Dhaka 11:17 am, Saturday, 2 December 2023

  • Notice: Trying to access array offset on value of type int in /home/nabajugc/public_html/wp-content/themes/NewsFlash-Pro/template-parts/page/header_design_two.php on line 68

বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহিলা কবি চন্দ্রাবতীর জীবনী

  • Reporter Name
  • Update Time : 04:37:09 pm, Monday, 3 February 2020
  • 28 Time View

ফাহিম আহম্মেদ মন্ডল: বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চা সেই সপ্তম-অষ্টম শতকে শুরু হলেও প্রথম বাঙালি মহিলা কবি পেতে পেতে সাহিত্যানুরাগীদেরকে অপেক্ষা করতে হয় ষোড়শ শতকের অর্ধেকেরও বেশী সময় পর্যন্ত। মধ্যযুগের সামাজিক প্রেক্ষাপটে যেখানে নারীদেরকে মনে করা হতো অন্য আর দশটা সাধারণ ঘরোয়া পণ্য-সামগ্রীর মত, তখনই কবি হিসেবে আবির্ভাব ঘটে এক অসম্ভব মেধাসম্পন্ন নারীর, যাঁর নাম চন্দ্রাবতী এবং বাংলা সাহিত্যে শুরু হয় একটি নতুন দিগন্তের। তাঁর সম্পর্কে বলতে গিয়ে ময়মনসিংহ থেকে প্রকাশিত কেদারনাথ মজুমদার সম্পাদিত ‘সৌরভ’ পত্রিকায় (ফাল্গুন ১৩২০ বঙ্গাব্দ/ফেব্রুয়ারি ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দ) চন্দ্রকুমার দে তাঁর প্রথম প্রকাশিত প্রবন্ধ “মহিলা কবি চন্দ্রাবতী” -তে লিখেছিলেন;

বনে অনেক সময় এমন ফুল ফুটে, রাজোদ্যানেও তাহার তুলনা মিলে না, সে-বনফুলের সৌন্দর্য্য কেহ উপলব্ধি করিতে, কিংবা সে-সৌরভ কেহই ভোগও করিতে পারে না, বনের ফুল বনে ফুটে, বনেই শুকায়। চন্দ্রাবতী এই রূপ একটি বনফুল, ময়মনসিংহের নিবিড় অরণ্যে, একসময় এই সুরভী কুসুম ফুটিয়াছিল

ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে অর্থাৎ ১৫৫০ সালে তৎকালীন ময়মনসিংহ অঞ্চলের কিশোরগঞ্জের পাতুয়ার গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে প্রথম বাঙালি মহিলা কবি চন্দ্রাবতী৷ তাঁর পিতা ছিলেন মনসা মঙ্গল কাব্যের অন্যতম রচয়িতা দ্বিজ বংশী দাস এবং মাতার নাম সুলোচনা৷ চন্দ্রাবতীর স্মৃতিবিজরিত একটি মন্দির কিশোরগঞ্জের পাতুয়ারের গ্রামে আজও বিদ্যমান।

চন্দ্রকুমার দে’র লিখনীর মাধ্যমেই সর্বপ্রথম বাঙালি সুধী সমাজে চন্দ্রাবতীর নাম পরিচিতি লাভ করে। অথচ এর আগে ‘শিক্ষিত’ সমাজের কেউ ময়মনসিংহের নিবিড় অরণ্যে প্রস্ফুটিত চন্দ্রাবতী নামের এই সুরভী কুসুমটি সর্ম্পকে অবহিত ছিলেন না, অবহিত হওয়ার প্রয়োজনও বোধ করেননি। অথচ, দীর্ঘকাল ধরেই চন্দ্রাবতীর কাহিনীর সঙ্গে সেকালের পূর্ব ময়মনসিংহের লোক-সাধারণের ছিল নিবিড় পরিচয়। সেখানকার পল্লীবালাগণের কণ্ঠস্থ ছিল চন্দ্রাবতী রচিত রামায়নের বিভিন্ন অংশ।

