Dhaka 11:12 am, Saturday, 2 December 2023

  • Notice: Trying to access array offset on value of type int in /home/nabajugc/public_html/wp-content/themes/NewsFlash-Pro/template-parts/page/header_design_two.php on line 68

গ্রুপ প্রজেক্ট এবং পানাম ভ্রমণের ইতিবৃত্ত

  • Reporter Name
  • Update Time : 07:58:17 am, Wednesday, 17 April 2019
  • 117 Time View

ফাহিম আহম্মেদ মন্ডল: পানাম সিটি! নামটার মাঝেই লুকিয়ে আছে কত শত বছরের ঐতিহাসিক ঘটনাবলী, ঐতিহ্য, কৃষ্টি, কালচার।

বাংলার তৎকালীন বার ভুইঞাদের  রাজধানী সোনারগাও। আর পানাম-কে বলা হতো “রাজধানীর ভেতর রাজধানী”! শুধুমাত্র এ উপমাটুকু থেকেই পানামের মাহাত্ম্য বুঝা যায়!

মোঘল সম্রাট আকবরের বীর সেনাপতি মানসিংহ-কে পরাজিত করা বাংলার প্রভাবশালী রাজা ঈসা খা, তাঁর পুত্র মুসা খা – প্রভৃতি নানাজনের স্মৃতিঘেরা অঞ্চল সোনারগাও! এ অঞ্চল থেকে বসেই স্বাধীন বাংলার রাজনৈতিক ভাগ্য নির্ধারণ করতেন তাঁরা! আর পানাম ছিলো মূলত রাজধানী শহরের ভেতর ধনিক বণিক শ্রেণীয় ব্যাক্তিবর্গের আবাসস্থল। অনেকটা আধুনিক ঢাকার গুলশান-বারিধারার মতো!

অনেকদিনের ইচ্ছে ছিলো পানাম ঘুরে আসার! আশপাশ-দুরবর্তী মিলিয়ে অনেক এলাকায় ঘুরবার সৌভাগ্য হলেও, কেনো যেনো পানামে যাওয়া হয়ে উঠছিলো না! সময় মেলে তো পকেট ফাঁকা, পকেট ভারী তো সময় নাই, আবার দুটোই আছে তো, সঙ্গী নাই!

যাহোক অবশেষে ১৬ এপ্রিল, ২০১৯ ইং তারিখে আলহামদুলিল্লাহ ঘুরে আসা হলো রাজরাজড়াদের বসতভিটা, সোনারগাওয়ের পানাম সিটি-তে!

নগর পরিকল্পনার একজন ছাত্র হওয়ার সুবাদে আমাদের বেসিক ডিজাইন & গ্রাফিক্স কোর্সের কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বোর্ড প্রেজেন্টেশন। এই বোর্ড প্রেজেন্টেশন এর জন্য সাধারণত আমাদের পুরো ক্লাস এর সবাইকে কিছু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র টিম বা দলে ভাগ করে দেয়া হয় এবং বিভিন্ন সাইটে (দর্শনীয় স্থান/অঞ্চল) পাঠানো হয়। আমরা সেসব সাইটের ম্যাপ, আর্কিটেকচার, বিভিন্ন ছবি, ইতিহাস, চলমান ইনফোরমেশন ইত্যাদি সংগ্রহ করি এবং তার উপর কাজ করে একটা বোর্ডে সাজিয়ে প্রেজেন্ট করতে হয়।

এবার আমাদের টিমের সাইট পড়লো, পানাম। সে সুবাদেই যাওয়া! টিম মেম্বার, সানজিদা নিশাত আকবর, অভিজিৎ বিশ্বাস, হাসান আল মাসুদ, ইসরাত জাহান লিয়া এবং আল ফাহিম ইবনে আশরাফ। এর মধ্যে আল ফাহিম ইবন আশরাফ অসুস্থ থাকায় ভ্রমণের দিন অনুপস্থিত, কিন্তু এদিকে বন্ধু নাফিস আহমেদ সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় শুন্যতা পূরণ।

যাত্রার দিন ঢাকার একেক প্রান্ত থেকে এসে গুলিস্তান মাওলানা ভাসানী স্টেডিয়ামের সামনে সবাই একত্র হলাম! এর মধ্যে আমি আরও এক কাঠি সরেস! সকাল ৫ঃ৩০ টায় রওনা দিয়ে ময়মনসিংহ থেকে এসে গুলিস্তানে সবার সঙ্গে একত্র হলাম!

