Dhaka 2:13 pm, Thursday, 30 November 2023

  • Notice: Trying to access array offset on value of type int in /home/nabajugc/public_html/wp-content/themes/NewsFlash-Pro/template-parts/page/header_design_two.php on line 68

ইতিহাসের স্রষ্টা কিংবদন্তী আবুল কালাম শামছুদ্দীন

  • Reporter Name
  • Update Time : 04:25:30 pm, Thursday, 5 September 2019
  • 68 Time View

ফাহিম আহম্মেদ মন্ডল: ভারতীয় উপমহাদেশ ভাগ হয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি এবং সেখান থেকে পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় – প্রতিটি ঘটনাই আমাদের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং তা আমাদের গৌরবময় সংগ্রামী অতীতকে স্মরণ করিয়ে দেয় প্রতিনিয়ত। জাতিগত ঐতিহ্য এবং জাত্যাভিমানের যে গৌরব-গরীমা ও প্রতিষ্ঠা আমাদের রয়েছে, তা ধরে রেখে সামনে এগিয়ে যেতে হলেও আমাদেরকে আমাদের ইতিহাস জানতে হবে, সঠিক ইতিহাস মূল্যায়ণ করতে হবে। যারা এই ইতিহাসের স্রষ্টা, তাদেরকে সম্মান জানাতে হবে। সে প্রচেষ্টা থেকেই আজকের এই নিবন্ধটি লিখা এবং লিখছি ইতিহাসের আড়ালে রয়ে যাওয়া এক নাম, জনাব আবুল কালাম শামছুদ্দীনকে নিয়ে।

বর্তমান সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা, বিভিন্ন পারিপার্শিকতা ও সময়ের নির্মম পরিহাসের কারণে এ মহান ব্যাক্তি অনেকটাই আড়াল হয়ে আছেন ইতিহাসের পাতায়! কিন্তু তিনি নিজেই এক সময় সৃষ্টি করেছেন ইতিহাস। পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির অন্যতম প্রধান কর্মী ও কারিগর এই মহান ব্যাক্তি একাধারে ছিলেন একজন সাহিত্যিক, সমালোচক, সাংবাদিক এবং রাজনীতিবিদ।

১৮৯৭ সালের ৩ নভেম্বর ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালের ধানীখোলা গ্রামে তাঁর জন্ম। সমসাময়িক আরেকজন কিংবদন্তী ব্যাক্তিত্ব আবুল মনসুর আহম্মেদ তাঁর বাল্যবন্ধু ছিলেন। শিক্ষাজীবনে ১৯১৭ সালে কৃতিত্বের সাথে মেট্রিকুলেশন পাশ করার পর তিনি ১৯১৯ সালে ঢাকা কলেজ থেকে আইএ পাস করেন এবং পরবর্তীতে কলকাতাঁর রিপন কলেজে বিএ শ্রেণীতে ভর্তি হন।

কিন্তু সে সময় মুসলিম জাহানের খিলাফত রক্ষায় আলী ভ্রাতৃদ্বয় (মুহম্মদ আলী ও শওকত আলী), মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, ড. এম. এ আনসারী ও হসরত মোহানীর নেতৃত্বে ভারতে ‘খিলাফত আন্দোলন’ এবং জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ড ও ১৯১৯ সালের ‘রাওলাট অ্যাক্ট’-কে সরকারি নির্যাতনের প্রমাণরূপে চিহ্নিত করে এর প্রতিবাদে মহাত্মা গান্ধী কতৃক পরিচালিত অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে তিনি তাতে যোগ দেন এবং বিএ  পরীক্ষা না দিয়ে কলকাতাঁর গৌড়ীয় সুবর্ণ বিদ্যায়তন থেকে ‘উপাধি’  পরীক্ষা (১৯২১) পাস করেন।

