১২:১১ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

একাত্তরের গণহত্যা প্রত্যাখ্যান করেছিলো মার্কিন প্রশাসন

প্রশান্ত দীক্ষিত ।। ইন্ডিয়া নিউজ নেটওয়ার্ক: ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে পালিত হলো মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয়ের সুবর্ণ জয়ন্তী। এই উৎসবের আমেজে মেতেছে ভারত ও বাংলাদেশ উভয় রাষ্ট্রের লাখো-কোটি আমজনতা। বিগত ৫০ বছরে বাংলাদেশের অর্জনের খাতায় রয়েছে অসংখ্য সাফল্যের পালক। তবে এই অর্জন-সাফল্যের পেছনের যে ইতিহাস, অর্থাৎ ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধ, সেটি নিশ্চিতরূপেই ছিলো কঙ্কটাপূর্ণ।

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি আওড়ালেই আমরা দেখতে পাই পাকিস্তান সরকার কর্তৃক তৎকালীন পূর্ব বাংলার মানুষের উপর চালানো জঘন্য গণহত্যার গল্প! মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে জড়িত মানুষ গুলোর চোখে-মুখে আমরা শুনতে পাই পাক সামরিক জান্তার নির্মম অত্যাচারের কাহিনী! আজ এই উৎসবের ঘনঘটার মাঝেও পাক বাহিনী কর্তৃক চালানো ঘৃণ্য গণহত্যার কথা স্মরণ করলেই শোকে পাথর হয়ে পড়েন অনেকে।

এটা খুবই দুঃখের বিষয় যে গণহত্যার তুলনামূলক গবেষণায় বাংলাদেশের গণহত্যা বেশ স্বল্পই পরিচিত। তারপরও তুলনামূলক বিচারে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যা বিশ শতকের অন্যতম ভয়াবহ ও ধ্বংসাত্মক গণহত্যাগুলোর একটি। ৩০ লাখ মানুষ সেই গণহত্যার শিকার হয়েছিলেন।

নিতান্তই পরিতাপের বিষয়, এত বর্বরোচিত একটি গণহত্যা চালানোর পরও দেশ হিসাবে পাকিস্তানের কোনো আফসোস নেই! নেই কোনো অনুশোচনাবোধ! আজ অবধি পাকিস্তান এই জঘন্য কাজের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের জনগনের নিকট ক্ষমা তো চায়ইনি, কোনো ক্ষতিপূরণও পরিশোধ করেনি।

তবে পাকিস্তান ক্ষমা না চাইলেও যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে পাক যুদ্ধাপরাধীদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করতে বাধ্য হয় বাংলাদেশ। কেননা তখনও পর্যন্ত পাকিস্তানে অনেক বাঙালী আটকে ছিলেন। তাঁদের মুক্তির জন্য এর বিকল্পও কিছু ছিলো না। পাকিস্তানের তৎকালীন শাসক ভুট্টো এবং জিয়া-উল-হক উভয়ই ছলচাতুরির মাধ্যমে বাংলাদেশকে এমন ঘোষণা দিতে বাধ্য করেন। এটিও ইতিহাসের অন্যতম ঘৃণ্য ও কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।

ইসলামাবাদের জিও টিভির নির্বাহী সম্পাদক এবং দিল্লিতে অনুষ্ঠিত সার্ক লেখক সম্মেলনে সার্ক লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড প্রাপ্ত সাংবাদিক জনাব হামিদ মীর ২০১০ সালে লিখেছিলেন, “জেনারেল টিক্কা খানকে এখনও “বাংলার কসাই” হিসাবে স্মরণ করা হয়।”

ইতিহাসের পাতা উল্টালেই দেখা যায়, ৭১ এর শুরুর দিকে পাক সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের দায়িত্ব গ্রহণ করেন নিন্দিত এই জেনারেল এবং পরবর্তীতে নিজ লবি কাজে লাগিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হিসেবেও নিযুক্ত হোন তিনি।

গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পরই আওয়ামী লীগ তথা মুক্তিযুদ্ধের সকল প্রচেষ্টাকে অঙ্কুরে বিনষ্ট করে দিতে সমস্ত শক্তির প্রয়োগ করেন তিনি। যদিও তার সমস্ত প্রচেষ্টা ঘৃণিত, নিন্দিত এবং ব্যর্থ প্রমাণিত হয়, তথাপি মার্কিন আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে পরবর্তীতে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান হিসেবেও দায়িত্ব নেন তিনি। ২০০২ সালে মৃত্যুর পর পূর্ণ সামরিক সম্মানের সাথে তাকে সমাহিত করা হয়।