বেলা ১১ঃ০০ এর দিকে আমরা গুলিস্তান থেকে সোনারগাও মোগড়াপাড়ার উদ্দেশ্যে বাস যাত্রা আরম্ভ করলাম! সোয়া এক ঘন্টার জার্নিতেই পৌছে গেলাম কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে। সেখান থেকে ব্যাটারী চালিত অটো রিক্সায় পানাম। এবার পানামে প্রবেশ পর্ব!

পানাম সম্পর্কে মনে মনে ধারণা করে নিয়েছিলাম, খুব ছিমছাম ঠান্ডা এলাকা হবে, গাছগাছালিতে ভরা থাকবে, পুরনো আবেশে কৃত্রিমতা থাকবেনা, সু-সংরক্ষিত থাকবে এবং আরও কত কী! পানামে ঢুকতে গিয়েই দেখলাম পুলিশি পাহাড়া এবং টিকিট কাটার ব্যবস্থা! এটা দেখে মনটা উৎফুল্ল হয়ে উঠলো! ভাবলাম এখানেও তাহলে বোধ হয় বেশ ভালোভাবেই আহসান মঞ্জিলের মত ঐতিহ্য সংরক্ষণ করা হচ্ছে। যদিও এই ধারণা কাঁটিয়ে দিতে খুব একটা সময় পানাম নিলো না!

যাহোক, ভার্সিটি থেকে প্রজেক্টের কাজ করতে যাবার সুবাদে প্রথমত আমরা বিনা টিকেটেই প্রবেশ করার সুযোগ লাভ করলাম, দ্বিতীয়ত একদম খুবই ঝুকিপূর্ণ বাদে বাকি সবগুলো বাড়ির ভেতরেই ঢুকবার সুযোগ পেলাম, যেটা সাধারণ ট্যুরিস্টরা পেয়ে থাকে না! আমরা দুটো সুযোগেরই পূর্ণ ব্যবহার করলাম! অর্থাৎ বিনা টিকিটে প্রবেশ এবং সম্ভব সবগুলো বাড়িতেই ভেতরে প্রবেশ করলাম, স্থাপনা লক্ষ্য করলাম, পুরাকৌশল নিয়ে আলোচনা করলাম, ছবি তোলা হলো। মোটামুটি প্রজেক্টের জন্য দরকারী সবকিছুই করা হলো।

পানাম সিটি সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা দিতে মোটামুটি এটুকু ধারণাই যথেষ্ট যে, এখানে তিনটা পুল আছে, যথাক্রমে- পানাম পুল, দুলারনগর পুল, পানাম সেতু।

প্রাচীন এই নগরীতে কালের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ৫২ টা বাড়ি। নগরীর প্রধান সড়কের উত্তর পাশে ৩১ টি, আর দক্ষিণ পাশে ২১ টি বাড়ি। পূর্বে ৬০ টি বাড়ি থাকলেও বর্তমানে ৫২ টি বাড়িই পানামের উত্তরাধিকার বহন করছে! বাড়ির ভেতরকার ঘর গুলোর আয়তন ছোট ছোটই সবগুলো। মূলত রড ব্যাতীত বাড়ি তৈরীর কারণে ঘরগুলো ছোট ছোট ছিলো বলেই ধারণা করি।

আয়তনে পানাম এক কিলোমিটার হবে কী হবেনা! পানামের আয়তন এতো ছোট দেখে অবশ্য মনটা বেজায় নারাজ হয়ে যায়! তথাপি প্রজেক্টের কাজ করতে গিয়ে এই ছোট্ট আয়তনের পানাম-কেই বিশাল মনে হচ্ছিলো!

নগরীতে আবাসিক ভবন ছাড়া আরও আছে মসজিদ, মন্দির, গির্জা, মঠ, নাচঘর, পান্থশালা, চিত্রশালা, খাজাঞ্চিখানা, দরবার কক্ষ, গুপ্তপথ, বিচারালয়, পুরোনো জাদুঘর, ৪০০ বছরের পুরানো টাকশাল বাড়ি ইত্যাদি। যদিও টাকশাল বাড়ি এবং জাদুঘর পানাম সিটির মূল অংশ থেকে একটু বাইরের দিকে অবস্থিত।