এরপর কংগ্রেসের ‘ব্যাক টু ভিলেজ’ নীতি মেনে কিছুদিনের জন্য তিনি নিজ শহর ময়মনসিংহ ফিরে আসেন এবং এখানে নিজ গ্রামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। এসময়ই তিনি নিজ এলাকায় রাজনৈতিক ও সামাজিক বিভিন্ন সংগঠন গড়ে তুলেন এবং রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী হয়ে উঠেন। বৃহত্তর ময়মনসিংহের সাধারন নাগরিকদের কাছে তৎকালীন  সময়ে আবুল কালাম শামছুদ্দীন আইকন স্বরূপ বিবেচিত হতে থাকেন। উপমহাদেশে ছাত্ররাজনীতির ভিত্তি প্রতিষ্ঠার অন্যতম দিকপাল এই মহান পুরুষ।

আবুল কালাম শামছুদ্দীন একাধারে রাজনীতি ও সাহিত্য রচনা করলেও সুধী সমাজে তাঁর মূল পরিচয় ছিল সাংবাদিক হিসেবে।  ১৯২২ সালে “মাসিক মোহাম্মদী” পত্রিকার সহযোগী সম্পাদক হিসেবে তাঁর সাংবাদিকতা জীবন শুরু হয়। পরবর্তীতে তিনি ‘সাপ্তাহিক মোসলেম জগৎ’, ‘দি মুসলমান’, ‘দৈনিক সোলতান’, ‘মাসিক মোহাম্মদী’ সহ প্রভৃতি পত্রিকা সম্পাদনা করেন। এরপর ১৯৩৬ সালে তিনি দৈনিক আজাদে যোগদান করেন এবং একাধারে ১৯৪০-৬২ সাল পর্যন্ত এই জনপ্রিয় ও পাঠক নন্দিত পত্রিকাটির সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।

‘দৈনিক আজাদ’  ছিল তৎকালীন  ভারতবর্ষের সবচেয়ে জননন্দিত ও প্রচারিত বাংলা পত্রিকা এবং পাকিস্তান আন্দোলনে জনমত সৃষ্টি করায় অপ্রতিদ্বন্দী। চল্লিশের দশকের তৎকালীন সময়ে কলকাতা থেকে পরিচালিত অন্য সকল নামকরা হিন্দি, উর্দু ও ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত পত্রিকার পাশাপাশি এগুলোকে টেক্কা দেয়ার মতো একমাত্র বাংলা দৈনিক ছিলো “দৈনিক আজাদ”! ‘আজাদে’র আরো একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল কলকাতা থেকে প্রকাশিত হলেও এর খবরাখবর ছিল মূলত ঢাকা ভিত্তিক বা ঢাকা প্রধান। তাই যেকোনো ব্যাপারে সাধারণ জনগণ, বিশেষত পূর্ব বাংলার জনগনের জনমত তৈরীতে দৈনিক আজাদের ভূমিকা ছিল অপরিসীম, অতুলনীয় এবং গ্রহনযোগ্যও বটে। মূলত তাঁরই একক প্রচেষ্টায় ‘আজাদে’র লেখনীর মাধ্যমে পূর্ব বাংলার লাখো লোক পাকিস্তান আন্দোলনে সহমত পোষণ করেন। তাঁর বাল্যবন্ধু আবুল মনসুর আহম্মেদ এক লেখনীতে বলেছিলেন,

“মূলত আবুল কালাম শামছুদ্দীনের প্রচার-প্রচারণা এবং বুঝানোতেই আমি পাকিস্তান আন্দোলনের ঘোর বিরোধী থেকে ঘোর সমর্থক ও পরবর্তীতে একনিষ্ঠ কর্মীতে পরিনত হই!”