অথচ এই টিক্কা খানের উপর ছিলো হাজারো-লাখো নিরীহ বাঙালী হত্যার অভিযোগ! গোটা ব্যাপারটি পাকিস্তানের নির্লজ্জতা ও বর্বরতার আরও একটি উদাহরণ মাত্র! এসব গণহত্যা যখন পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত হয়, তখন মার্কিন রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন রিচার্ড নিক্সন এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ছিলেন হেনরি কিসিঞ্জার। সে সময় পাকিস্তান সরকারের সুপ্রিমো ছিলেন জেনারেল ইয়াহিয়া খান।

পাক সরকারের এসব অপকর্মে নির্লজ্জের মতো সমর্থন দিয়ে যায় নিক্সন-কিসিঞ্জার জুটি। এর পেছনে তারাও নিজেদের স্বার্থ খুঁজে নিয়েছিলেন। তৎকালীন মার্কিন প্রসার বাড়ানোর জন্য চীনের সঙ্গে সংলাপের দ্বার উন্মোচিত হওয়াটা ছিলো যুক্তরাষ্ট্রের ভীষণ প্রয়োজন। সে কাজে তারা তুরুপের তাস হিসেবে ব্যবহার করে ইয়াহিয়া খানকে। পাক জেনারেলের সঙ্গে সখ্যতার প্রতিদান স্বরূপ ঘৃণা গণহত্যার প্রতিবাদ তো দূর, উলটো গোটা অভিযোগই প্রত্যাখান করে মার্কিন প্রশাসন। ব্যাপারটা আমেরিকান কলামিস্ট গ্যারি জে বাস তার গ্রন্থ ‘দ্য ব্লাড টেলিগ্রাম’-এও উল্লেখ করেছেন।

ইয়াহিয়া খান যখন পূর্ব পাকিস্তানে নিজ জনগণকেই পিষে ফেলতে ব্যস্ত, তখন মার্কিন নেতৃত্বের নজর ছিলো ওয়াশিংটন-বেইজিং আলোচনা অব্যহত রাখতে পাক নেতৃত্বের বৈধতা নিশ্চিত করা। আর তা করতে গিয়ে কিসিঞ্জার পাকিস্তানকে রক্ষা করার জন্য চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন-লাইকে গোপনে ভারতকে হুমকি দেওয়ার জন্য সৈন্য সংগ্রহ করতে বলেছিলেন বলেও জানা যায়। ঘটনাটি ভারত-পাকিস্তান সরাসরি যুদ্ধ শুরুর পূর্বেই ঘটেছিলো বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়।

সেসময়, ভারতকে রীতিমতো শত্রু হিসেবেই বিবেচনা করছিলো নিক্সন-কিসিঞ্জার জুটি। তাদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিলো ভারত সবসময়ই সোভিয়েত রাশিয়ার কৌশলগত মিত্র ও বিশ্বস্ত। তাছাড়া, ভারত ও সোভিয়েতের মধ্যে ততোদিনে একটি পারস্পরিক সুরক্ষা চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়ে গিয়েছিলো। তাই ভারতকে চাপে রাখতে এসব কূটকৌশল অবলম্বনের পথ বেছে নেন মার্কিন প্রশাসন। যার আভাস পাবার পরই ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল স্যাম মানেকশ তাঁর কমান্ডারদের যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নেয়ার কথা বলেন।

কিসিঞ্জার-নিক্সন জুটি ইয়াহিয়ার প্রতি কতোটা সহমর্মী ছিলেন, তার প্রমাণ পাওয়া যায় একটি ঘটনায়। মার্কিন কংগ্রেসে নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রাষ্ট্রপতির বিশেষ ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে প্রায় ৫০ মিলিয়ন ডলারের সামরিক সহায়তা করে পাকিস্তানকে। এসব অস্ত্র, ফাইটার জেট এবং দ্রুত ফায়ার অস্ত্র দ্বারা সমর্থিত আধুনিক ট্যাঙ্কসমূহ পাক বাহিনী কাজে লাগায় পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা চালাতে।