বাড়িগুলোর আর্কিটেকচারে লক্ষণীয় মূলত ঔপনিবেশিক স্থাপনা এবং পাশাপাশি মুঘল ক্যারেক্টারিস্টিক্স, গ্রিক, গান্ধারা স্থাপত্য।

প্রতিটি বাড়ি আন্ধার বাটি আর বহির্বাটি- দু ভাগে বিভক্ত। বাড়ির মধ্যকোটায় নীল-সাদা রংয়ের আস্তরণ দেখা যায়। বেশীরভাগ বাড়িতেই চার কোণার ভেতর আছে উঠান।

সিটি প্ল্যানিং এর দিক থেকে  শহরটিতে জনবসতি থাকার সময় মোটামুটি পরিকল্পিতই ছিলো বলে মনে হল। পানাম নগরীর পানি সরবরাহের জন্য দু পাশে দুটি খাল আর ৫ টি পুকুর ছিলো। যদিও বর্তমানে পুকুরগুলোর অবস্থা খুবই বাজে প্রতীয়মান! প্রতিটি বাড়িতেই আছে/ছিল কুয়া বা কূপ। দুটো বাড়িতে এখনও লোকজন থাকে দেখলাম। বাড়ির ভেতর দিকগুলো দেখে তৎকালীন পানামের মানুষেরা বেশ আমোদপ্রিয়ই ছিলো বুঝা যায়!

নগরীকে জলাবদ্ধতা মুক্ত রাখতে নগরীকে করা হয়েছিলো খালের দিকে ঢালু। প্রায় প্রতিটি বাড়ি পরস্পর থেকে সম্মানজনক দুরত্বে থাকলেও কিছু কিছু বাড়ি আবার একদম লাগোয়া।

নগরীতে যাতায়াতের জন্য একটি মাত্র রাস্তা, যা নগরীর মাঝ দিয়ে গেছে। অর্থাৎ ওয়েল কমিউনিকেটেড ছিল বুঝা যায়।

পানাম সিটির পাশেই আছে ইসা খা ও মুসা খা এর প্রমোদ ভবন এবং ফতেহ শাহের মসজিদ, সোনাকান্দা দুর্গ, পঞ্চপীড়ের মাজার, কদম রসূল, চিলেকোঠা।

পানামের নীল কুঠি গুলো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর নীল চাষের নীরব স্বাক্ষী (পানাম পুলের কাছে দুলারপুর সড়কের পাশে এর অবস্থান)। শুরুতে এটি ছিল কোম্পানীর মসলিন বস্ত্র ক্রয় এর দপ্তর।

সোনারগাও লোকশিল্প জাদুঘর থেকে পশ্চিমদিকে রয়েছে গোয়ালদি হোসেনশাহী (সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহীর আমলে নির্মিত) মসজিদ।

অনেকটা ১৯৪৭ এ সাম্প্রদায়িক দেশভাগে এবং মূলত ১৯৬৫ এর ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় পানাম নগরী জনশুন্য হয়ে পড়ে। কারণ তৎকালীন পানামের প্রায় সবাই ছিলেন হিন্দু। পাকিস্তান ভারত যুদ্ধের ফলে হিন্দু বিদ্বেষ বাড়ার কারণে পানামের হিন্দু ব্যবসায়ীদের ঘর বাড়ি লুটপাট চালায় মৌলবাদীরা। তখন সবাই প্রায় ভারতে পাড়ি জমায়। এতে নগরী জনশুন্য হয়ে পড়ে। এরপর সরকার অনেক চেষ্টা করলেও নগরীকে আর জাগাতে পারেনি।

এই ঘুরাঘুরির ফাঁকেই চললো পুরোদস্তুর খুনসুঁটি, আড্ডা, দুপুরের খাওয়াদাওয়া, পানামে কর্তব্যরত আনসার এবং অন্যান্য সদস্যদের (কর্মকর্তা-কর্মচারীদের) সঙ্গে পরিচয় পর্ব, আলাপ-আড্ডা ইত্যাদি।

এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য, যদিও এটা একটা গ্রুপ ওয়ার্ক এবং গ্রুপ ট্যুর ছিলো, তথাপি সব কাজ এর ভার আমাদের দলনেত্রী, নিশাত নিজের কাঁধে নিয়েছিলেন এবং ফলস্বরূপ আমরা বাকিরা পুরো ফিল নিয়ে পানাম দেখার সৌভাগ্য অর্জন করি!

