ফাহিম আহম্মেদ মন্ডল: জিভে জল আনা স্বাদের মুখরোচক খাবার রান্না করাটা বাঙালী মেয়েদের সহজাত এক গুণ। শখের বশেই অনেকে নানা ধরণের রেসিপি তৈরীর চেষ্টা করে থাকেন। তবে সেই শখকেই যদি কাজে লাগিয়ে বাড়তি কিছু অর্থ আয় করা যায়? ধারণাটি কিন্তু মোটেও অমূলক নয়! অসংখ্য মানুষ রয়েছেন, যারা তাঁদের উপার্জনের জন্য নিজের শখের কাজটিকেই বেছে নিয়েছেন। তেমনই একজন তরুণ নারী উদ্যোক্তাকে নিয়ে আজকের এই লিখাটি লিখতে চলেছি।
খাদিজা আক্তার ঋতু, পড়ছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আইবিএ তৃতীয় বর্ষে। পড়াশোনার পাশাপাশি টিউশন করিয়ে দিব্যি দিন কেটে যাচ্ছিলো তাঁর! কিন্তু করোনার ভয়াল থাবা সমাজের সকলের মতো ঋতুর জীবনেও একটি স্থবিরতা নিয়ে আসে। লকডাউনের ফেরে ক্যাম্পাস বন্ধের সঙ্গে সঙ্গে পড়াশোনার পাশাপাশি টিউশন গুলোও বন্ধ হয়ে যায়। ফিরে যান নিজ গ্রামে। কার্যত বেকার এবং অলস সময়টা বড্ড বেশিই হাপিয়ে তুলেছিলো ঋতুকে! তখনই ঋতুর নজরে আসে গ্রামের বেশ কিছু কর্মক্ষম বেকার নারী, যারা অলস বসে থেকে নিজেদের সময় এবং মেধা দুটোই নষ্ট করছিলো। তখনই এই মহিলাদেরকে সঙ্গে করে কিছু একটা করার বাসনা মনে দোল খেলে যায় ঋতুর।
যেই ভাবনা, সেই কাজ! গ্রামের এই মহিলাদেরকে সঙ্গে নিয়েই সম্পূর্ণ ঘরোয়াভাবে নানা জাতের মিষ্টি, দই সহ মুখরোচক বিভিন্ন খাবারের আইটেম তৈরী করে তা হোম ডেলিভারীর একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম তৈরী করে ফেলেন আইবিএ’র চৌকস শিক্ষার্থী ঋতু। আর সেই প্ল্যাটফর্মটির নাম দিয়েছেন “রসদ।”
‘রসদ’ নিয়ে পরের গল্পটি শুনা যাক সরাসরি ঋতুর মুখেই,
“সাধারণত অবসর সময়ে আমরা আনন্দ ও উৎসাহের সাথে যেসব সৌখিন কাজ করে থাকি, সেগুলো থেকেই শখের উৎপত্তি। স্কুলে পড়ার সময় থেকেই মিষ্টি জাতীয় নানা ধরণের আইটেম রান্না করাটা আমার সেরকমই একটি শখ। কোভিড-১৯ এর আক্রমণে গোটা বিশ্বেই সাধারন মানুষের জনজীবন স্থবির হয়ে পড়েছিলো। স্বাভাবিক অবস্থায় আমি ছাত্র পড়িয়েই স্বানন্দ্যে দিন কাটাচ্ছিলাম। কিন্তু করোনার গ্রাসে সবকিছু বন্ধ হয়ে যাওয়াতে পড়াশোনার পাশাপাশি সেসব টিউশনও হাতছাড়া হয়ে যায়। বাড়িতে বসে সম্পূর্ণই অলস সময় কাটাচ্ছিলাম। তখনই হঠাত আমার গ্রামের কিছু মহিলাকে দেখতে পাই যারা উপার্জনক্ষম কিন্তু সুযোগ না পাওয়ায় নিজেদের সহজাত প্রতিভা মেলে ধরার সুযোগ পাচ্ছেন না। তাঁদের জন্য কী করা যায় ভাবতে ভাবতেই প্রথম মিষ্টি জাতীয় জিনিস তৈরী ও হোম ডেলিভারীর অনলাইন প্ল্যাটফর্ম তৈরীর কথা মনে আসে।
বিষয়টি কিছু কাছের বন্ধু এবং পরিবারের সাথে শেয়ার করার পর তারাও সার্বিক সমর্থনে দেয়। আর আইবিএ শিক্ষার্থী হওয়ার সুবাদে নিজেই কিছুদিন সময় নিয়ে মার্কেট সম্পর্কে ধারণা নেয়ার চেষ্টা করি। সে থেকেই রসদ -এর যাত্রা শুরু।
সার্বিক দিক বিবেচনা পূর্বক যখন প্রথম কাজে হাতে দিলাম, তখনও কিন্তু বেশ ভয়ে ভয়েই ছিলাম। কিন্তু শুরুর পর থেকে এখনও অবধি সবাই বিষয়টিকে যেভাবে গ্রহণ করেছেন এবং সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন, পাশাপাশি সবার থেকে যে পরিমাণ উৎসাহ পাচ্ছি, তা সত্যিই অভাবনীয়। আমরা ইতোমধ্যে অনেকগুলো অর্ডার পেয়েছি এবং সেগুলোর ডেলিভারীও দিয়েছি। সবচেয়ে ভালো দিক হচ্ছে, সবাই খাবারগুলো পছন্দ করছে, প্রশংসা করছে!”