অনেকেই ভুলে গিয়েছেন হয়তো, ঢাকাস্থ মার্কিন কনস্যুলেট ৭১ সালের মার্চের সূচনালগ্ন থেকেই এই গণহত্যার সাক্ষী ছিল এবং করাচি ও ওয়াশিংটনে বসে তাদের প্রভুদের হত্যাকাণ্ডের বাস্তব প্রতিবেদন পেশ করেছিল। এই প্রক্রিয়ার নেতৃত্বে ছিলেন ঢাকাস্থ আমেরিকান কনসাল জেনারেল আর্চার ব্লাড।

কিন্তু এসব বাস্তব প্রতিবেদন হাতে পাবার পরও তা উপেক্ষা করার নীতি নেয় মার্কিন প্রশাসন। কিন্তু তৎকালীন মার্কিন কর্মকর্তাদের মধ্যে মানবিক একাংশ অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে এই নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। তাঁরা ওয়াশিংটনে বিখ্যাত ‘ব্লাড টেলিগ্রাম’ পাঠিয়েছিলেন, যেখানে তারা গণহত্যাকে গণহত্যা বলে অভিহিত করেছিল।

ঘটনাটি সমস্ত মার্কিন প্রশাসনকে নাড়িয়ে দেয়। সত্য প্রকাশের এই মিছিলে ভারতে নিযুক্ত তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত কেনেথ কিটিং মিত্র রূপে আবির্ভূত হোন। নিক্সন এবং কিসিঞ্জার উভয়কে পাকবাহিনীর রক্তস্নানের কথা জানান তিনি অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে।

কিন্তু গোটা দুনিয়ায় উঠা প্রতিবাদের ঝড় আমলে নেননি নিক্সন-কিসিঞ্জার জুটি। নিক্সন তো একবার এও বলে ফেলেন যে, “এটা ইয়াহিয়ার ব্যবসা। কয়েকটা বাঙালি মারা গেলে কী হবে!” তবে তাঁদের এই অহমিকার পতন হতে বেশি দেরী লাগেনি। তবে আফসোস, আজকের প্রজন্মের বেশিরভাগই ব্লাড এবং কিটিং উভয়ের ভূমিকা সম্পর্কেই অজ্ঞাত।

আজ ভাবতেই অবাক লাগে, বিশ্বজুড়ে মানবিকতার বার্তা ছড়ানো মার্কিন প্রশাসন কীভাবে সেদিন অন্ধ-বধির হয়ে গিয়েছিলো। পৃথিবীর ইতিহাসে মানবতার প্রতি অন্যতম বিশ্বাসঘাতকতা হয়ে থাকবে তাদের কার্যকলাপ। নিঃসন্দেহে এমন ঘৃণ্য অবস্থানের জন্য উভয়েরই শাস্তি হওয়া উচিত ছিলো। কিন্তু পৃথিবীর আইনে তারা বেচে গিয়েছেন।

তবে কথায় আছে, পাপ তার বাপকেও ছাড়েনা! কথাটি সত্য প্রমাণিত হয়েছিলো মার্কিন শীর্ষ নেতৃত্বের প্রতি। শেষ পর্যন্ত ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে তার প্রস্থান ঘটে মার্কিন রাজনীতি থেকে। অন্যদিকে কিসিঞ্জারও ধীরে ধীরে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েন জাতীয় রাজনীতিতে। যদিও বাংলাদেশের প্রতি তাদের যে পাপ, তার তুলনায় এসব শাস্তি কিছুই না, তথাপি পৃথিবীর লাখো-কোটি মানুষের ঘৃণা তাদের শান্তিতে থাকতে দিয়েছে বলে মনে হয়না!

শেষ করবো ভারত মার্কিন সম্পর্কের কথা টেনে। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত পতনের পূর্ব পর্যন্ত ভারতকে শত্রু হিসেবেই জ্ঞান করতো তৎকালীন মার্কিন নেতৃবৃন্দ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ব্যাপারটায় নতুন মাত্রা যোগ করে। পরবর্তীতে পরিস্থিতির সাথে সাথে যদিও মার্কিন ভারত সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়েছে, এমনকি হালের কোয়াড গঠনেও একযোগে কাজ করেছে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র, তথাপি সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে উদ্ভূত রাশিয়া এবং ভারত সব আবহাওয়ার বন্ধু হিসেবেই আজও রয়ে গিয়েছে।

লেখক: কূটনীতিক বিশেষজ্ঞ। (প্রকাশিত মতামত সম্পূর্ণ তাঁর ব্যক্তিগত)