তবে একটি ব্যাপার খুব দৃষ্টিকটু ঠেকেছে সকলের কাছেই! সরকারি উদ্যোগ থাকলেও পানামে নেই সেই উদ্যোগের স্বার্থক বাস্তবায়ন কিংবা পরিচর্যা। বাড়িগুলো অব্যবস্থাপনা, অপরিচর্যায় আর কিছুদিনের মধ্যেই কালের গর্ভে হারিয়ে যাবার উপক্রম!

এভাবেই হয়তো বাংলার বুক থেকে হারিয়ে যাবে আরও একটি প্রাচীন গর্ব এবং তার ঐতিহ্য। ভবিষ্যত প্রজন্ম হয়তো ইন্টারনেট কিংবা কোনো গল্পের বইয়ে পড়বে পানাম রূপকথা এবং সোনারগাও বীরত্বগাঁথার গল্প!

সারদিনের খাটা-খাটুনির প্রজেক্ট শেষ করে যখন ফিরবো, গাড়ীতে উঠলাম সবাই মিলে, পানামের দিকে শেষবারের মত তাকিয়ে মনে হচ্ছিলো এই বুঝি পানাম কাঁদছে আমাদের দিকে মুখ করে! কাঁদছে অঝোরে, ডাকছে তার অদৃশ্য দু’হাত বাড়িয়ে আর বলছে, “আমাকে বাঁচাও, আমি অসহায়!”

ফিরে আসলাম শত শত বছরের ঐতিহাসিক জায়গাটি থেকে। ইতোমধ্যে সন্ধ্যে হয়ে গিয়েছিলো। যাত্রাবাড়ি অবধি এসে বন্ধু নাফিসের বাসায় অর্ধেক যাত্রাবিরতি হলো। সেখানে বিকেলের ভোজন পর্ব সেরে আবারও যে যে যার যার বসতির উদ্দেশ্যে রওনা! সর্বোপরি, পানাম ভ্রমণ অভিজ্ঞতা মন্দ ছিলো না। আপনিও চাইলে ঘুরে আসতে পারেন বাংলার স্বাধীনতার প্রাচীন প্রতীক সোনারগাও তথা পানাম সিটিতে।

Tag :

Notice: Trying to access array offset on value of type int in /home/nabajugc/public_html/wp-content/themes/NewsFlash-Pro/template-parts/common/single_two.php on line 177

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

Popular Post

Notice: Undefined index: footer_custom_code in /home/nabajugc/public_html/wp-content/themes/NewsFlash-Pro/footer.php on line 87

গ্রুপ প্রজেক্ট এবং পানাম ভ্রমণের ইতিবৃত্ত

Update Time : 07:58:17 am, Wednesday, 17 April 2019

ফাহিম আহম্মেদ মন্ডল: পানাম সিটি! নামটার মাঝেই লুকিয়ে আছে কত শত বছরের ঐতিহাসিক ঘটনাবলী, ঐতিহ্য, কৃষ্টি, কালচার।

বাংলার তৎকালীন বার ভুইঞাদের  রাজধানী সোনারগাও। আর পানাম-কে বলা হতো “রাজধানীর ভেতর রাজধানী”! শুধুমাত্র এ উপমাটুকু থেকেই পানামের মাহাত্ম্য বুঝা যায়!

মোঘল সম্রাট আকবরের বীর সেনাপতি মানসিংহ-কে পরাজিত করা বাংলার প্রভাবশালী রাজা ঈসা খা, তাঁর পুত্র মুসা খা – প্রভৃতি নানাজনের স্মৃতিঘেরা অঞ্চল সোনারগাও! এ অঞ্চল থেকে বসেই স্বাধীন বাংলার রাজনৈতিক ভাগ্য নির্ধারণ করতেন তাঁরা! আর পানাম ছিলো মূলত রাজধানী শহরের ভেতর ধনিক বণিক শ্রেণীয় ব্যাক্তিবর্গের আবাসস্থল। অনেকটা আধুনিক ঢাকার গুলশান-বারিধারার মতো!

অনেকদিনের ইচ্ছে ছিলো পানাম ঘুরে আসার! আশপাশ-দুরবর্তী মিলিয়ে অনেক এলাকায় ঘুরবার সৌভাগ্য হলেও, কেনো যেনো পানামে যাওয়া হয়ে উঠছিলো না! সময় মেলে তো পকেট ফাঁকা, পকেট ভারী তো সময় নাই, আবার দুটোই আছে তো, সঙ্গী নাই!

