়া রহমান: সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা রঙিন সবুজাভ পৃথিবীর স্বপ্ন কে না দেখে? পৃথিবীর সবুজ রঙ আমাদেরকে সবসময়ই আকৃষ্ট করে! শিশির ভেজা সবুজ ঘাসে আবৃত মাঠ কিংবা সবুজের ঢেউ খেলানো বিশাল বৃক্ষরাজি -সবুজের সমারোহ সবসময়ই আমাদেরকে মনোরাজ্যের অন্য এক ভূবনে প্রবেশ করতে বাধ্য করে!
কিন্তু ইদানীংকালে, বিশেষত একবিংশ শতাব্দীর এই জগতে, বিশ্ব পরাশক্তি দেশ সমূহের কার্বনে মত্ত বিশ্ব বাণিজ্যের হার-জিত খেলায় সবুজ পৃথিবীর অস্তিত্ব রক্ষার যে হুমকির মুখে আমরা রয়েছি, তার সুষ্ঠু সমাধান না ঘটলে সম্পূর্ণ প্রাণীকূলই অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়তে বাধ্য। ইংরেজিতে একটি জনপ্রিয় প্রবাদ প্রচলিত রয়েছে, “Lives are crying because it’s not clean/Earth is dying because it’s not green…!”
মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ -সব ভাবেই বিভিন্ন প্রয়োজনের জন্য উদ্ভিদের উপর নির্ভরশীল। তাই এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশসমূহের সাধারণ মানুষদেরই এগিয়ে আসতে হবে।
শুধু মানুষের প্রয়োজনের হিসেব না কষেও সহজেই বলা যায়, জীবন ধারণের জন্য মানুষ যেসব প্রাণীর উপর নির্ভরশীল, সেগুলোও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সবুজ উদ্ভিদের উপরই নির্ভর করে! সকল প্রাণীরই প্রাথমিক খাদ্য সবুজ গাছপালা থেকেই উতপাদিত হয়।
তাছাড়া উদ্ভিদজাত পন্যগুলিও আমাদের নিয়মিত চাহিদার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। গাছ-গাছালির বিভিন্ন অংশ ব্যবহার করে আমরা নিজেদের প্রয়োজনীয় নানান চাহিদাই পূরণ করে থাকি। উদ্ভিদজাত পণ্য, যেমন, শাক-সবজি, ফলমূল, প্রয়োজনীয় তেল, মশলা, পানীয় এবং এরকম আরও অনেক কিছুই রয়েছে, যেসব ব্যাতীত আমাদের নিত্যদিনকার জীবনে অচলাবস্থার তৈরী হবে।
যেহেতু ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্ব জনসংখ্যা ৯ বিলিয়ন ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করা হয়, তাই এই বিশাল পরিমাণ মানুষের খাদ্য এবং স্বাস্থ্য নিরাপত্তার কথা ভেবে উদ্ভিদ/বৃক্ষরাজির উৎপাদন বাড়ানোর উদ্যোগে এখনই নিতে হবে। আজকের আমার এই লিখাটির মূল উদ্দেশ্যও এটি।
উদ্ভিদের বৃদ্ধি, বিকাশ, শস্য ফলন -ইত্যাদির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে সার, যা উদ্ভিদকে পুষ্টি জোগায়। আমাদের সমাজে নানা ধরণের সারই পাওয়া যায়। প্রশ্ন হচ্ছে আমরা কোনটির ব্যবহারে বেশি গুরুত্ব দেবো? এক্ষেত্রে সহজ উত্তর হতে পারে, জৈব সার। জৈব সার একই সঙ্গে যেমন পরিবেশ বান্ধব, তেমনই মাটির জন্য উপকারী। তাই জৈব সারের গুণগত পরিকল্পিত ব্যপক ব্যবহার আমাদেরকে খুব সহজেই বেশি পরিমাণে উদ্ভিদ লাগানোয় এবং পরিচর্যায় উতসাহী করে তুলতে পারে। এক্ষেত্রে সবার প্রথমে যে প্রশ্ন আসে, তা হচ্ছে জৈব সার ব্যবহারের খরচ কেমন হবে এবং একদমই সাধারণ্যে তার ব্যয়ভার বহযোগ্য কী না?!
