১২:১৬ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

যান্ত্রিক জীবনে নগর কৃষি

সাদিয়া রহমান: নগরায়ন বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে পরিচিত এবং বহুল ব্যবহৃত শব্দাবলীর একটি। পৃথিবীর ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার মৌলিক, মানবিক এবং যুগোপযোগী চাহিদা পূরণের নিমিত্তে গ্রামাঞ্চল ধ্বংস করে নিত্য নতুন শহর গড়ে তোলা হচ্ছে পৃথিবীর সর্বত্রই। আমাদের দেশও তাঁর ব্যতিক্রম নয়। নগরায়নের সুফল পাবার আশায় লাখে লাখে বনভূমি ধ্বংস করে স্থাপন করা হচ্ছে মার্কেট, অফিস-আদালত সহ নানামুখী প্রতিষ্ঠান ভবন।

খোদ জাতিসংঘের ভাষ্য মতে, ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ শহরে বাস করবে এবং উন্নয়নশীল দেশগুলির শহুরে জনসংখ্যা বর্তমানের চেয়ে দ্বিগুণ হবে। নগরায়নের এই আধিক্যের ভীড়ে আমরা হারাচ্ছি আমাদের পর্যাপ্ত কৃষিজ জমি, উর্বর ভূমি এবং বিশাল পরিমাণে বৃক্ষ সম্পদ।

তাই ভবিষ্যতের সুন্দর জীবন ও জীবিকার ধারা অব্যহত রাখতে এবং বিশাল জনসংখ্যার শহরমুখী হওয়ার দরুণ সৃষ্ট কৃষি জমি এবং উৎপাদনের ঘাটতি পূরণ করতে এখন থেকেই পদক্ষেপ নেয়া উচিত।

এক্ষেত্রে একটি সুন্দর সহজ সমাধান হিসেবে আমরা তুলে ধরতে পারি নগর কৃষির অপার সম্ভাবনার কথা। কৃষি জমির অপ্রতুলতার সংকট সমাধানে নগরে কৃষিজ উৎপাদনের সম্ভাব্যতা যাচাই করে নগর কৃষির ব্যাপক প্রচলন ঘটানো আমাদের জাতীয় দায়িত্ব হিসেবে তুলে ধরা উচিত। এতে একদিকে যেমন জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই করা যাবে, তেমনই পূরণ করা যাবে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের খাদ্য নিরাপত্তার চ্যালেঞ্জ।

থমসন রয়টার্স ফাউন্ডেশন সমীক্ষা থেকে ব্যাখ্যা করেছে,

“নগর খামারগুলি নগরবাসীর জন্য প্রায় সমস্ত প্রস্তাবিত শাকসব্জী সরবরাহ করতে পারে”।

সমীক্ষার ফল অনুসারে, শহুরে কৃষিক্ষেত্রে বর্ধনশীল গাছপালাগুলো, অর্ধেকেরও বেশি বর্ধিত খাদ্য সুরক্ষা সরবরাহ থেকে শুরু করে নগর পরিবেশের একাধিক সমস্যার সমাধান করতে সহায়তা করতে পারে। যেমন, নগরের তাপমাত্রার তীব্রতা হ্রাসে অবদান রাখতে পারে।

আমরা সবসময়ই শুনতে পাই যে, কল-কারখানা, গার্মেন্টস, মার্কেট, বিলাসবহুল অট্টালিকা সহ প্রভৃতি স্থাপনা তৈরীর উদ্দেশ্যে কৃষি জমি অধিগ্রহণ করা হয়। এটা নিঃসন্দেহে খারাপ লাগার একটি ব্যাপার। কিন্তু মুদ্রার উলটো পিঠেই আমরা বলতে পারি, যেসব কৃষি জমি আমরা নগরায়নের উদ্দেশ্যে ছেড়ে দিচ্ছি বা বিক্রি করে দিচ্ছি, সেসব নগরের প্রত্যেকটি বাড়ির গেট, বারান্দা এবং ছাদকে ব্যবহার করেই আমরা নিজেদের খাবার এবং পরিবেশ চাহিদা মেটাতে সক্ষম।