‘কিন্তু মহিলাদের উপার্জনের কথা ভেবে মিষ্টির হোম ডেলিভারী দেয়ার কথাটিই মাথায় আসলো কেন?’ – প্রশ্ন ছুড়ে দিলাম। জবাবে ঋতু বলেন,
“মূলত আমাদের গ্রামটি সাভারের অদূরে ফোর্ডনগর। এখানে বেশ সহজেই গরুর দুধ পাওয়া যায় এবং এখানে গরুর ঘানিও রয়েছে। তাছাড়া গ্রামের এসব মহিলাদেরকে কাজে লাগাতে হলে তাঁরা সহজে করতে পারবে, পারদর্শী এবং উৎসাহ বোধ করবে এমন কাজই দিতে হবে। আর মিষ্টি বানানোর প্রতি আমার নিজস্ব একটি ঝোঁক ত ছেলেবেলা থেকে রয়েছেই। আপনি যখন শখকে কাজে লাগিয়ে উপার্জনও করতে পারবেন, তখন কাজের স্পৃহাও বেড়ে যায় কয়েকগুণ। সব মিলিয়েই আসলে ‘রসদ’ এর পথচলার শুরু।”
জানতে চাইলাম, “বর্তমানে কী কী জিনিস পাওয়া যাচ্ছে ঋতুর রসদে?’’ জবাবে ঋতুর উত্তর,
“আমি কাজ শুরু করেছিলাম মূলত মিষ্টি তৈরী দিয়েই। কিন্তু কাস্টমারদের চাহিদা এবং রিভিউ মাথায় রেখে আমরা বর্তমানে আমাদের সাপ্লাই লাইন বাড়িয়ে দিয়েছি। বর্তমানে আমি কাজ করছি, মালাই চপ, রসমালাই, দই, ঘি, নাড়ু, কালোজিরে এবং ঘানিতে ভাঙানো সরিষার তেল নিয়ে।”
লকডাউনে ঘরে বসে অলস সময় পার করা সকল তরুণদের উদ্দেশ্যে ঋতুর বক্তব্য,
“আমি সবসময়ই চেয়েছি নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে কিছু করতে। নিজেকেই নিজের সবচেয়ে অবলম্বন করে চলতে। বর্তমান যুগের সাথে তাল মিলিয়েই নিজেকে আত্মনির্ভরশীল করে এগোতে হবে এবং আমি তা সবসময়ই বিশ্বাস করে এসেছি এবং কাজেও বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছি। তাই আমার সমবয়সী কিংবা ছোট-বড় সকল ভাইবোনদের উদ্দেশ্যেই আমি সবসময় বলতে চাই, নিজের প্যাশনকে ফলো করুন। প্রয়োজন যেমন উদ্ভাবনের জনক, তেমনই ইচ্ছে থাকলেই উপায় হয়!”
ঋতুর ‘রসদ’ -এ প্রাপ্ত সামগ্রীর দাম ও তালিকা:
- মালাই চপ – ৫৫০/- প্রতি কেজি
- রসমালাই – ৫০০/- প্রতি কেজি
- সরিষার তেল – ৩০০/- প্রতি কেজি ( ঘানিতে ভাঙানো)
- সরিষার তেল – ১৯০/- প্রতি কেজি (মেশিনে ভাঙানো)
- কালোজিরা তেল- ১৬০/- (১০০ গ্রাম)
- তিলের তেল- ৭০/- (১০০ গ্রাম)
- নাড়ু- ১০ টাকা প্রতি পিছ
- জাফরানভোগ – ৬০০/- টাকা কেজি ঘি- ১২০০ টাকা কেজি
‘রসদ’ থেকে কোনো জিনিস অর্ডার করতে যোগাযোগ করুন: 01624-951150
‘রসদ’ এর ফেসবুক পেইজ লিঙ্ক: https://www.facebook.com/roughshod/