চন্দ্রকুমারের ভাষায় –

“যাঁহার কবিতা লোকের প্রাণের মধ্যে, মনের মধ্যে সর্বদা প্রিয়জনের স্মৃতির ন্যায় ঘুরিয়া ফিরিয়া, ভাসিয়া ভাসিয়া বেড়ায়, ছোট বড় নাই, স্থান-অস্থান নাই, মুখে মুখে ফেরে, তিনিই সাধারণের প্রাণের কবি। চন্দ্রাবতী পূর্ব ময়মনসিংহের সর্বসাধারণের প্রাণের কবি ছিলেন। বহুদিন হইতে শুনিয়া আসিতেছি – সেই অপূর্ব মনপ্রাণ মাতান সঙ্গীত। মাঠে কৃষকের, শিশুর মুখে মুখে, আঙ্গিনায় কুলকামিনীদের মুখে, ঘাটে-বাটে, মন্দিরে, প্রান্তরে, বিজনে, নদীর পুলিনে সেই সঙ্গীত; বিবাহে, উপনয়নে, অন্নপ্রাশনে, ব্রতে, পূজায় সেই সঙ্গীত ঘুরিয়া ঘুরিয়া, ফিরিয়া ফিরিয়া কানে আসিয়া বাজে, মরমের ভিতর প্রবেশ করে, — প্রায়ই শুনি চন্দ্রাবতী ভনে, চন্দ্রাবতী গায়। শ্রাবণের মেঘভরা আকাশতলে ভরা নদীতে যখন বাহকগণ সাঁঝের নৌকা সারি দিয়া বাহিয়া যায়, তখন শুনি সেই চন্দ্রাবতীর গান, বিবাহে কুলকামিনীগণ নব বরবধূকে স্নান করাইতে জলতরনে যাইতেছে আর গাইতেছে সেই চন্দ্রাবতীর গান, তারপর ক্ষৌরকার বরকে কামাইবে তার সঙ্গীত, বরবধূর পাশাখেলা, তার সঙ্গীত সে কত রকম!

চন্দ্রকুমারের লেখা পড়েই আমরা জানতে পারি, “চন্দ্রাবতী-ই বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহিলা কবি।”

আচার্য দীনেশ চন্দ্র সেন চন্দ্রাবতী ও তাঁর পিতার সম্পর্কে লিখতে গিয়ে বলেছিলেন–

“পিতা ও কন্যা একত্র হইয়া ‘মনসা দেবীর ভাসান (১৫৭৫খৃঃ)’ রচনা করিয়াছিলেন।”

জয়ানন্দ নামে প্রতিবেশী এক ব্রাহ্মণ কুমারের সঙ্গে বালিকা চন্দ্রাবতী’র প্রণয় সঞ্চার ঘটেছিল। চন্দ্রকুমার দে এ ব্যপারে লিখেছেন –

“প্রণয় যখন গাঢ় হইয়াছিল, চন্দ্রাবতী তখন মনে মনে তাঁহার প্রাণের দেবতার পদে সমস্ত জীবন-যৌবন ঢালিয়া দিলেন। বিবাহের কথাবার্তা এক রূপ স্থির হইয়া গেল, এমন সময় এক বিষম অনর্থ ঘটিল। অলক্ষ্য হইতে নিদারুণ বিধাতা কল ঘুরাইলেন। মূর্খ যুবক এক মুসলমান রমণীর প্রেমে আত্মবিক্রয় করিয়া ধর্মান্তর গ্রহণ করিল। সে বুঝিল না কি অমূল্য রত্নই হেলায় হারাইল!”

ঘটনা ছিলো এমন, বাল্যকালে চন্দ্রাবতীর বন্ধু ও খেলার সাথী ছিলেন জয়ানন্দ নামের এক অনাথ বালক৷ জয়ানন্দের নিবাস ছিল সুন্ধা গ্রামে৷ জয়ানন্দ তাঁর মাতুলগৃহে পালিত৷ দ্বিজ বংশীদাসের অনেক রচনায় এই দুজনার রচিত ছোট ছোট অনেক পদ রয়েছে৷ কৈশোর উত্তীর্ণ হলে দুজনে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবেন বলে স্থির করেন ৷ বিবাহের দিনও স্থির হয়৷ ইতোমধ্যে জয়ানন্দ অন্য এক রমনীর প্রেমে পড়ে যান৷ স্থানীয় মুসলমান শাসনকর্তা বা কাজীর মেয়ে আসমানী‘র অসামান্য রূপে মুগ্ধ হয়ে জয়ানন্দ আসমানীকে একাধিক প্রেমপত্র লেখেন৷