নগরের বাড়িগুলোতে হয়তো মাঠফসল (ধান, গম, ভূট্টা ইত্যাদি) চাষ করা সম্ভব হবেনা, তবে প্রায় সব ধরনের শাকসবজি এবং বিভিন্ন ফলমূল চাষ করে আমরা আবাদী জমিতে এসব চাষের চাপ কমিয়ে আনতে পারি।

নগরকৃষি প্রতিটি দেশেরই মোট কৃষি জমির পরিমাণ বাড়িয়ে তোলে। ফলস্বরূপ, অল্প জমি ব্যবহার করেই একটি দেশের কোটি কোটি মানুষকে কীভাবে পুষ্টিকর খাবার খাওয়ানো সম্ভব, তা নিয়ে সৃষ্ট সমস্যার সমাধান যেমন হয়ে যায়, তেমনভাবেই ভবিষ্যতের জন্যও খাদ্য নিরাপত্তা গড়ে উঠে।

নগরকৃষি বাজার থেকে কিনে আনা শাকসবজি এবং ফলমূলের উপর নির্ভরতা কমায় এবং অন্যান্য দেশ থেকে  আমদানিকৃত পন্যের পরিমানও হ্রাস করতে সহায়তা করে। নগর কৃষি সরাসরি পরিবেশের সাথে জড়িত হওয়ায় এটি মাটির উর্বরতা রক্ষা, পানির গুণগতমান নিশ্চিত করা, জীববৈচিত্র্য রক্ষা, বৃষ্টির পানির সংগ্রহ, পানি পুনর্ব্যবহার, জৈব সার তৈরি ও ব্যবহার ইত্যাদির মাধ্যমে পরিবেশ সচেতনতাকে বৃদ্ধি করতে সহায়তা করে। কেননা যখনই কোনো মানুষ নিজের বাড়ির উঠোনে কিংবা ছাদে কৃষিকাজ করতে চাইবে, তখনই সবচেয়ে সহজ এবং বারবার উপকৃত হওয়া যায় এমন কার্যকর পদ্ধতিগুলোই জানতে আগ্রহী হবে এবং সেসবই ব্যবহার করবে।

প্রচলিত কৃষিকাজের ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা ভোগ করতে হয়, যেমন- বন্যা, খরা, পানির অপচয় কিংবা অন্যান্য সমস্যা। এসব বিষয় নগর কৃষির ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রন করা তুলনামূলক অনেক সহজ। এখানে যেমন পানির যথোপযুক্ত ও কার্যকর ব্যবহার হয়, তেমনি বন্যা/খরার ভয়ও নেই। হাইড্রোফনিক পদ্ধতিতে, প্রচলিত কৃষিকাজের চেয়ে প্রায় ৯০% কম পানি দরকার হয় নগর কৃষিতে।

নগর কৃষির আরেকটি বিশেষ সুবিধা হচ্ছে চড়াদামে কৃষিজ পণ্য ক্রয় করার ভোগান্তিতে না পড়া। গ্রামে উৎপন্ন সব্জি, ফলমূল সমূহ যাতায়াত খরচ এবং অন্যান্য খরচা করে শহরে আনা হয়। ফলশ্রুতিতে উৎপাদন খরচের চেয়ে বিক্রয়মূল্য কয়েক গুণ হয়ে থাকে। একই সঙ্গে সময়সাধ্য হওয়ায় খরিদকৃত পণ্যের গুণগত মান নিয়েও যথেষ্ট সংশয় থাকেই। নগর কৃষিতে আমাদেরকে এই ধরণের ভোগান্তিতে মোটেও পড়তে হবেনা।