তাঁর সম্পাদিত পত্রিকার প্রচার-প্রচারণাতেই ছেচল্লিশের নির্বাচনে সমগ্র বাংলায় মুসলিম লীগের অভূতপূর্ব সাফল্য ধরা দেয়! আর এ নির্বাচনে মুসলিম লীগের জয়লাভই একটি শত কোটি বছর বয়সের রাষ্ট্র ভেঙে নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের জন্ম ঘটায়। এরপর ১৯৬৪ সালে তিনি ‘প্রেস ট্রাস্ট অব পাকিস্তান’ পরিচালিত ‘দৈনিক পাকিস্তান’-এর সম্পাদক নিযুক্ত হয়ে ১৯৭২ সালে অবসর গ্রহণ করেন।

রাজনীতিতে  তাঁর অংশগ্রহনের শুরুটা ছিলো নাটকীয়তায় ভরা। পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ডের ঘটনায় তিনি রাজনৈতিকভাবে সচেতন হয়ে ওঠেন এবং মহাত্মা গান্ধীর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে কংগ্রেসে যোগ দেন। এরপর ১৯২৭ সালে তিনি মুসলিম লীগের সদস্যপদও লাভ করেন। ১৯৪২ সালে কলকাতায় ‘পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটি’  গঠিত হলে তিনি এর সভাপতিরূপে  পাকিস্তান আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ১৯৪৬ সালে মুসলিম লীগের মনোনয়ন নিয়ে তিনি ময়মনসিংহ থেকে “ভারতীয় কেন্দ্রীয় আইন পরিষদ” এর সদস্য নির্বাচিত হন।

পাকিস্তান আন্দোলনের অন্যতম প্রধান একজন চালক হিসেবে পাকিস্তানের রাজনীতিতেও তিনি এক বিশিষ্ট ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। নতুন এ রাষ্ট্রটি সৃষ্টির পরপরই ভাষার প্রশ্নে দ্বন্দ্বের দেখা দিলে তিনি রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে মতামত দেন এবং ১৯৪৯ সালে পূর্ববঙ্গ সরকারের ভাষা-কমিটির সদস্য হন।

১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে তিনি আইন পরিষদের সদস্যপদ  ও মুসলিম লীগ সংসদীয় পার্টি  থেকে পদত্যাগ করেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে প্রথমবার যে শহীদ মিনার নির্মিত হয়, আবুল কালাম শামসুদ্দীন তাঁর উদ্বোধন করেন। এসময় ভাষা আন্দোলন নিয়ে তাঁর সম্পাদিত পত্রিকা ‘দৈনিক আজাদ’ থেকে একটি অনুসন্ধান চালানো হয় এবং ১ মার্চ, ১৯৫২ তে সেই অনুসন্ধানী রিপোর্টটি প্রকাশিত হয়। এতে পূর্ব পাকিস্তান সরকারের রোষানলে পড়েন তিনি। তবু তিনি দমে যাননি এবং একই পন্থায় পরবর্তী সময়ে তিনি আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।

১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হলে শেরে-বাংলা, মাওলানা ভাসানী এবং সোহরাওয়ার্দী সম্মিলিতভাবে তাঁকে যুক্তফ্রন্টে আসার অনুরোধ জানান এবং যুক্তফ্রন্টের মনোনয়নে নির্বাচন করার প্রস্তাব রাখেন। কিন্তু তিনি মুসলিম লীগের নীতির পরিবর্তন দলের ভেতর থেকেই করার পক্ষে মত দেন এবং হার নিশ্চিত জেনেও মুসলিম লীগের মনোনয়নেই নির্বাচনে প্রার্থীতা করেন। নির্বাচনে তিনি তাঁর কাছের বন্ধু আবুল মনসুর আহম্মেদের কাছে পরাজিত হন।

আবুল কালাম শামছুদ্দীন একজন সফল সাহিত্যিকও ছিলেন। তাঁর রচিত ও অনূদিত কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: ‘পোড়োজমি বা অনাবাদী জমি (১৯৩৮)’, ‘ত্রিস্রোতা (১৯৩৯)’, “খরতরঙ্গ (১৯৫৩)”, ‘দৃষ্টিকোণ (১৯৬১)’, ‘নতুন চীন নতুন দেশ (১৯৬৫)’, ‘দিগ্বিজয়ী তাইমুর (১৯৬৫)’, ‘ইলিয়ড (১৯৬৭)’, “পলাশী থেকে পাকিস্তান (১৯৬৮)”, ‘অতীত দিনের স্মৃতি (১৯৬৮)’ ইত্যাদি।

