ফাহমিদা আফরিন সিথি: আড়াপাড়া জমিদার বাড়ির মূল অংশে প্রবেশের পর উঠোনের মতো বেশ খানিকটা খালি জায়গা দেখতে পেলাম। মূল প্রাসাদের দেয়ালে উপরের দিকে খোদাই করে লিখা রয়েছে “রাই-শশী নিবাস”, স্থাপিত বাংলা ১৩০৭ সন। সিঁড়ির দু’পাশে দুটি নারী মূর্তি, দুটি স্তম্ভের উপর রাখা। পাশে আরেকটি বিল্ডিং সংস্কার করা হয়েছে, যার নাম “রাই নিকেতন”, স্থাপিত ১৩৪৪ বঙ্গাব্দ। এটির একেবারে উপরে ইংরেজিতে লিখা রয়েছে “RM House”।
বাড়ির সিঁড়িতে একজন পুরুষ আর দুজন মহিলাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। সামনে এগিয়ে গিয়ে আমাদের পরিচয় আর সেখানে যাবার উদ্দেশ্য বর্ণনা করতেই উনারা বাড়ি ঘুরে দেখার সম্মতি দিয়ে দিলেন এবং দাঁড়িয়ে থাকা ভদ্রলোকটি আমাদেরকে স্বপ্রণোদিত হয়েই বাড়ির ছাদও ঘুরে দেখার প্রস্তাব করলেন। আমরা তাঁর প্রস্তাবে কালবিলম্ব না করে রাজি হয়ে গেলাম। তিনিই আমাদের বাড়ির অন্দরমহলে নিয়ে গেলেন এবং ছাদ পর্যন্ত পৌঁছে দিলেন। ঘরের ভেতরটা যথেষ্ট অন্ধকারাচ্ছন্ন থাকায় দিনের বেলায়ও আমাদের ফোনের আলো জ্বালিয়ে সামনে এগোতে হলো!
বাড়ির ছাদের উপর থেকে জমিদারীর চারপাশের বিস্তৃত পুরাতন বাড়ি-ঘরগুলো খুব সুন্দরভাবে দেখা যায়, যেখানে জমিদার বংশের লোকেরা এখনও বসবাস করছেন। তাদের প্রাইভেসির কথা ভেবে আমরা সুযোগ থাকা সত্ত্বেও আর তাঁদের অন্দরমহলে যাবার চেষ্টা করিনি। জমিদার বাড়ির বর্তমান অবস্থা আর বাড়ির অন্দরমহলের একাংশ দেখার পর ধারণা করতে বেগ পেতে হয়নি যে, এই জমিদারিটা সেকালে যথেষ্ট নামকরা ছিল। আমরা বাড়ির বিশাল ছাদের সবগুলো অংশই ঘুরলাম, ছবি তুলে নিলাম। বাড়ির অন্দরমহলের সিঁড়িগুলো বেশ নজরকাড়া মনে হলো। বৃষ্টি আসার উপক্রম হওয়ায় এবারে ফেরার তাড়া ভর করলো মাথায়। তিনজনে নিচে নেমে আসলাম।
বাড়ি থেকে বের হয়ে মূল দরজার কাছাকাছি এসে একজন বয়স্কা মহিলাকে জমিদারির ইতিহাস জিজ্ঞেস করতেই উনি বললেন, এখানে এখনও শ দুয়েক পরিবার বসবাস করে এবং ধারেকাছেই দাঁড়িয়ে থাকা বাড়ির একজন কর্তাকে ইঙ্গিতে দেখিয়ে দিলেন। মহিলার ভাষ্যমতে বাড়ির কর্তার থেকেই শুদ্ধ ইতিহাস জানতে পারবো আমরা, তাই আমরাও আর উনার সঙ্গে কালক্ষেপন না করে, ধন্যবাদ জানিয়ে মহিলার থেকে বিদায় নিলাম। এবার লক্ষ্য বাড়ির কর্তার মুখ থেকে কিছু তথ্য বের করা।