যাহোক অবশেষে ১৬ এপ্রিল, ২০১৯ ইং তারিখে আলহামদুলিল্লাহ ঘুরে আসা হলো রাজরাজড়াদের বসতভিটা, সোনারগাওয়ের পানাম সিটি-তে!

নগর পরিকল্পনার একজন ছাত্র হওয়ার সুবাদে আমাদের বেসিক ডিজাইন & গ্রাফিক্স কোর্সের কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বোর্ড প্রেজেন্টেশন। এই বোর্ড প্রেজেন্টেশন এর জন্য সাধারণত আমাদের পুরো ক্লাস এর সবাইকে কিছু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র টিম বা দলে ভাগ করে দেয়া হয় এবং বিভিন্ন সাইটে (দর্শনীয় স্থান/অঞ্চল) পাঠানো হয়। আমরা সেসব সাইটের ম্যাপ, আর্কিটেকচার, বিভিন্ন ছবি, ইতিহাস, চলমান ইনফোরমেশন ইত্যাদি সংগ্রহ করি এবং তার উপর কাজ করে একটা বোর্ডে সাজিয়ে প্রেজেন্ট করতে হয়।

এবার আমাদের টিমের সাইট পড়লো, পানাম। সে সুবাদেই যাওয়া! টিম মেম্বার, সানজিদা নিশাত আকবর, অভিজিৎ বিশ্বাস, হাসান আল মাসুদ, ইসরাত জাহান লিয়া এবং আল ফাহিম ইবনে আশরাফ। এর মধ্যে আল ফাহিম ইবন আশরাফ অসুস্থ থাকায় ভ্রমণের দিন অনুপস্থিত, কিন্তু এদিকে বন্ধু নাফিস আহমেদ সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় শুন্যতা পূরণ।

যাত্রার দিন ঢাকার একেক প্রান্ত থেকে এসে গুলিস্তান মাওলানা ভাসানী স্টেডিয়ামের সামনে সবাই একত্র হলাম! এর মধ্যে আমি আরও এক কাঠি সরেস! সকাল ৫ঃ৩০ টায় রওনা দিয়ে ময়মনসিংহ থেকে এসে গুলিস্তানে সবার সঙ্গে একত্র হলাম!

বেলা ১১ঃ০০ এর দিকে আমরা গুলিস্তান থেকে সোনারগাও মোগড়াপাড়ার উদ্দেশ্যে বাস যাত্রা আরম্ভ করলাম! সোয়া এক ঘন্টার জার্নিতেই পৌছে গেলাম কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে। সেখান থেকে ব্যাটারী চালিত অটো রিক্সায় পানাম। এবার পানামে প্রবেশ পর্ব!

পানাম সম্পর্কে মনে মনে ধারণা করে নিয়েছিলাম, খুব ছিমছাম ঠান্ডা এলাকা হবে, গাছগাছালিতে ভরা থাকবে, পুরনো আবেশে কৃত্রিমতা থাকবেনা, সু-সংরক্ষিত থাকবে এবং আরও কত কী! পানামে ঢুকতে গিয়েই দেখলাম পুলিশি পাহাড়া এবং টিকিট কাটার ব্যবস্থা! এটা দেখে মনটা উৎফুল্ল হয়ে উঠলো! ভাবলাম এখানেও তাহলে বোধ হয় বেশ ভালোভাবেই আহসান মঞ্জিলের মত ঐতিহ্য সংরক্ষণ করা হচ্ছে। যদিও এই ধারণা কাঁটিয়ে দিতে খুব একটা সময় পানাম নিলো না!

যাহোক, ভার্সিটি থেকে প্রজেক্টের কাজ করতে যাবার সুবাদে প্রথমত আমরা বিনা টিকেটেই প্রবেশ করার সুযোগ লাভ করলাম, দ্বিতীয়ত একদম খুবই ঝুকিপূর্ণ বাদে বাকি সবগুলো বাড়ির ভেতরেই ঢুকবার সুযোগ পেলাম, যেটা সাধারণ ট্যুরিস্টরা পেয়ে থাকে না! আমরা দুটো সুযোগেরই পূর্ণ ব্যবহার করলাম! অর্থাৎ বিনা টিকিটে প্রবেশ এবং সম্ভব সবগুলো বাড়িতেই ভেতরে প্রবেশ করলাম, স্থাপনা লক্ষ্য করলাম, পুরাকৌশল নিয়ে আলোচনা করলাম, ছবি তোলা হলো। মোটামুটি প্রজেক্টের জন্য দরকারী সবকিছুই করা হলো।