আত্মজীবনী হিসেবে ‘অতীত জীবনের স্মৃতি’ তাঁর উৎকৃষ্ট রচনা। দেশ, সমাজ ও সংস্কৃতি সম্পর্কে তাঁর এ গ্রন্থ প্রত্যক্ষদর্শীর দলিল হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। তিনি পাকিস্তান সরকারের শোষণ ও দুর্নীতির তীব্র বিরোধিতা করলেও উপমহাদেশের ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় পাকিস্তানের অখন্ডতায় বিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলে পাকিস্তান সরকারের লোভনীয় প্রস্তাব ত্যাগ করেও তিনি বাংলার টানে বাংলাদেশে রয়ে যান এবং নবগঠিত দেশের ভিত্তি গঠনে ভূমিকা পালন করা শুরু করেন।

তাঁর বৈচিত্রময় জীবনের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি জীবনে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছেন। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, তিনি  পাকিস্তান সরকার কর্তৃক ‘সিতারা-ই-খিদমত (১৯৬১)’ এবং ‘সিতারা-ই-ইমতিয়াজ (১৯৬৭)’  উপাধিতে ভূষিত হন। কিন্তু ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানের সময় তিনি সরকারি দমননীতির প্রতিবাদে উভয় খেতাব বর্জন করেন।  ১৯৭০ সালে তিনি ‘বাংলা একাডেমী পুরস্কার’ এবং ১৯৭৬ সালে ‘একুশে পদক’ লাভ করেন।

১৯৭৮ সালের ৪ মার্চ ঢাকায় ৮১ বছর বয়সে এ মহান ব্যাক্তির জীবনাবসান ঘটে এবং সমাপ্তি ঘটে কালের স্বাক্ষী এক প্রবাদপুরুষের।

তথ্যসূত্র : ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’, ‘বাংলাপিডিয়া’, আবুল কালাম শামছুদ্দীনের চিঠি সমগ্র”।  

Tag :

Notice: Trying to access array offset on value of type int in /home/nabajugc/public_html/wp-content/themes/NewsFlash-Pro/template-parts/common/single_two.php on line 177

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

Popular Post

Notice: Undefined index: footer_custom_code in /home/nabajugc/public_html/wp-content/themes/NewsFlash-Pro/footer.php on line 87

ইতিহাসের স্রষ্টা কিংবদন্তী আবুল কালাম শামছুদ্দীন

Update Time : 04:25:30 pm, Thursday, 5 September 2019

ফাহিম আহম্মেদ মন্ডল: ভারতীয় উপমহাদেশ ভাগ হয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি এবং সেখান থেকে পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় – প্রতিটি ঘটনাই আমাদের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং তা আমাদের গৌরবময় সংগ্রামী অতীতকে স্মরণ করিয়ে দেয় প্রতিনিয়ত। জাতিগত ঐতিহ্য এবং জাত্যাভিমানের যে গৌরব-গরীমা ও প্রতিষ্ঠা আমাদের রয়েছে, তা ধরে রেখে সামনে এগিয়ে যেতে হলেও আমাদেরকে আমাদের ইতিহাস জানতে হবে, সঠিক ইতিহাস মূল্যায়ণ করতে হবে। যারা এই ইতিহাসের স্রষ্টা, তাদেরকে সম্মান জানাতে হবে। সে প্রচেষ্টা থেকেই আজকের এই নিবন্ধটি লিখা এবং লিখছি ইতিহাসের আড়ালে রয়ে যাওয়া এক নাম, জনাব আবুল কালাম শামছুদ্দীনকে নিয়ে।

বর্তমান সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা, বিভিন্ন পারিপার্শিকতা ও সময়ের নির্মম পরিহাসের কারণে এ মহান ব্যাক্তি অনেকটাই আড়াল হয়ে আছেন ইতিহাসের পাতায়! কিন্তু তিনি নিজেই এক সময় সৃষ্টি করেছেন ইতিহাস। পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির অন্যতম প্রধান কর্মী ও কারিগর এই মহান ব্যাক্তি একাধারে ছিলেন একজন সাহিত্যিক, সমালোচক, সাংবাদিক এবং রাজনীতিবিদ।