ট্যাগ:
জনপ্রিয়

একাত্তরের গণহত্যা প্রত্যাখ্যান করেছিলো মার্কিন প্রশাসন

প্রকাশ: ০১:৩৫:১৪ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৮ ডিসেম্বর ২০২১

প্রশান্ত দীক্ষিত ।। ইন্ডিয়া নিউজ নেটওয়ার্ক: ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে পালিত হলো মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয়ের সুবর্ণ জয়ন্তী। এই উৎসবের আমেজে মেতেছে ভারত ও বাংলাদেশ উভয় রাষ্ট্রের লাখো-কোটি আমজনতা। বিগত ৫০ বছরে বাংলাদেশের অর্জনের খাতায় রয়েছে অসংখ্য সাফল্যের পালক। তবে এই অর্জন-সাফল্যের পেছনের যে ইতিহাস, অর্থাৎ ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধ, সেটি নিশ্চিতরূপেই ছিলো কঙ্কটাপূর্ণ।

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি আওড়ালেই আমরা দেখতে পাই পাকিস্তান সরকার কর্তৃক তৎকালীন পূর্ব বাংলার মানুষের উপর চালানো জঘন্য গণহত্যার গল্প! মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে জড়িত মানুষ গুলোর চোখে-মুখে আমরা শুনতে পাই পাক সামরিক জান্তার নির্মম অত্যাচারের কাহিনী! আজ এই উৎসবের ঘনঘটার মাঝেও পাক বাহিনী কর্তৃক চালানো ঘৃণ্য গণহত্যার কথা স্মরণ করলেই শোকে পাথর হয়ে পড়েন অনেকে।

এটা খুবই দুঃখের বিষয় যে গণহত্যার তুলনামূলক গবেষণায় বাংলাদেশের গণহত্যা বেশ স্বল্পই পরিচিত। তারপরও তুলনামূলক বিচারে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যা বিশ শতকের অন্যতম ভয়াবহ ও ধ্বংসাত্মক গণহত্যাগুলোর একটি। ৩০ লাখ মানুষ সেই গণহত্যার শিকার হয়েছিলেন।

নিতান্তই পরিতাপের বিষয়, এত বর্বরোচিত একটি গণহত্যা চালানোর পরও দেশ হিসাবে পাকিস্তানের কোনো আফসোস নেই! নেই কোনো অনুশোচনাবোধ! আজ অবধি পাকিস্তান এই জঘন্য কাজের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের জনগনের নিকট ক্ষমা তো চায়ইনি, কোনো ক্ষতিপূরণও পরিশোধ করেনি।

তবে পাকিস্তান ক্ষমা না চাইলেও যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে পাক যুদ্ধাপরাধীদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করতে বাধ্য হয় বাংলাদেশ। কেননা তখনও পর্যন্ত পাকিস্তানে অনেক বাঙালী আটকে ছিলেন। তাঁদের মুক্তির জন্য এর বিকল্পও কিছু ছিলো না। পাকিস্তানের তৎকালীন শাসক ভুট্টো এবং জিয়া-উল-হক উভয়ই ছলচাতুরির মাধ্যমে বাংলাদেশকে এমন ঘোষণা দিতে বাধ্য করেন। এটিও ইতিহাসের অন্যতম ঘৃণ্য ও কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।

ইসলামাবাদের জিও টিভির নির্বাহী সম্পাদক এবং দিল্লিতে অনুষ্ঠিত সার্ক লেখক সম্মেলনে সার্ক লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড প্রাপ্ত সাংবাদিক জনাব হামিদ মীর ২০১০ সালে লিখেছিলেন, “জেনারেল টিক্কা খানকে এখনও “বাংলার কসাই” হিসাবে স্মরণ করা হয়।”

ইতিহাসের পাতা উল্টালেই দেখা যায়, ৭১ এর শুরুর দিকে পাক সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের দায়িত্ব গ্রহণ করেন নিন্দিত এই জেনারেল এবং পরবর্তীতে নিজ লবি কাজে লাগিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হিসেবেও নিযুক্ত হোন তিনি।

গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পরই আওয়ামী লীগ তথা মুক্তিযুদ্ধের সকল প্রচেষ্টাকে অঙ্কুরে বিনষ্ট করে দিতে সমস্ত শক্তির প্রয়োগ করেন তিনি। যদিও তার সমস্ত প্রচেষ্টা ঘৃণিত, নিন্দিত এবং ব্যর্থ প্রমাণিত হয়, তথাপি মার্কিন আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে পরবর্তীতে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান হিসেবেও দায়িত্ব নেন তিনি। ২০০২ সালে মৃত্যুর পর পূর্ণ সামরিক সম্মানের সাথে তাকে সমাহিত করা হয়।