পানাম সিটি সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা দিতে মোটামুটি এটুকু ধারণাই যথেষ্ট যে, এখানে তিনটা পুল আছে, যথাক্রমে- পানাম পুল, দুলারনগর পুল, পানাম সেতু।

প্রাচীন এই নগরীতে কালের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ৫২ টা বাড়ি। নগরীর প্রধান সড়কের উত্তর পাশে ৩১ টি, আর দক্ষিণ পাশে ২১ টি বাড়ি। পূর্বে ৬০ টি বাড়ি থাকলেও বর্তমানে ৫২ টি বাড়িই পানামের উত্তরাধিকার বহন করছে! বাড়ির ভেতরকার ঘর গুলোর আয়তন ছোট ছোটই সবগুলো। মূলত রড ব্যাতীত বাড়ি তৈরীর কারণে ঘরগুলো ছোট ছোট ছিলো বলেই ধারণা করি।

আয়তনে পানাম এক কিলোমিটার হবে কী হবেনা! পানামের আয়তন এতো ছোট দেখে অবশ্য মনটা বেজায় নারাজ হয়ে যায়! তথাপি প্রজেক্টের কাজ করতে গিয়ে এই ছোট্ট আয়তনের পানাম-কেই বিশাল মনে হচ্ছিলো!

নগরীতে আবাসিক ভবন ছাড়া আরও আছে মসজিদ, মন্দির, গির্জা, মঠ, নাচঘর, পান্থশালা, চিত্রশালা, খাজাঞ্চিখানা, দরবার কক্ষ, গুপ্তপথ, বিচারালয়, পুরোনো জাদুঘর, ৪০০ বছরের পুরানো টাকশাল বাড়ি ইত্যাদি। যদিও টাকশাল বাড়ি এবং জাদুঘর পানাম সিটির মূল অংশ থেকে একটু বাইরের দিকে অবস্থিত।

বাড়িগুলোর আর্কিটেকচারে লক্ষণীয় মূলত ঔপনিবেশিক স্থাপনা এবং পাশাপাশি মুঘল ক্যারেক্টারিস্টিক্স, গ্রিক, গান্ধারা স্থাপত্য।

প্রতিটি বাড়ি আন্ধার বাটি আর বহির্বাটি- দু ভাগে বিভক্ত। বাড়ির মধ্যকোটায় নীল-সাদা রংয়ের আস্তরণ দেখা যায়। বেশীরভাগ বাড়িতেই চার কোণার ভেতর আছে উঠান।

সিটি প্ল্যানিং এর দিক থেকে  শহরটিতে জনবসতি থাকার সময় মোটামুটি পরিকল্পিতই ছিলো বলে মনে হল। পানাম নগরীর পানি সরবরাহের জন্য দু পাশে দুটি খাল আর ৫ টি পুকুর ছিলো। যদিও বর্তমানে পুকুরগুলোর অবস্থা খুবই বাজে প্রতীয়মান! প্রতিটি বাড়িতেই আছে/ছিল কুয়া বা কূপ। দুটো বাড়িতে এখনও লোকজন থাকে দেখলাম। বাড়ির ভেতর দিকগুলো দেখে তৎকালীন পানামের মানুষেরা বেশ আমোদপ্রিয়ই ছিলো বুঝা যায়!

নগরীকে জলাবদ্ধতা মুক্ত রাখতে নগরীকে করা হয়েছিলো খালের দিকে ঢালু। প্রায় প্রতিটি বাড়ি পরস্পর থেকে সম্মানজনক দুরত্বে থাকলেও কিছু কিছু বাড়ি আবার একদম লাগোয়া।

নগরীতে যাতায়াতের জন্য একটি মাত্র রাস্তা, যা নগরীর মাঝ দিয়ে গেছে। অর্থাৎ ওয়েল কমিউনিকেটেড ছিল বুঝা যায়।

পানাম সিটির পাশেই আছে ইসা খা ও মুসা খা এর প্রমোদ ভবন এবং ফতেহ শাহের মসজিদ, সোনাকান্দা দুর্গ, পঞ্চপীড়ের মাজার, কদম রসূল, চিলেকোঠা।