১৮৯৭ সালের ৩ নভেম্বর ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালের ধানীখোলা গ্রামে তাঁর জন্ম। সমসাময়িক আরেকজন কিংবদন্তী ব্যাক্তিত্ব আবুল মনসুর আহম্মেদ তাঁর বাল্যবন্ধু ছিলেন। শিক্ষাজীবনে ১৯১৭ সালে কৃতিত্বের সাথে মেট্রিকুলেশন পাশ করার পর তিনি ১৯১৯ সালে ঢাকা কলেজ থেকে আইএ পাস করেন এবং পরবর্তীতে কলকাতাঁর রিপন কলেজে বিএ শ্রেণীতে ভর্তি হন।

কিন্তু সে সময় মুসলিম জাহানের খিলাফত রক্ষায় আলী ভ্রাতৃদ্বয় (মুহম্মদ আলী ও শওকত আলী), মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, ড. এম. এ আনসারী ও হসরত মোহানীর নেতৃত্বে ভারতে ‘খিলাফত আন্দোলন’ এবং জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ড ও ১৯১৯ সালের ‘রাওলাট অ্যাক্ট’-কে সরকারি নির্যাতনের প্রমাণরূপে চিহ্নিত করে এর প্রতিবাদে মহাত্মা গান্ধী কতৃক পরিচালিত অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে তিনি তাতে যোগ দেন এবং বিএ  পরীক্ষা না দিয়ে কলকাতাঁর গৌড়ীয় সুবর্ণ বিদ্যায়তন থেকে ‘উপাধি’  পরীক্ষা (১৯২১) পাস করেন।

এরপর কংগ্রেসের ‘ব্যাক টু ভিলেজ’ নীতি মেনে কিছুদিনের জন্য তিনি নিজ শহর ময়মনসিংহ ফিরে আসেন এবং এখানে নিজ গ্রামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। এসময়ই তিনি নিজ এলাকায় রাজনৈতিক ও সামাজিক বিভিন্ন সংগঠন গড়ে তুলেন এবং রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী হয়ে উঠেন। বৃহত্তর ময়মনসিংহের সাধারন নাগরিকদের কাছে তৎকালীন  সময়ে আবুল কালাম শামছুদ্দীন আইকন স্বরূপ বিবেচিত হতে থাকেন। উপমহাদেশে ছাত্ররাজনীতির ভিত্তি প্রতিষ্ঠার অন্যতম দিকপাল এই মহান পুরুষ।

আবুল কালাম শামছুদ্দীন একাধারে রাজনীতি ও সাহিত্য রচনা করলেও সুধী সমাজে তাঁর মূল পরিচয় ছিল সাংবাদিক হিসেবে।  ১৯২২ সালে “মাসিক মোহাম্মদী” পত্রিকার সহযোগী সম্পাদক হিসেবে তাঁর সাংবাদিকতা জীবন শুরু হয়। পরবর্তীতে তিনি ‘সাপ্তাহিক মোসলেম জগৎ’, ‘দি মুসলমান’, ‘দৈনিক সোলতান’, ‘মাসিক মোহাম্মদী’ সহ প্রভৃতি পত্রিকা সম্পাদনা করেন। এরপর ১৯৩৬ সালে তিনি দৈনিক আজাদে যোগদান করেন এবং একাধারে ১৯৪০-৬২ সাল পর্যন্ত এই জনপ্রিয় ও পাঠক নন্দিত পত্রিকাটির সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।