এই ত্রিকোণ প্রেমের ফলাফল হয় মারাত্মক৷ জয়ানন্দের সাথে চন্দ্রাবতীর প্রেমের কথা জেনেও আসমানী তার পিতাকে জানান, তিনি জয়ানন্দকে বিবাহ করতে চান৷ কাজী জয়ানন্দকে বলপূর্ববক ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করে আসমানীর সঙ্গে তার বিবাহ দেন৷ ঘটনাটি ঘটে যেদিন জয়ানন্দ ও চন্দ্রাবতীর বিবাহের দিন স্থির হয়েছিল সেই দিন৷ সেদিন সন্ধ্যাবেলা চন্দ্রাবতী বিবাহের সাজে পিত্রালয়ে বসে ছিলেন৷ তখনই সংবাদ পেলেন জয়ানন্দ ধর্মান্তরিত হয়ে অনত্র্য বিবাহ করেছেন৷ ভাগ্যের এ নির্মম পরিহাসে চন্দ্রাবতীর কোমল মন ভেঙে গেল এবং তিনি মনস্থির করিয়া শিবপূজায় মনোনিবেশ করিলেন। তিনি স্নেহময় পিতার কাছে দুটি প্রার্থনা জানালেন: প্রথমটি, নির্জন ফুলেশ্বরী তীরে শিবমন্দির স্থাপন এবং অন্যটি তাঁর চিরকুমারী থাকবার বাসনা।

কন্যাবৎসল পিতা উভয় সংসারের সুখ-দুঃখের অনিত্যতা বুঝিয়ে দিলেন। চন্দ্রাবতী কায়মনোবাক্যে শিবপূজা করতেন ও অবসরকালে রামায়ণ লিখতেন। তাঁর এই রামায়ণ এ অঞ্চলের মানুষের মুখে মুখে গীত হলেও মুদ্রিত হয়নি। ড. দীনেশচন্দ্র সেন ১৯৩২ সালে চন্দ্রাবতীর ‘রামায়ণ’ প্রকাশ করেন । লৌকিক মানবিক ও কিছু মৌলিক উপাদান সংযোগের ফলে এই রামায়ণ কাব্যটি বিশেষ মর্যাদা লাভ করেছে, যদিও চন্দ্রাবতীর রচিত রামায়ণ ছিল অসমাপ্ত। এর পেছনেও রয়েছে এক সুকরূণ কাহিনী। চন্দ্রাবতী তাঁর রামায়ণের ‘সীতার বনবাস’ রচনার পরপরই আরও একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেল। চন্দ্রাবতীর সেই প্রণয়ী যুবক অনুতাপের তুষানলে পুড়ে পুড়ে দুর্বিষহ জীবনভার সহ্য করতে না পেরে, চন্দ্রাবতীর উদ্দেশ্যে একটি পত্র লিখে তাঁর সাক্ষাৎ কামনা করল। চন্দ্রাবতী পিতাকে সমস্ত জানালেন। পিতা অসম্মতি প্রকাশ করিয়া বললেন,

‘তুমি যে দেবতার পূজায় মন দিয়াছ তাহারই পূজা কর। অন্য কামনা হৃদয়ে স্থান দিও না।’

চন্দ্রাবতী যুবককে একখানা পত্র লিখে সান্ত্বনা প্রদান করলেন এবং সর্বদুঃখহারী ভগবান শিবের চরণে মনপ্রাণ সমর্পণ করতে উপদেশ দিলেন। অনুতপ্ত যুবক পত্র পাঠ করিয়া তৎক্ষণাৎ চন্দ্রাবতীর স্থাপিত শিবমন্দিরের অভিমুখে ছুটল। চন্দ্রাবতী তখন শিবপূজায় মগ্ন, মন্দিরের দ্বার ভিতর হইতে রুদ্ধ। হতভাগ্য যুবক এসেছিলো চন্দ্রাবতীর কাছে দীক্ষা নিতে, অনুতপ্ত দুর্বিসহ জীবন প্রভুপদে উৎসর্গ করতে। কিন্তু পারল না, চন্দ্রাবতীকে ডাকবার সাহসও তাঁর হল না। আঙ্গিনার ভিতর সন্ধ্যামালতীর ফুল ফুটেছিল, তারই দ্বারা কবাটের উপর চার ছত্র কবিতা লিখিয়া চন্দ্রাবতীর কাছে, এমনকি পৃথিবীর কাছেও শেষ বিদায় প্রার্থনা করল।

পূজা শেষ করে চন্দ্রাবতী দরজা খুলে বের হলেন। আবার যখন দরজা বন্ধ করেন তখন সেই কবিতা দেখামাত্র পাঠ করিলেন, পাঠ করেই বুঝলেন –দেবমন্দির কলঙ্কিত হয়েছে। চন্দ্রাবতী তৎক্ষণাৎ জল আনতে ফুলিয়ার ঘাটে গেলেন, গিয়েই বুঝলেন ইতোমধ্যে সব শেষ হয়ে গিয়েছে, সেই অনুতপ্ত যুবক ফুলিয়ার স্রোতধারায় নিজের জীবনস্রোত ভাসিয়ে দিয়েছে। বনফুল শুকিয়ে উঠল। এর পর চন্দ্রাবতী আর কোন কবিতা লিখেননি, এভাবেই রামায়ণ অপরিসমাপ্ত রয়ে গেল।

