সাদিয়া রহমান: “চৈত্রেতে থর থর বৈশাখেতে ঝড় পাথর জ্যৈষ্ঠতে তারা ফুটে তবে জানবে বর্ষা বটে” – ক্ষণা। আবার, “কাগজ আবিষ্কারের পূর্বে মানুষ প্রেমের কবিতা লিখে রেখেছে মনের আকাশে। সেই ভালোবাসার কবিতা এই বৃষ্টি, এই ভরা বর্ষা!” – মহাদেব সাহা।
উপরের পঙক্তিগুলোতে ক্ষণা যে তারার কথা বলেছেন, কিংবা মহাদেব সাহা যে ভালোবাসার কবিতার কথা বলেছেন, বাস্তব জীবনে আমরা তার দেখা পাই আষাঢ়ে। আষাঢ়, বাংলা বর্ষ গণনার তৃতীয় মাস। নামটি এসেছে ‘পূর্বাষাঢ়া নক্ষত্র’ ও ‘উত্তরাষাঢ়া নক্ষত্র’ -র সূর্যের অবস্থান থেকে। রূপময় বর্ষার শুরুটাও হয় এ মাসেই! ইংরেজি ক্যালেন্ডারের সঙ্গে হিসেব মেলাতে গেলে প্রতি বছর ১৫ জুন তারিখটিকে পহেলা আষাঢ় হিসেবে ধরা হয়ে থাকে।
আষাঢ় মাসের সাধারণ পরিচিতি অঝোর ধারায় বৃষ্টিপাতের জন্য। এই মাস থেকেই ঝড়-বৃষ্টির শুরু হয় বলে গ্রীষ্মের প্রখর উত্তাপে শুষ্ক ও মৃতপ্রায় বৃক্ষলতা, তৃণ প্রভৃতি বর্ষার শীতল জলধারায় নবজীবন লাভ করে। তখন পল্লী প্রকৃতির সর্বত্র সবুজের সমারোহ দেখা যায়।
আষাঢ়ে চারদিকে পানি থৈ থৈ করে। নদী-নালা, খাল-বিল ও পুকুর-ডোবা কানায় কানায় ভরে ওঠে। বিলে বিলে হেলেঞ্চা ও কলমিলতার সমারোহ দেখা যায়। আরও দেখা যায় জাতীয় ফুল শাপলা-র সমারোহ। কেয়া, কামিনী, জুঁই, গন্ধরাজ প্রভৃতি সুগন্ধি ফুল প্রস্ফুটিত হয় এবং পেয়ারা, আনারস, বাতাবি লেবু প্রভৃতি ফল প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। এ সময় হাটে-বাজারে প্রচুর ইলিশ মাছও পাওয়া যায়।
তবে এসবের পাশাপাশি আষাঢ়ের কিছু বিশেষ পরিচিতিও রয়েছে। বাঙালি মননে সবচেয়ে বেশি রোমান্টিকতা-আধ্যাত্মিকতার সুর বেজেছে বর্ষায়। আষাঢ় মাস এলেই নাকি প্রেমিক মন কদম হাতে বৃষ্টির জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়ে! আষাঢ়ে যে বর্ষণধারার শুরু হয়, তাঁর রেশ প্রতিটি প্রেমিক মনেই পড়ে। সেই ছাপ আমরা লক্ষ্য করেছি বাংলা সাহিত্যের প্রধান প্রধান কবিদের বেলায়ও! সাহিত্যজুড়ে তারই তো প্রতিফলন। গানে-কবিতায় বাংলার কবিরা করেছেন আষাঢ়/বর্ষা বন্দনা।
বাংলার প্রধান কবি রবীন্দ্রনাথের অসংখ্য গান-কবিতায় বর্ষা ঝরছে অঝোর ধারায়। ‘বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল’ দিয়ে প্রেম নিবেদন সহ অসংখ্য কাব্য-গানে কবি নিয়ে এসেছেন তাঁর বর্ষা প্রেম। আষাঢ়কে ‘বাদলের পরী’ আখ্যা দিয়েছেন আরেক বাঙালী গ্রেট, আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তাছাড়া আমাদের অন্যান্য প্রধান কবিদের মাঝে বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, পল্লীকবি জসীমউদ্দীন সহ প্রায় সবাই নিজ নিজ পন্থায় আষাঢ়ের রূপ বর্ণনা করেছেন।