‘দৈনিক আজাদ’  ছিল তৎকালীন  ভারতবর্ষের সবচেয়ে জননন্দিত ও প্রচারিত বাংলা পত্রিকা এবং পাকিস্তান আন্দোলনে জনমত সৃষ্টি করায় অপ্রতিদ্বন্দী। চল্লিশের দশকের তৎকালীন সময়ে কলকাতা থেকে পরিচালিত অন্য সকল নামকরা হিন্দি, উর্দু ও ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত পত্রিকার পাশাপাশি এগুলোকে টেক্কা দেয়ার মতো একমাত্র বাংলা দৈনিক ছিলো “দৈনিক আজাদ”! ‘আজাদে’র আরো একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল কলকাতা থেকে প্রকাশিত হলেও এর খবরাখবর ছিল মূলত ঢাকা ভিত্তিক বা ঢাকা প্রধান। তাই যেকোনো ব্যাপারে সাধারণ জনগণ, বিশেষত পূর্ব বাংলার জনগনের জনমত তৈরীতে দৈনিক আজাদের ভূমিকা ছিল অপরিসীম, অতুলনীয় এবং গ্রহনযোগ্যও বটে। মূলত তাঁরই একক প্রচেষ্টায় ‘আজাদে’র লেখনীর মাধ্যমে পূর্ব বাংলার লাখো লোক পাকিস্তান আন্দোলনে সহমত পোষণ করেন। তাঁর বাল্যবন্ধু আবুল মনসুর আহম্মেদ এক লেখনীতে বলেছিলেন,

“মূলত আবুল কালাম শামছুদ্দীনের প্রচার-প্রচারণা এবং বুঝানোতেই আমি পাকিস্তান আন্দোলনের ঘোর বিরোধী থেকে ঘোর সমর্থক ও পরবর্তীতে একনিষ্ঠ কর্মীতে পরিনত হই!”

তাঁর সম্পাদিত পত্রিকার প্রচার-প্রচারণাতেই ছেচল্লিশের নির্বাচনে সমগ্র বাংলায় মুসলিম লীগের অভূতপূর্ব সাফল্য ধরা দেয়! আর এ নির্বাচনে মুসলিম লীগের জয়লাভই একটি শত কোটি বছর বয়সের রাষ্ট্র ভেঙে নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের জন্ম ঘটায়। এরপর ১৯৬৪ সালে তিনি ‘প্রেস ট্রাস্ট অব পাকিস্তান’ পরিচালিত ‘দৈনিক পাকিস্তান’-এর সম্পাদক নিযুক্ত হয়ে ১৯৭২ সালে অবসর গ্রহণ করেন।

রাজনীতিতে  তাঁর অংশগ্রহনের শুরুটা ছিলো নাটকীয়তায় ভরা। পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ডের ঘটনায় তিনি রাজনৈতিকভাবে সচেতন হয়ে ওঠেন এবং মহাত্মা গান্ধীর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে কংগ্রেসে যোগ দেন। এরপর ১৯২৭ সালে তিনি মুসলিম লীগের সদস্যপদও লাভ করেন। ১৯৪২ সালে কলকাতায় ‘পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটি’  গঠিত হলে তিনি এর সভাপতিরূপে  পাকিস্তান আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ১৯৪৬ সালে মুসলিম লীগের মনোনয়ন নিয়ে তিনি ময়মনসিংহ থেকে “ভারতীয় কেন্দ্রীয় আইন পরিষদ” এর সদস্য নির্বাচিত হন।

পাকিস্তান আন্দোলনের অন্যতম প্রধান একজন চালক হিসেবে পাকিস্তানের রাজনীতিতেও তিনি এক বিশিষ্ট ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। নতুন এ রাষ্ট্রটি সৃষ্টির পরপরই ভাষার প্রশ্নে দ্বন্দ্বের দেখা দিলে তিনি রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে মতামত দেন এবং ১৯৪৯ সালে পূর্ববঙ্গ সরকারের ভাষা-কমিটির সদস্য হন।