তারপর একদিন শিবপূজার সময় খৃষ্টাব্দ ১৬০০ সালে তাঁর প্রাণবায়ু মহাশূন্যে মিলিয়ে গেল। জয়ানন্দের গ্রাম “সুন্ধা” ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যায়নি৷ তবে, ইতিহাসের স্মৃতি বিজড়িত পাটোয়ারী গ্রাম আজও আছে৷ কিশোরগঞ্জ শহর থেকে উত্তর পূর্বদিকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরেই এর অবস্থান৷ তাছাড়া, এখনও কালের সাক্ষী হয়ে টিকে আছে ফুলেশ্বরী নদীর ধারে চন্দ্রাবতীর পূজিত শিব মন্দির৷ মৈমনসিংহ গীতিকায় তার কথা পাওয়া যায়৷

শুধু রামায়ণ নয়, চন্দ্রকুমার দে সংগৃহীত ও ময়মনসিংহ গীতিকায় সংকলিত ‘দস্যু কেনারামের পালা’ এবং ধারণা করা হয় সম্ভবত ‘মলুয়া’ ও ‘দেওয়ান ভাবনা’ -ও চন্দ্রাবতীরই রচনা । অবশ্য দেওয়ান ভাবনা’ বা “মলুয়া’র পালা যে চন্দ্রাবতীরই রচনা, এ বিষয়ে পুরোপুরি নিঃসংশয় হওয়া যায় না। তবু এ দুটো পালাকেও চন্দ্রাবতীর রচনা বলে গ্রহণ করার পক্ষে অনেক অভ্যন্তরীণ যুক্তি-প্রমাণ রয়েছে। সেসব যুক্তি প্রমাণের ওপর ভিত্তি করেই অনির্বাণ রায় চৌধুরী লিখেছেন –

“পালাদুটির মধ্যে নারী চরিত্রের স্বাধীন-চিত্ততা, সতীত্ববোধ ও একনিষ্ঠতার পরিচয় রয়েছে এবং পালার নায়িকারা যে রকম জীবনের যন্ত্রণা সহ্য করেছে ও ব্যর্থ প্রণয়ের জ্বালায় দগ্ধ হয়েছে, তাকে অনুধাবন করলে এগুলোর মধ্যে যে কবির জীবনের ব্যক্তি অনুভূতি ধরা পড়ে, তাতে এগুলিকে চন্দ্রাবতীর রচনা বলে ধরলে বোধ হয় অন্যায় হয় না।”

তাঁর নিজের জীবনের ট্র্যাজেডি নিয়ে রচিত লোকগাঁথা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে অবিভক্ত ময়মনসিংহ জেলার মানুষের মুখে মুখে ফিরে এসেছে৷ চন্দ্রাবতীর রচিত কাব্য হল: “মলুয়া”, “দস্যু কেনারামের পালা”, “রামায়ণ”আচার্য দীনেশ চন্দ্র সেন এক সময় সহজিয়া চন্ডীদাসের সাধনসঙ্গিনী রামীকে আমাদের সাহিত্যের প্রথম মহিলা কবির মর্যাদা দিতে চেয়েছিলেন। তবে, তাঁর এই মত শেষ পর্যন্ত সর্বজন গ্রাহ্য হয়নি। চন্দ্রাবতী-ই যে বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহিলা কবি, সে ব্যাপারে বর্তমানে আর কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। অন্তত তাঁর অপরিসমাপ্ত রামায়ণের আনুপূর্বিক পর্যালোচনাতেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, তিনি শুধু ‘প্রথম মহিলা কবি’ই -নন, প্রাক-আধুনিক বাংলা সাহিত্যের একজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কবিও বটে।

সাম্প্রতিক সময়ে এ মহান কবির জীবনী নিয়ে ‘চন্দ্রাবতী কথা” নামের একটি চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়েছে।

 

তথ্যসূত্র :

১। সেলিনা হোসেন ও নুরুল ইসলাম সম্পাদিত; বাংলা একাডেমী চরিতাভিধান; ঢাকা, ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৭; পৃষ্ঠা-১৫৭।
“বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহিলা কবি : চন্দ্রাবতীর কথা”-যতীন সরকার (সাহিত্য বাজার)।

২।বাংলাপিডিয়া

Tag :