পানামের নীল কুঠি গুলো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর নীল চাষের নীরব স্বাক্ষী (পানাম পুলের কাছে দুলারপুর সড়কের পাশে এর অবস্থান)। শুরুতে এটি ছিল কোম্পানীর মসলিন বস্ত্র ক্রয় এর দপ্তর।

সোনারগাও লোকশিল্প জাদুঘর থেকে পশ্চিমদিকে রয়েছে গোয়ালদি হোসেনশাহী (সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহীর আমলে নির্মিত) মসজিদ।

অনেকটা ১৯৪৭ এ সাম্প্রদায়িক দেশভাগে এবং মূলত ১৯৬৫ এর ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় পানাম নগরী জনশুন্য হয়ে পড়ে। কারণ তৎকালীন পানামের প্রায় সবাই ছিলেন হিন্দু। পাকিস্তান ভারত যুদ্ধের ফলে হিন্দু বিদ্বেষ বাড়ার কারণে পানামের হিন্দু ব্যবসায়ীদের ঘর বাড়ি লুটপাট চালায় মৌলবাদীরা। তখন সবাই প্রায় ভারতে পাড়ি জমায়। এতে নগরী জনশুন্য হয়ে পড়ে। এরপর সরকার অনেক চেষ্টা করলেও নগরীকে আর জাগাতে পারেনি।

এই ঘুরাঘুরির ফাঁকেই চললো পুরোদস্তুর খুনসুঁটি, আড্ডা, দুপুরের খাওয়াদাওয়া, পানামে কর্তব্যরত আনসার এবং অন্যান্য সদস্যদের (কর্মকর্তা-কর্মচারীদের) সঙ্গে পরিচয় পর্ব, আলাপ-আড্ডা ইত্যাদি।

এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য, যদিও এটা একটা গ্রুপ ওয়ার্ক এবং গ্রুপ ট্যুর ছিলো, তথাপি সব কাজ এর ভার আমাদের দলনেত্রী, নিশাত নিজের কাঁধে নিয়েছিলেন এবং ফলস্বরূপ আমরা বাকিরা পুরো ফিল নিয়ে পানাম দেখার সৌভাগ্য অর্জন করি!

তবে একটি ব্যাপার খুব দৃষ্টিকটু ঠেকেছে সকলের কাছেই! সরকারি উদ্যোগ থাকলেও পানামে নেই সেই উদ্যোগের স্বার্থক বাস্তবায়ন কিংবা পরিচর্যা। বাড়িগুলো অব্যবস্থাপনা, অপরিচর্যায় আর কিছুদিনের মধ্যেই কালের গর্ভে হারিয়ে যাবার উপক্রম!

এভাবেই হয়তো বাংলার বুক থেকে হারিয়ে যাবে আরও একটি প্রাচীন গর্ব এবং তার ঐতিহ্য। ভবিষ্যত প্রজন্ম হয়তো ইন্টারনেট কিংবা কোনো গল্পের বইয়ে পড়বে পানাম রূপকথা এবং সোনারগাও বীরত্বগাঁথার গল্প!

সারদিনের খাটা-খাটুনির প্রজেক্ট শেষ করে যখন ফিরবো, গাড়ীতে উঠলাম সবাই মিলে, পানামের দিকে শেষবারের মত তাকিয়ে মনে হচ্ছিলো এই বুঝি পানাম কাঁদছে আমাদের দিকে মুখ করে! কাঁদছে অঝোরে, ডাকছে তার অদৃশ্য দু’হাত বাড়িয়ে আর বলছে, “আমাকে বাঁচাও, আমি অসহায়!”

ফিরে আসলাম শত শত বছরের ঐতিহাসিক জায়গাটি থেকে। ইতোমধ্যে সন্ধ্যে হয়ে গিয়েছিলো। যাত্রাবাড়ি অবধি এসে বন্ধু নাফিসের বাসায় অর্ধেক যাত্রাবিরতি হলো। সেখানে বিকেলের ভোজন পর্ব সেরে আবারও যে যে যার যার বসতির উদ্দেশ্যে রওনা! সর্বোপরি, পানাম ভ্রমণ অভিজ্ঞতা মন্দ ছিলো না। আপনিও চাইলে ঘুরে আসতে পারেন বাংলার স্বাধীনতার প্রাচীন প্রতীক সোনারগাও তথা পানাম সিটিতে।