১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে তিনি আইন পরিষদের সদস্যপদ  ও মুসলিম লীগ সংসদীয় পার্টি  থেকে পদত্যাগ করেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে প্রথমবার যে শহীদ মিনার নির্মিত হয়, আবুল কালাম শামসুদ্দীন তাঁর উদ্বোধন করেন। এসময় ভাষা আন্দোলন নিয়ে তাঁর সম্পাদিত পত্রিকা ‘দৈনিক আজাদ’ থেকে একটি অনুসন্ধান চালানো হয় এবং ১ মার্চ, ১৯৫২ তে সেই অনুসন্ধানী রিপোর্টটি প্রকাশিত হয়। এতে পূর্ব পাকিস্তান সরকারের রোষানলে পড়েন তিনি। তবু তিনি দমে যাননি এবং একই পন্থায় পরবর্তী সময়ে তিনি আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।

১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হলে শেরে-বাংলা, মাওলানা ভাসানী এবং সোহরাওয়ার্দী সম্মিলিতভাবে তাঁকে যুক্তফ্রন্টে আসার অনুরোধ জানান এবং যুক্তফ্রন্টের মনোনয়নে নির্বাচন করার প্রস্তাব রাখেন। কিন্তু তিনি মুসলিম লীগের নীতির পরিবর্তন দলের ভেতর থেকেই করার পক্ষে মত দেন এবং হার নিশ্চিত জেনেও মুসলিম লীগের মনোনয়নেই নির্বাচনে প্রার্থীতা করেন। নির্বাচনে তিনি তাঁর কাছের বন্ধু আবুল মনসুর আহম্মেদের কাছে পরাজিত হন।

আবুল কালাম শামছুদ্দীন একজন সফল সাহিত্যিকও ছিলেন। তাঁর রচিত ও অনূদিত কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: ‘পোড়োজমি বা অনাবাদী জমি (১৯৩৮)’, ‘ত্রিস্রোতা (১৯৩৯)’, “খরতরঙ্গ (১৯৫৩)”, ‘দৃষ্টিকোণ (১৯৬১)’, ‘নতুন চীন নতুন দেশ (১৯৬৫)’, ‘দিগ্বিজয়ী তাইমুর (১৯৬৫)’, ‘ইলিয়ড (১৯৬৭)’, “পলাশী থেকে পাকিস্তান (১৯৬৮)”, ‘অতীত দিনের স্মৃতি (১৯৬৮)’ ইত্যাদি।

আত্মজীবনী হিসেবে ‘অতীত জীবনের স্মৃতি’ তাঁর উৎকৃষ্ট রচনা। দেশ, সমাজ ও সংস্কৃতি সম্পর্কে তাঁর এ গ্রন্থ প্রত্যক্ষদর্শীর দলিল হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। তিনি পাকিস্তান সরকারের শোষণ ও দুর্নীতির তীব্র বিরোধিতা করলেও উপমহাদেশের ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় পাকিস্তানের অখন্ডতায় বিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলে পাকিস্তান সরকারের লোভনীয় প্রস্তাব ত্যাগ করেও তিনি বাংলার টানে বাংলাদেশে রয়ে যান এবং নবগঠিত দেশের ভিত্তি গঠনে ভূমিকা পালন করা শুরু করেন।

তাঁর বৈচিত্রময় জীবনের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি জীবনে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছেন। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, তিনি  পাকিস্তান সরকার কর্তৃক ‘সিতারা-ই-খিদমত (১৯৬১)’ এবং ‘সিতারা-ই-ইমতিয়াজ (১৯৬৭)’  উপাধিতে ভূষিত হন। কিন্তু ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানের সময় তিনি সরকারি দমননীতির প্রতিবাদে উভয় খেতাব বর্জন করেন।  ১৯৭০ সালে তিনি ‘বাংলা একাডেমী পুরস্কার’ এবং ১৯৭৬ সালে ‘একুশে পদক’ লাভ করেন।

১৯৭৮ সালের ৪ মার্চ ঢাকায় ৮১ বছর বয়সে এ মহান ব্যাক্তির জীবনাবসান ঘটে এবং সমাপ্তি ঘটে কালের স্বাক্ষী এক প্রবাদপুরুষের।

তথ্যসূত্র : ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’, ‘বাংলাপিডিয়া’, আবুল কালাম শামছুদ্দীনের চিঠি সমগ্র”।