এই প্রশ্নের একটি সহজ সুন্দর সমাধান হচ্ছে, রান্নাঘরের উচ্ছিষ্ট ব্যবহার করেই আমরা নিজেদের গাছের স্বাস্থ্যকর বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে পারি, যা মাটিতে জৈব সার হিসেবে যুক্ত হবে। প্রাকৃতিক এবং সহজলভ্য কিছু জিনিস ব্যবহার করে বাড়িতেই উপকারী এবং পরিবেশবান্ধব জৈব সার তৈরির সহজ কিছু উপায় রয়েছে।
বিভিন্ন রকমের ফল এবং শাকসবজির খোসা, ডিমের খোসা, ব্যবহার করা টি ব্যাগ কিংবা গুড়ো চা ইত্যাদি থেকে আমরা খুব সহজেই জৈব সার পেতে পারি। এমনকি এই জিনিসগুলোকে সার এ রূপান্তর করতে কিংবা ব্যবহারের জন্য খুব বেশি সময় ব্যয় করারও প্রয়োজন নেই। তবে কোনভাবেই রোগাক্রান্ত গাছ কিংবা মাংসজাতীয় পদার্থের বর্জ্য কম্পোস্ট সার তৈরিতে ব্যবহার করা যাবে না। কারণ এদের থেকে রোগ-ব্যধি ছড়াতে পারে
রান্নাঘর থেকে ফেলে দেওয়া এই বাড়তি জিনিসগুলিকে একটি পুষ্টিকর জৈব সারে রূপান্তর করা সম্ভব, যা শাকসব্জী বা ফুল এর বৃদ্ধি বাড়ানোর জন্য মাটিতে ব্যবহার করা যেতে পারে। উপরোক্ত অপ্রয়োজনীয় বস্তুগুলো থেকে উৎপন্ন জৈব সার যদি ধারাবাহিকভাবে ব্যবহার করা যায়, তবে মাটির ফসফেট, পটাসিয়াম এবং ক্যালসিয়াম একটি উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি হবে, যা শেষ পর্যন্ত আমাদের প্রিয় গাছগুলির সঠিক বৃদ্ধি এবং গাছে বেশি পরিমানে ফুল ফলের ধরতে সহায়তা করবে। নিচে এ ব্যাপারে সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরা হলো।
ব্যবহৃত টি ব্যাগ/ চা পাতা:
তাজা কিংবা ব্যবহৃত চা পাতায় ট্যানিক অ্যাসিড (ট্যানিন) থাকে, যা মাটিতে যুক্ত হয়ে মাটিতে নাইট্রোজেনের স্তর বাড়িয়ে তোলে এবং গাছের জন্য উর্বর পরিবেশ তৈরি করে। চা পাতায় প্রাকৃতিক জৈব পদার্থের উপস্থিতির কারণে এটি উদ্ভিদের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টির স্তর বৃদ্ধি করে এবং সাথে মাটির গুণগত মান বাড়ায়। এর ফলে কেঁচো এবং অন্যান্য উপকারী অণুজীব আকৃষ্ট হয় এবং তাদের ক্রিয়াকলাপের মাত্রা বৃদ্ধি পায়।
নাইট্রোজেন গাছের বৃদ্ধি, বিকাশের জন্য খুবই প্রয়োজনীয় একটি উপাদান। নাইট্রোজেন পৃথিবীর সর্বাধিক প্রচুর উপাদানগুলির মধ্যে একটি হওয়া সত্ত্বেও, নাইট্রোজেনের ঘাটতি সম্ভবত বিশ্বব্যাপী উদ্ভিদের উপর প্রভাবিত সবচেয়ে সাধারণ সমস্যা। বায়ুমণ্ডল এবং পৃথিবীর ভূত্বক থেকে নাইট্রোজেন গাছগুলিতে সরাসরি পাওয়া যায় না।সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, উদ্ভিদে নাইট্রোজেনের ঘাটতি হলে ক্লোরোফিল উৎপাদন ব্যাহত হয় এবং এতে করে উদ্ভিদের খাদ্য প্রস্তুত বাধাগ্রস্ত হয়। রাসায়নিক সারের চেয়ে জৈব সারের মাধ্যমে মাটিতে নাইট্রোজেন যুক্ত করা পরিবেশের জন্যও নিরাপদ।