Notice: Trying to access array offset on value of type int in /home/nabajugc/public_html/wp-content/themes/NewsFlash-Pro/template-parts/common/single_two.php on line 177

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

Popular Post

Notice: Undefined index: footer_custom_code in /home/nabajugc/public_html/wp-content/themes/NewsFlash-Pro/footer.php on line 87

বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহিলা কবি চন্দ্রাবতীর জীবনী

Update Time : 04:37:09 pm, Monday, 3 February 2020

ফাহিম আহম্মেদ মন্ডল: বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চা সেই সপ্তম-অষ্টম শতকে শুরু হলেও প্রথম বাঙালি মহিলা কবি পেতে পেতে সাহিত্যানুরাগীদেরকে অপেক্ষা করতে হয় ষোড়শ শতকের অর্ধেকেরও বেশী সময় পর্যন্ত। মধ্যযুগের সামাজিক প্রেক্ষাপটে যেখানে নারীদেরকে মনে করা হতো অন্য আর দশটা সাধারণ ঘরোয়া পণ্য-সামগ্রীর মত, তখনই কবি হিসেবে আবির্ভাব ঘটে এক অসম্ভব মেধাসম্পন্ন নারীর, যাঁর নাম চন্দ্রাবতী এবং বাংলা সাহিত্যে শুরু হয় একটি নতুন দিগন্তের। তাঁর সম্পর্কে বলতে গিয়ে ময়মনসিংহ থেকে প্রকাশিত কেদারনাথ মজুমদার সম্পাদিত ‘সৌরভ’ পত্রিকায় (ফাল্গুন ১৩২০ বঙ্গাব্দ/ফেব্রুয়ারি ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দ) চন্দ্রকুমার দে তাঁর প্রথম প্রকাশিত প্রবন্ধ “মহিলা কবি চন্দ্রাবতী” -তে লিখেছিলেন;

বনে অনেক সময় এমন ফুল ফুটে, রাজোদ্যানেও তাহার তুলনা মিলে না, সে-বনফুলের সৌন্দর্য্য কেহ উপলব্ধি করিতে, কিংবা সে-সৌরভ কেহই ভোগও করিতে পারে না, বনের ফুল বনে ফুটে, বনেই শুকায়। চন্দ্রাবতী এই রূপ একটি বনফুল, ময়মনসিংহের নিবিড় অরণ্যে, একসময় এই সুরভী কুসুম ফুটিয়াছিল

ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে অর্থাৎ ১৫৫০ সালে তৎকালীন ময়মনসিংহ অঞ্চলের কিশোরগঞ্জের পাতুয়ার গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে প্রথম বাঙালি মহিলা কবি চন্দ্রাবতী৷ তাঁর পিতা ছিলেন মনসা মঙ্গল কাব্যের অন্যতম রচয়িতা দ্বিজ বংশী দাস এবং মাতার নাম সুলোচনা৷ চন্দ্রাবতীর স্মৃতিবিজরিত একটি মন্দির কিশোরগঞ্জের পাতুয়ারের গ্রামে আজও বিদ্যমান।

চন্দ্রকুমার দে’র লিখনীর মাধ্যমেই সর্বপ্রথম বাঙালি সুধী সমাজে চন্দ্রাবতীর নাম পরিচিতি লাভ করে। অথচ এর আগে ‘শিক্ষিত’ সমাজের কেউ ময়মনসিংহের নিবিড় অরণ্যে প্রস্ফুটিত চন্দ্রাবতী নামের এই সুরভী কুসুমটি সর্ম্পকে অবহিত ছিলেন না, অবহিত হওয়ার প্রয়োজনও বোধ করেননি। অথচ, দীর্ঘকাল ধরেই চন্দ্রাবতীর কাহিনীর সঙ্গে সেকালের পূর্ব ময়মনসিংহের লোক-সাধারণের ছিল নিবিড় পরিচয়। সেখানকার পল্লীবালাগণের কণ্ঠস্থ ছিল চন্দ্রাবতী রচিত রামায়নের বিভিন্ন অংশ।