অথচ এই টিক্কা খানের উপর ছিলো হাজারো-লাখো নিরীহ বাঙালী হত্যার অভিযোগ! গোটা ব্যাপারটি পাকিস্তানের নির্লজ্জতা ও বর্বরতার আরও একটি উদাহরণ মাত্র! এসব গণহত্যা যখন পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত হয়, তখন মার্কিন রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন রিচার্ড নিক্সন এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ছিলেন হেনরি কিসিঞ্জার। সে সময় পাকিস্তান সরকারের সুপ্রিমো ছিলেন জেনারেল ইয়াহিয়া খান।

পাক সরকারের এসব অপকর্মে নির্লজ্জের মতো সমর্থন দিয়ে যায় নিক্সন-কিসিঞ্জার জুটি। এর পেছনে তারাও নিজেদের স্বার্থ খুঁজে নিয়েছিলেন। তৎকালীন মার্কিন প্রসার বাড়ানোর জন্য চীনের সঙ্গে সংলাপের দ্বার উন্মোচিত হওয়াটা ছিলো যুক্তরাষ্ট্রের ভীষণ প্রয়োজন। সে কাজে তারা তুরুপের তাস হিসেবে ব্যবহার করে ইয়াহিয়া খানকে। পাক জেনারেলের সঙ্গে সখ্যতার প্রতিদান স্বরূপ ঘৃণা গণহত্যার প্রতিবাদ তো দূর, উলটো গোটা অভিযোগই প্রত্যাখান করে মার্কিন প্রশাসন। ব্যাপারটা আমেরিকান কলামিস্ট গ্যারি জে বাস তার গ্রন্থ ‘দ্য ব্লাড টেলিগ্রাম’-এও উল্লেখ করেছেন।

ইয়াহিয়া খান যখন পূর্ব পাকিস্তানে নিজ জনগণকেই পিষে ফেলতে ব্যস্ত, তখন মার্কিন নেতৃত্বের নজর ছিলো ওয়াশিংটন-বেইজিং আলোচনা অব্যহত রাখতে পাক নেতৃত্বের বৈধতা নিশ্চিত করা। আর তা করতে গিয়ে কিসিঞ্জার পাকিস্তানকে রক্ষা করার জন্য চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন-লাইকে গোপনে ভারতকে হুমকি দেওয়ার জন্য সৈন্য সংগ্রহ করতে বলেছিলেন বলেও জানা যায়। ঘটনাটি ভারত-পাকিস্তান সরাসরি যুদ্ধ শুরুর পূর্বেই ঘটেছিলো বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়।

সেসময়, ভারতকে রীতিমতো শত্রু হিসেবেই বিবেচনা করছিলো নিক্সন-কিসিঞ্জার জুটি। তাদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিলো ভারত সবসময়ই সোভিয়েত রাশিয়ার কৌশলগত মিত্র ও বিশ্বস্ত। তাছাড়া, ভারত ও সোভিয়েতের মধ্যে ততোদিনে একটি পারস্পরিক সুরক্ষা চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়ে গিয়েছিলো। তাই ভারতকে চাপে রাখতে এসব কূটকৌশল অবলম্বনের পথ বেছে নেন মার্কিন প্রশাসন। যার আভাস পাবার পরই ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল স্যাম মানেকশ তাঁর কমান্ডারদের যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নেয়ার কথা বলেন।

কিসিঞ্জার-নিক্সন জুটি ইয়াহিয়ার প্রতি কতোটা সহমর্মী ছিলেন, তার প্রমাণ পাওয়া যায় একটি ঘটনায়। মার্কিন কংগ্রেসে নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রাষ্ট্রপতির বিশেষ ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে প্রায় ৫০ মিলিয়ন ডলারের সামরিক সহায়তা করে পাকিস্তানকে। এসব অস্ত্র, ফাইটার জেট এবং দ্রুত ফায়ার অস্ত্র দ্বারা সমর্থিত আধুনিক ট্যাঙ্কসমূহ পাক বাহিনী কাজে লাগায় পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা চালাতে।