ব্যবহারের সঠিক নিয়ম:
টি ব্যাগ কিংবা চা পাতা ব্যবহারের পর তা ভালোভাবে ঠান্ডা পানিতে ধুয়ে অন্যান্য উপাদান (আদা, এলাচ, দারচিনী, তেজপাতা ইত্যাদি যদি থাকে) থেকে আলাদা করে নিন। তারপর তা একদিন রোদে শুকিয়ে নিয়ে সংরক্ষন করুন। এই শুকনো চা পাতা এমনিতেও গাছের গোড়ায় ব্যবহার করতে পারেন কিংবা চা পাতা, ডিমের খোসার শুকনো গুড়ো এবং কলার খোসার গুড়োর সাথে সমপরিমানে মিশিয়ে মাসে একবার ব্যবহার করুন । গাছে ফুল কিংবা ফুল ধরার পূর্বে এদের ২:১:২ অনুপাতে মিশিয়ে গাছের গোড়ায় দিয়ে ব্যবহার করতে পারেন। এগুলো মাটিতে দেবার আগে মাটি প্রয়োজন মতো আলগা করে নিন এবং সার মেশানোর পর গাছের গোড়ায় পানি দিন ।
ডিমের খোসা:
ডিমের খোসা ৯৫% এরও বেশি খনিজ দ্বারা গঠিত। মূলত ক্যালসিয়াম কার্বনেট (৩৭%), যা উদ্ভিদের বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান। ডিমের খোসায় ফসফরাসও রয়েছে প্রচুর পরিমাণে। ফসফরাস ফল এবং ফুলের গাছকে ভীষনভাবে প্রভাবিত করে। এদের মূল এবং কান্ডের বৃদ্ধির জন্য ফসফরাস আবশ্যক। এটি পরাগায়ন এবং বীজের অঙ্কুরোদগম ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গাছগুলিতে প্রচুর ফুল এবং ফল উৎপাদন করতে ফসফরাস সাহায্য করে থাকে। এছাড়াও ডিমের খোসায় রয়েছে ম্যাগনেসিয়াম, পটাসিয়াম এবং আয়রন ।
ব্যবহারের সঠিক নিয়ম:
কয়েকদিনের ডিমের খোসা জমিয়ে রেখে প্রথমে সেগুলোকে ভালো করে ধুয়ে, রোদে শুকিয়ে নিতে হবে । তারপর এগুলিকে পিষে গুঁড়ো করতে নিয়ে সংরক্ষন করা যাবে বেশ কিছুদিন । এরপর গাছের প্রয়োজনমতো সেগুলিকে ব্যবহার করা সম্ভব হবে ।
কলার খোসা:
কলার খোসাগুলিতে প্রায় ৪২ শতাংশ পটাসিয়াম থাকে। পটাশিয়াম -গাছের বৃদ্ধিতে সরাসরি প্রভাব ফেলে। ক্ষতিকর পোকামাকড় এর বিরুদ্ধে লড়াই এর জন্য গাছের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। ফল বিকাশে সাহায্য করে থাকে। একটি উদ্ভিদে থাকা প্রায় ৫০ রকমের এনজাইম নিয়ন্ত্রণ করে।
আবহাওয়া ঠান্ডা বা শুকনো থাকাকালীন পটাশিয়াম উদ্ভিদকে রক্ষা করে। কলার খোসা পটাশিয়াম ছাড়াও ক্যালসিয়াম এবং ম্যাঙ্গানিজেও সমৃদ্ধ। কলার খোসা সাধারনত টমেটো এবং মরিচের মতো ফলের গাছগুলির জন্য দুর্দান্ত সার হতে পারে।
ব্যবহারের সঠিক নিয়ম:
১. কলার খোসা পানিতে এক বা দুই দিন ভিজিয়ে রাখুন। তারপরে সেই পানি আপনার গাছপালার গোড়ায় ব্যবহার করুন।
২. কলার খোসার সবটুকু অংশ ব্যবহার করতে চাইলে কলার খোসাগুলিকে কেটে নিন। কাটা এই টুকরো ওভেনে কিংবা রোদে শুকিয়ে নিন। তারপরে সেগুলোকে গাছের গোড়ায় ব্যবহার করুন। এতে করে প্রয়োজনীয় উপাদানগুলোর সঙ্গে সঙ্গে ঐ মাটিতে পানি ধারন ক্ষমতা বাড়বে।