চন্দ্রকুমারের ভাষায় –

“যাঁহার কবিতা লোকের প্রাণের মধ্যে, মনের মধ্যে সর্বদা প্রিয়জনের স্মৃতির ন্যায় ঘুরিয়া ফিরিয়া, ভাসিয়া ভাসিয়া বেড়ায়, ছোট বড় নাই, স্থান-অস্থান নাই, মুখে মুখে ফেরে, তিনিই সাধারণের প্রাণের কবি। চন্দ্রাবতী পূর্ব ময়মনসিংহের সর্বসাধারণের প্রাণের কবি ছিলেন। বহুদিন হইতে শুনিয়া আসিতেছি – সেই অপূর্ব মনপ্রাণ মাতান সঙ্গীত। মাঠে কৃষকের, শিশুর মুখে মুখে, আঙ্গিনায় কুলকামিনীদের মুখে, ঘাটে-বাটে, মন্দিরে, প্রান্তরে, বিজনে, নদীর পুলিনে সেই সঙ্গীত; বিবাহে, উপনয়নে, অন্নপ্রাশনে, ব্রতে, পূজায় সেই সঙ্গীত ঘুরিয়া ঘুরিয়া, ফিরিয়া ফিরিয়া কানে আসিয়া বাজে, মরমের ভিতর প্রবেশ করে, — প্রায়ই শুনি চন্দ্রাবতী ভনে, চন্দ্রাবতী গায়। শ্রাবণের মেঘভরা আকাশতলে ভরা নদীতে যখন বাহকগণ সাঁঝের নৌকা সারি দিয়া বাহিয়া যায়, তখন শুনি সেই চন্দ্রাবতীর গান, বিবাহে কুলকামিনীগণ নব বরবধূকে স্নান করাইতে জলতরনে যাইতেছে আর গাইতেছে সেই চন্দ্রাবতীর গান, তারপর ক্ষৌরকার বরকে কামাইবে তার সঙ্গীত, বরবধূর পাশাখেলা, তার সঙ্গীত সে কত রকম!

চন্দ্রকুমারের লেখা পড়েই আমরা জানতে পারি, “চন্দ্রাবতী-ই বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহিলা কবি।”

আচার্য দীনেশ চন্দ্র সেন চন্দ্রাবতী ও তাঁর পিতার সম্পর্কে লিখতে গিয়ে বলেছিলেন–

“পিতা ও কন্যা একত্র হইয়া ‘মনসা দেবীর ভাসান (১৫৭৫খৃঃ)’ রচনা করিয়াছিলেন।”

জয়ানন্দ নামে প্রতিবেশী এক ব্রাহ্মণ কুমারের সঙ্গে বালিকা চন্দ্রাবতী’র প্রণয় সঞ্চার ঘটেছিল। চন্দ্রকুমার দে এ ব্যপারে লিখেছেন –

“প্রণয় যখন গাঢ় হইয়াছিল, চন্দ্রাবতী তখন মনে মনে তাঁহার প্রাণের দেবতার পদে সমস্ত জীবন-যৌবন ঢালিয়া দিলেন। বিবাহের কথাবার্তা এক রূপ স্থির হইয়া গেল, এমন সময় এক বিষম অনর্থ ঘটিল। অলক্ষ্য হইতে নিদারুণ বিধাতা কল ঘুরাইলেন। মূর্খ যুবক এক মুসলমান রমণীর প্রেমে আত্মবিক্রয় করিয়া ধর্মান্তর গ্রহণ করিল। সে বুঝিল না কি অমূল্য রত্নই হেলায় হারাইল!”

ঘটনা ছিলো এমন, বাল্যকালে চন্দ্রাবতীর বন্ধু ও খেলার সাথী ছিলেন জয়ানন্দ নামের এক অনাথ বালক৷ জয়ানন্দের নিবাস ছিল সুন্ধা গ্রামে৷ জয়ানন্দ তাঁর মাতুলগৃহে পালিত৷ দ্বিজ বংশীদাসের অনেক রচনায় এই দুজনার রচিত ছোট ছোট অনেক পদ রয়েছে৷ কৈশোর উত্তীর্ণ হলে দুজনে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবেন বলে স্থির করেন ৷ বিবাহের দিনও স্থির হয়৷ ইতোমধ্যে জয়ানন্দ অন্য এক রমনীর প্রেমে পড়ে যান৷ স্থানীয় মুসলমান শাসনকর্তা বা কাজীর মেয়ে আসমানী‘র অসামান্য রূপে মুগ্ধ হয়ে জয়ানন্দ আসমানীকে একাধিক প্রেমপত্র লেখেন৷