আষাঢ়ের বিশেষ রূপটি এখনকার তরুণদের মাঝেও সমানভাবে গভীর এবং দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে। আমিও তার ব্যতিক্রম নই। সেই ছোটবেলা থেকেই বর্ষা ঋতুর প্রতি একটি বিশেষ টান কাজ করে। বৃষ্টির রিমিঝিমি শব্দ ও কলতানের প্রতি আকর্ষণ দিনকে দিন শুধু তীব্র থেকে তীব্রতরই হয়েছে। এখনও আষাঢ়ের বৃষ্টিবেলায় এক কাপ চা হাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টির ধারাপতনের দৃশ্য অবলোকন কিংবা ভারী বর্ষণে মিষ্টি সুন্দর গানের মুর্ছনায় বৃষ্টি উপভোগ -মনকে গভীরভাবে দোলা দিয়ে যায়।
বিস্তর মাঠের সবুজ ঘাসে কিংবা মৃতপ্রায় নদীগুলোতে এক পশলা বর্ষণে আষাঢ়ের নান্দ্যনিক রূপের যে অদ্ভুত ফল হাতেনাতে পাওয়া যায়, তার তুলনা কেবল আষাঢ় নিজেই হতে পারে! আষাঢ়ের এই রঙিন রূপই বর্ষাকে করে তুলেছে প্রাণবন্ত, সতেজ ও শত সহস্র মনের প্রেম।
প্রতি বছরই আষাঢ় আমার জীবনেও বেশ কিছু রঙিন স্মৃতির সমাবেশ ঘটিয়ে যায়। আষাঢ়ের কোনো এক অদৃশ্য শক্তিতে জীবনভর মনে রাখার মতো কিছু স্মৃতি জড়ো হয়ে যায়। আমার জীবনের অনেক প্রথমের সাক্ষী এই আষাঢ়। করোনা ভাইরাসের প্রকোপে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে বাসায় বন্দী হওয়ায়, এ বছর হয়তো বলার মতো তেমন কিছুই করার থাকবেনা আষাঢ়কে স্মরণীয় করে রাখার মতোন। কিন্তু তবুও আশা রাখি বরাবরের মতোনই এবারের আষাঢ়ও প্রতিনিধিত্ব করবে চির সুন্দর প্রকৃতির অনন্য রূপের।
ধর্মীয় আবেশের বাইরে জাগতিক প্রতিটি ভালো জিনিসেরই অবশ্যই এবং চিরন্তন ভাবে একটি মন্দ দিকও থাকে। আষাঢ় শত রূপের ভাণ্ডার হলেও, আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে প্রতি বছর সীমাহীন ক্ষতির বন্যা ডেকে আনার মঞ্চ রচিত হয় এই আষাঢ়েই। লাখো মানুষের জীবন বিপন্ন হয় প্রাকৃতিক এই দুর্যোগে।
বছর ঘুরে আবারও আষাঢ় এসেছে আমাদের মাঝে। করোনার চোখ রাঙানো, শত শত প্রেমিকের মনে প্রেমের জাগরণ, হাজারো কাব্য রচনার প্রেক্ষাপট তৈরী এবং হাতের কাছেই প্রাকৃতিক দূর্যোগের আশঙ্কা -সবকিছুর মেলবন্ধনে এবারের বছরও আষাঢ় হতে চলেছে এক রঙিন মাস।
আজকের লিখাটি শেষ করবো কবিগুরুর বর্ষা প্রেমের কিছু পঙক্তিমালার মাধ্যমে,
‘মেঘমল্লারে সারা দিনমান/বাজে ঝরনার গান/মন হারাবার আজি বেলা/পথ ভুলিবার খেলা-মন চায়/মন চায় হৃদয় জড়াতে কার চিরঋণে/আজি ঝরঝর মুখর বাদল দিনে!!’
দেশে বিদ্যমান মহামারী পরিস্থিতিতে আশাবাদী মনে শুধু এটুকুই আশা করে যাই, এবারের আষাঢ় যেনো ভালোবাসার আষাঢ় হয়েই আসে। এবারের আষাঢ় যেনো সমাজের সব বিভেদ ভুলে সবাইকে এক করার আষাঢ় হয়েই থাকে। এবারের আষাঢ় যেনো সবার জন্যে সঙ্গে করে নিয়ে আসে এক চিলতে খুশির অনুভূতি। তবেই আষাঢ়ের বিশেষ দিকটির সার্থকতা।
লেখক: সাদিয়া রহমান, শিক্ষার্থী, এগ্রিকালচার, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।