পেঁয়াজের খোসা:
প্রায় সব ধরনের গাছের জন্য পটাসিয়াম সমৃদ্ধ সার তৈরি করতে এটি ব্যবহার করুন। এতে ব্যবহারে গাছের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি হবে, কান্ড শক্তিশালী হবে এবং উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। পেঁয়াজের খোসার তৈরি সার ক্যালসিয়াম, আয়রন, ম্যাগনেসিয়াম এবং কপার সমৃদ্ধ হয়।
ব্যবহারের সঠিক নিয়ম:
২-৩ মুঠো পেঁয়াজের খোসা নিয়ে ২৪ ঘন্টা ধরে ১ লিটার পানিতে ভিজিয়ে রাখুন। পানি রঙিন এবং ঘন হলে, খোসা থেকে পানি আলাদা করে ফেলুন। গাছপালাতে এই পানীর সারটি মাসে ৩-৪ বার ব্যবহার করুন।
কমলার খোসা:
কমলা খোসাতে ডি-লিমোনিন নামে একটি রাসায়নিক থাকে যা প্রাকৃতিক কীটনাশক হিসেবে ব্যবহার করা যায়। এটি এফিড এবং পিঁপড়ার মতো কীটপতঙ্গগুলির স্নায়ুতন্ত্রকে ক্ষতিগ্রস্থ করে, তাদের হত্যা করে। পোকার সমস্যা আছে এমন গাছের আশেপাশে খোসা রাখতে পারেন বা স্প্রে করতে পারেন।
ব্যবহারের সঠিক নিয়ম: কয়েকটি কমলার খোসা পানিতে দশ মিনিটের জন্য সেদ্ধ করুন । ঠান্ডা হলে পানি আলাদা করে স্প্রে বোতলে নিন এবং আপনার গাছপালা সপ্তাহে একবার স্প্রে করুন।
বেশিরভাগ মানুষই জমিতে রাসায়নিক সার ব্যবহার করে থাকেন। রাসায়নিক সার ফসলের দ্রুত বৃদ্ধি ঘটালেও মাটি তথা পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করে থাকে। কিন্তু একটু চেষ্টা করলেই বাসাবাড়ির ফলমূল ও শাক সবজী এবং প্রায় সকল ধরনের উচ্ছিষ্ট দিয়ে তৈরি করে ফেলতে পারেন জৈব সার। এতে করে টাকা খরচ না করেই পাওয়া যাবে গাছের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান এবং যা মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করবে, এমনকি পরিবেশকে ক্ষতির হাত থেকেও রক্ষা করতে পারবে।
আজকের লিখাটি শেষ করবো বীরেন্দ্র অধিকারীর একটি কবিতার মাধ্যমে,
“সবুজ পৃথিবী হৃদয়ে তোমার,
একটি বীজ বপন করো…।
জল সিঞ্চন করো তাতে,
অঙ্কুর গজাবে ত্বরাত্বরা…!!
বেড়ে উঠতে দাও সেথায় সার,
জৈবসারই উত্তম প্রাণবন্ত…!
বাড়ন্ত হবে, ডালপালা গজাবে,
গাছটা ভরে উঠবে সবুজ পাতায়…!
সমারোহ সবুজের ভেতর নিশ্চয়ই
ওরা আসবে…! ঝাঁকে ঝাঁকে বসবে…!
কোকিল ময়না টিয়া দোয়েল শ্যামা
কাকাতুয়া মাছরাঙা আরো কতো…!
মনের আনন্দে গাইবে,
জারি সারি ভাটিয়ালি দেশের গান…।।
তাতে প্রেমের পাখিরা নাছোড়বান্দা,
গদগদ প্রেম গীতরত…!!”
কবির এই লিখনীর মতোই সবুজ সমারোহে পাখির কলতানে ভরে উঠুক এই পৃথিবী, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক: সাদিয়া রহমান, শিক্ষার্থী, এগ্রিকালচার, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।