এই ত্রিকোণ প্রেমের ফলাফল হয় মারাত্মক৷ জয়ানন্দের সাথে চন্দ্রাবতীর প্রেমের কথা জেনেও আসমানী তার পিতাকে জানান, তিনি জয়ানন্দকে বিবাহ করতে চান৷ কাজী জয়ানন্দকে বলপূর্ববক ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করে আসমানীর সঙ্গে তার বিবাহ দেন৷ ঘটনাটি ঘটে যেদিন জয়ানন্দ ও চন্দ্রাবতীর বিবাহের দিন স্থির হয়েছিল সেই দিন৷ সেদিন সন্ধ্যাবেলা চন্দ্রাবতী বিবাহের সাজে পিত্রালয়ে বসে ছিলেন৷ তখনই সংবাদ পেলেন জয়ানন্দ ধর্মান্তরিত হয়ে অনত্র্য বিবাহ করেছেন৷ ভাগ্যের এ নির্মম পরিহাসে চন্দ্রাবতীর কোমল মন ভেঙে গেল এবং তিনি মনস্থির করিয়া শিবপূজায় মনোনিবেশ করিলেন। তিনি স্নেহময় পিতার কাছে দুটি প্রার্থনা জানালেন: প্রথমটি, নির্জন ফুলেশ্বরী তীরে শিবমন্দির স্থাপন এবং অন্যটি তাঁর চিরকুমারী থাকবার বাসনা।

কন্যাবৎসল পিতা উভয় সংসারের সুখ-দুঃখের অনিত্যতা বুঝিয়ে দিলেন। চন্দ্রাবতী কায়মনোবাক্যে শিবপূজা করতেন ও অবসরকালে রামায়ণ লিখতেন। তাঁর এই রামায়ণ এ অঞ্চলের মানুষের মুখে মুখে গীত হলেও মুদ্রিত হয়নি। ড. দীনেশচন্দ্র সেন ১৯৩২ সালে চন্দ্রাবতীর ‘রামায়ণ’ প্রকাশ করেন । লৌকিক মানবিক ও কিছু মৌলিক উপাদান সংযোগের ফলে এই রামায়ণ কাব্যটি বিশেষ মর্যাদা লাভ করেছে, যদিও চন্দ্রাবতীর রচিত রামায়ণ ছিল অসমাপ্ত। এর পেছনেও রয়েছে এক সুকরূণ কাহিনী। চন্দ্রাবতী তাঁর রামায়ণের ‘সীতার বনবাস’ রচনার পরপরই আরও একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেল। চন্দ্রাবতীর সেই প্রণয়ী যুবক অনুতাপের তুষানলে পুড়ে পুড়ে দুর্বিষহ জীবনভার সহ্য করতে না পেরে, চন্দ্রাবতীর উদ্দেশ্যে একটি পত্র লিখে তাঁর সাক্ষাৎ কামনা করল। চন্দ্রাবতী পিতাকে সমস্ত জানালেন। পিতা অসম্মতি প্রকাশ করিয়া বললেন,

‘তুমি যে দেবতার পূজায় মন দিয়াছ তাহারই পূজা কর। অন্য কামনা হৃদয়ে স্থান দিও না।’

চন্দ্রাবতী যুবককে একখানা পত্র লিখে সান্ত্বনা প্রদান করলেন এবং সর্বদুঃখহারী ভগবান শিবের চরণে মনপ্রাণ সমর্পণ করতে উপদেশ দিলেন। অনুতপ্ত যুবক পত্র পাঠ করিয়া তৎক্ষণাৎ চন্দ্রাবতীর স্থাপিত শিবমন্দিরের অভিমুখে ছুটল। চন্দ্রাবতী তখন শিবপূজায় মগ্ন, মন্দিরের দ্বার ভিতর হইতে রুদ্ধ। হতভাগ্য যুবক এসেছিলো চন্দ্রাবতীর কাছে দীক্ষা নিতে, অনুতপ্ত দুর্বিসহ জীবন প্রভুপদে উৎসর্গ করতে। কিন্তু পারল না, চন্দ্রাবতীকে ডাকবার সাহসও তাঁর হল না। আঙ্গিনার ভিতর সন্ধ্যামালতীর ফুল ফুটেছিল, তারই দ্বারা কবাটের উপর চার ছত্র কবিতা লিখিয়া চন্দ্রাবতীর কাছে, এমনকি পৃথিবীর কাছেও শেষ বিদায় প্রার্থনা করল।

পূজা শেষ করে চন্দ্রাবতী দরজা খুলে বের হলেন। আবার যখন দরজা বন্ধ করেন তখন সেই কবিতা দেখামাত্র পাঠ করিলেন, পাঠ করেই বুঝলেন –দেবমন্দির কলঙ্কিত হয়েছে। চন্দ্রাবতী তৎক্ষণাৎ জল আনতে ফুলিয়ার ঘাটে গেলেন, গিয়েই বুঝলেন ইতোমধ্যে সব শেষ হয়ে গিয়েছে, সেই অনুতপ্ত যুবক ফুলিয়ার স্রোতধারায় নিজের জীবনস্রোত ভাসিয়ে দিয়েছে। বনফুল শুকিয়ে উঠল। এর পর চন্দ্রাবতী আর কোন কবিতা লিখেননি, এভাবেই রামায়ণ অপরিসমাপ্ত রয়ে গেল।