আগের পর্বে উল্লেখ করা রাধা গোবিন্দ বিদেহ মন্দিরের পাশেই বাড়ির কর্তা দাঁড়িয়ে ছিলেন। সম্ভবত কোনো গৃহস্থালি কাজের তদারকি করছিলেন! আমরা গিয়ে তাঁর সাথে আলাপ শুরু করলাম। প্রথমেই তিনি আমাদের পরিচয় ও সেখানে যাবার কারণ জিজ্ঞেস করলেন। আমরা তাঁকে জানালাম যে আমরা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগ এর শিক্ষার্থী এবং বাড়িটি ঘুরে দেখার জন্য সেখানে গিয়েছি। এরপর তাঁকে কিছুটা উৎসাহিত মনে হলো। দ্রুতই আলাপের মাধ্যমে জানতে পারলাম তাঁর নাম রতন সাহা। তাঁর মুখেই জানতে পারলাম, বাড়ির জমিদার বলতে ছিলেন মূলত দুজন, দুই ভাই, রাই-শশী; রাইমোহন সাহা এবং শশীমোহন সাহা। শশী মোহনের ঘরে ছিলো তিন ছেলে এবং রাই মোহনের ঘরে ছিলো চার ছেলে। রতন সাহা হচ্ছেন রাই মোহন বংশের তৃতীয় পুরুষ। বর্তমানে বাড়িতে জমিদার বংশের কে বা কারা থাকে জিজ্ঞেস করতেই তাঁর অকপট জবাব,
“জমিদার বংশের লোক বলতে মূলত তাঁদের নাতি পুতিরাই এখন এখানে থাকে। বর্তমানে জমিদারদের উত্তরসূরী প্রায় চার শরীক এখানে বসবাস করছি আমরা। আমাদের পূর্ব পুরুষদের বাড়ি ছিলো মূলত বংশাই নদীর পাড়ে। নদীর ভাঙনের কারণে প্রায় শতবর্ষ পূর্বে তারা এখানে এসে বসতি জমায়। এখানে এইযে মন্দির দেখছেন, এই মন্দিরের পাশে ৮০ পাক বাউন্ডারি ছিলো। দেশ স্বাধীন হবার পরও এটা ছিলো। আমি নিজে ৭০ সনে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেছি। কিন্তু স্বাধীনতার পর কিছু দালাল-বাটপারের নজর পড়ে আমাদের এই জমিজমার উপর। ৪৭ এ বেশ কিছু শরীক ইন্ডিয়ায় পাড়ি জমানোতে তাঁদের জমিগুলো বেদখল ছিলো, সেগুলো দখলে নেয়ার পায়তারা আরম্ভ করে তারা। শুরু হয় মামলা-মোকদ্দমা। এদিকে কিছু কিছু জমি ইতোমধ্যে বেদখলে চলে গিয়েছে। জমিদার বংশের বাইরের কিছু লোকজনও এখানে এখন ফ্যামিলি নিয়ে থাকে। সব মিলিয়ে এখন অবস্থা করুণ।”
১৯৪৭ এ দেশ ভাগ হবার পর এবং মুক্তিযুদ্ধের পর, যাঁরা ভারতে পাড়ি জমায়, তাঁরা কোথায় আছেন এবং কেন চলে গিয়েছিলেন সে ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন,
“বাড়ির কিছু চলে যায় ওপারে, তারা ব্যবসায়ী ছিলো, জমিদারীর সাথে কারবারীও ছিলো। গদি ছিলো সাটুরিয়াতে এবং অন্যান্য জায়গায়। তখন ব্যবসা নষ্ট হয়ে যায়, তারপর কিছুটা ধরে রাখার মতো আমরাই কয়েকজন আছি। ভারতে যারা চলে যায়, তাঁরা প্রায় সবাই কলকাতাতেই আছেন। যোগাযোগ হয় মাঝেমধ্যে।”
এখানে প্রসঙ্গক্রমে আমরা আরো জানতে পারি তার বড় ভাই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ম ব্যাচের পরিসংখ্যান বিভাগের ছাত্র ছিলেন। কথা বলতে বলতেই হুট করে বৃষ্টি নামতে শুরু করলো। আমাদের কাছে তখন কোনো ছাতাও ছিল না। অগত্যা কথা শেষ করতে হলো, তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা ও শুভকামনা জানিয়ে আমরা ফেরার পথ ধরলাম। রিক্সায় করে চলে আসি আবার সেই সাভার বাস স্ট্যান্ড। বাস স্ট্যান্ডে এসে আবারও অটো-রিক্সার জ্যাম-কোলাহল। কল্পনার রাজ্য থেকে যেনো বাস্তবতায় ফিরে এলাম। (শেষ…)
আরও পড়ুন,