অনেকেই ভুলে গিয়েছেন হয়তো, ঢাকাস্থ মার্কিন কনস্যুলেট ৭১ সালের মার্চের সূচনালগ্ন থেকেই এই গণহত্যার সাক্ষী ছিল এবং করাচি ও ওয়াশিংটনে বসে তাদের প্রভুদের হত্যাকাণ্ডের বাস্তব প্রতিবেদন পেশ করেছিল। এই প্রক্রিয়ার নেতৃত্বে ছিলেন ঢাকাস্থ আমেরিকান কনসাল জেনারেল আর্চার ব্লাড।

কিন্তু এসব বাস্তব প্রতিবেদন হাতে পাবার পরও তা উপেক্ষা করার নীতি নেয় মার্কিন প্রশাসন। কিন্তু তৎকালীন মার্কিন কর্মকর্তাদের মধ্যে মানবিক একাংশ অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে এই নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। তাঁরা ওয়াশিংটনে বিখ্যাত ‘ব্লাড টেলিগ্রাম’ পাঠিয়েছিলেন, যেখানে তারা গণহত্যাকে গণহত্যা বলে অভিহিত করেছিল।

ঘটনাটি সমস্ত মার্কিন প্রশাসনকে নাড়িয়ে দেয়। সত্য প্রকাশের এই মিছিলে ভারতে নিযুক্ত তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত কেনেথ কিটিং মিত্র রূপে আবির্ভূত হোন। নিক্সন এবং কিসিঞ্জার উভয়কে পাকবাহিনীর রক্তস্নানের কথা জানান তিনি অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে।

কিন্তু গোটা দুনিয়ায় উঠা প্রতিবাদের ঝড় আমলে নেননি নিক্সন-কিসিঞ্জার জুটি। নিক্সন তো একবার এও বলে ফেলেন যে, “এটা ইয়াহিয়ার ব্যবসা। কয়েকটা বাঙালি মারা গেলে কী হবে!” তবে তাঁদের এই অহমিকার পতন হতে বেশি দেরী লাগেনি। তবে আফসোস, আজকের প্রজন্মের বেশিরভাগই ব্লাড এবং কিটিং উভয়ের ভূমিকা সম্পর্কেই অজ্ঞাত।

আজ ভাবতেই অবাক লাগে, বিশ্বজুড়ে মানবিকতার বার্তা ছড়ানো মার্কিন প্রশাসন কীভাবে সেদিন অন্ধ-বধির হয়ে গিয়েছিলো। পৃথিবীর ইতিহাসে মানবতার প্রতি অন্যতম বিশ্বাসঘাতকতা হয়ে থাকবে তাদের কার্যকলাপ। নিঃসন্দেহে এমন ঘৃণ্য অবস্থানের জন্য উভয়েরই শাস্তি হওয়া উচিত ছিলো। কিন্তু পৃথিবীর আইনে তারা বেচে গিয়েছেন।

তবে কথায় আছে, পাপ তার বাপকেও ছাড়েনা! কথাটি সত্য প্রমাণিত হয়েছিলো মার্কিন শীর্ষ নেতৃত্বের প্রতি। শেষ পর্যন্ত ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে তার প্রস্থান ঘটে মার্কিন রাজনীতি থেকে। অন্যদিকে কিসিঞ্জারও ধীরে ধীরে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েন জাতীয় রাজনীতিতে। যদিও বাংলাদেশের প্রতি তাদের যে পাপ, তার তুলনায় এসব শাস্তি কিছুই না, তথাপি পৃথিবীর লাখো-কোটি মানুষের ঘৃণা তাদের শান্তিতে থাকতে দিয়েছে বলে মনে হয়না!

শেষ করবো ভারত মার্কিন সম্পর্কের কথা টেনে। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত পতনের পূর্ব পর্যন্ত ভারতকে শত্রু হিসেবেই জ্ঞান করতো তৎকালীন মার্কিন নেতৃবৃন্দ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ব্যাপারটায় নতুন মাত্রা যোগ করে। পরবর্তীতে পরিস্থিতির সাথে সাথে যদিও মার্কিন ভারত সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়েছে, এমনকি হালের কোয়াড গঠনেও একযোগে কাজ করেছে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র, তথাপি সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে উদ্ভূত রাশিয়া এবং ভারত সব আবহাওয়ার বন্ধু হিসেবেই আজও রয়ে গিয়েছে।

লেখক: কূটনীতিক বিশেষজ্ঞ। (প্রকাশিত মতামত সম্পূর্ণ তাঁর ব্যক্তিগত)