তারপর একদিন শিবপূজার সময় খৃষ্টাব্দ ১৬০০ সালে তাঁর প্রাণবায়ু মহাশূন্যে মিলিয়ে গেল। জয়ানন্দের গ্রাম “সুন্ধা” ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যায়নি৷ তবে, ইতিহাসের স্মৃতি বিজড়িত পাটোয়ারী গ্রাম আজও আছে৷ কিশোরগঞ্জ শহর থেকে উত্তর পূর্বদিকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরেই এর অবস্থান৷ তাছাড়া, এখনও কালের সাক্ষী হয়ে টিকে আছে ফুলেশ্বরী নদীর ধারে চন্দ্রাবতীর পূজিত শিব মন্দির৷ মৈমনসিংহ গীতিকায় তার কথা পাওয়া যায়৷

শুধু রামায়ণ নয়, চন্দ্রকুমার দে সংগৃহীত ও ময়মনসিংহ গীতিকায় সংকলিত ‘দস্যু কেনারামের পালা’ এবং ধারণা করা হয় সম্ভবত ‘মলুয়া’ ও ‘দেওয়ান ভাবনা’ -ও চন্দ্রাবতীরই রচনা । অবশ্য দেওয়ান ভাবনা’ বা “মলুয়া’র পালা যে চন্দ্রাবতীরই রচনা, এ বিষয়ে পুরোপুরি নিঃসংশয় হওয়া যায় না। তবু এ দুটো পালাকেও চন্দ্রাবতীর রচনা বলে গ্রহণ করার পক্ষে অনেক অভ্যন্তরীণ যুক্তি-প্রমাণ রয়েছে। সেসব যুক্তি প্রমাণের ওপর ভিত্তি করেই অনির্বাণ রায় চৌধুরী লিখেছেন –

“পালাদুটির মধ্যে নারী চরিত্রের স্বাধীন-চিত্ততা, সতীত্ববোধ ও একনিষ্ঠতার পরিচয় রয়েছে এবং পালার নায়িকারা যে রকম জীবনের যন্ত্রণা সহ্য করেছে ও ব্যর্থ প্রণয়ের জ্বালায় দগ্ধ হয়েছে, তাকে অনুধাবন করলে এগুলোর মধ্যে যে কবির জীবনের ব্যক্তি অনুভূতি ধরা পড়ে, তাতে এগুলিকে চন্দ্রাবতীর রচনা বলে ধরলে বোধ হয় অন্যায় হয় না।”

তাঁর নিজের জীবনের ট্র্যাজেডি নিয়ে রচিত লোকগাঁথা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে অবিভক্ত ময়মনসিংহ জেলার মানুষের মুখে মুখে ফিরে এসেছে৷ চন্দ্রাবতীর রচিত কাব্য হল: “মলুয়া”, “দস্যু কেনারামের পালা”, “রামায়ণ”আচার্য দীনেশ চন্দ্র সেন এক সময় সহজিয়া চন্ডীদাসের সাধনসঙ্গিনী রামীকে আমাদের সাহিত্যের প্রথম মহিলা কবির মর্যাদা দিতে চেয়েছিলেন। তবে, তাঁর এই মত শেষ পর্যন্ত সর্বজন গ্রাহ্য হয়নি। চন্দ্রাবতী-ই যে বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহিলা কবি, সে ব্যাপারে বর্তমানে আর কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। অন্তত তাঁর অপরিসমাপ্ত রামায়ণের আনুপূর্বিক পর্যালোচনাতেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, তিনি শুধু ‘প্রথম মহিলা কবি’ই -নন, প্রাক-আধুনিক বাংলা সাহিত্যের একজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কবিও বটে।

সাম্প্রতিক সময়ে এ মহান কবির জীবনী নিয়ে ‘চন্দ্রাবতী কথা” নামের একটি চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়েছে।

 

তথ্যসূত্র :

১। সেলিনা হোসেন ও নুরুল ইসলাম সম্পাদিত; বাংলা একাডেমী চরিতাভিধান; ঢাকা, ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৭; পৃষ্ঠা-১৫৭।
“বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহিলা কবি : চন্দ্রাবতীর কথা”-যতীন সরকার (সাহিত্য বাজার)।

২।বাংলাপিডিয়া