আমাদের শহুরে বাড়িগুলোর আশেপাশে যদি বেশ কিছুটা জমি পতিত থাকে কিংবা বাড়ির ছাদটা বেশ বড় হয়, তাহলে সেখানে কৃষি ফলন করে হয়তো একটা পরিবারের প্রয়োজনীয় চাহিদা মিটিয়েও প্রচুর পরিমাণে খাদ্যের যোগান দেয়া সম্ভব হবে।

এতে করে যে কেউ অন্যান্য ফ্ল্যাটের কিংবা আশেপাশের বাসাবাড়ির লোকজনদের কাছেও বাড়তি জিনিস বিক্রি করতে পারবে। এতে করে প্লাস্টিক/পলিব্যাগ (যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর) ব্যবহার কমবে। পাশাপাশি ছোট আকারে হলেও একটা ব্যবসায়িক মডেল দাড় করানো সম্ভব হবে যাতে অর্থ উপার্জনের পথটাও সুগম হবে। একই সঙ্গে যদি এই ব্যবসার পরিসরকে বড় করা যায়, সেটা নতুন কর্মসংস্থানেরও সন্ধান দিবে।

নগর কৃষি থেকে বিভিন্ন ধরনের খাদ্য, যেমন -উদ্ভিজ্জ, ভেষজ, ফলমূল কিংবা পাখি/কবুতরপালন করে বিভিন্ন পণ্য সরবরাহের সুযোগ রয়েছে। এর মাধ্যমে নতুন অর্থনীতি তৈরি করে একটি শহরের অর্থনৈতিক ভিত্তিকে প্রসারিত করতে পারে। তাই নগর কৃষির অপার সম্ভাবনার এই বিশেষ দিকগুলো নিয়ে আমাদেরকে এখনই চিন্তা করতে হবে।

একটি সম্প্রদায়কে সুস্থ, প্রাণবন্ত এবং পরিশ্রমী তখনই বলা হয়, যখন তাদের রোগমুক্ত, স্বাভাবিক শারীরিক গঠন এবং অর্থনৈতিক গঠন উন্নত থাকে। নগর কৃষি যেভাবে অর্থনৈতিক ভাবে সাহায্য করতে পারে, তেমন ভাবেই খাদ্য সুরক্ষা বৃদ্ধি করে, পাশাপাশি পুষ্টি সমৃদ্ধ খাদ্যও অনেকাংশে নিশ্চিত করে।

যখন নিজের উঠোনে/বাগানে/ছাদে আমরা কৃষিজ পন্য উৎপাদনের চিন্তা করবো, তখন অবশ্যই উপযুক্ত মাটি, পরিষ্কার পানি এবং জৈব সার ব্যবহার করার সিদ্ধান্তই গ্রহন করবো এবং যত্ন সহকারে গাছপালাগুলোকে বেড়ে উঠতে সাহায্য করবো। ফলে খাদ্যের গুণগত মান সম্পর্কেও কোনো সন্দেহের অবকাশ থাকবেনা।

নগরায়নের ব্যপকতায় এবং আধুনিক বিজ্ঞানের কড়াল গ্রাসে, আমরা প্রায়শই চার দেয়ালের ভেতরে ডিজিটাল বন্দী হিসেবে থাকতে বাধ্য। প্রকৃতিকে উপভোগ করার পর্যাপ্ত সময় কিংবা সুযোগ না থাকায় আমরা প্রতিনিয়তই আক্রান্ত হচ্ছি মারাত্নক সব মরনঘাতী ব্যাধিতে কিংবা অবসাদ গ্রস্ত হয়ে পড়ছি।

শহরগুলির ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার বেশিরভাগই অপুষ্টি এবং ডায়েট সম্পর্কিত অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন। নগর কৃষি স্থানীয়ভাবে সমাজের পুষ্টিকর এবং স্বাস্থ্যকর খাদ্যদ্রব্য পৌছাতে সক্ষম। একই সঙ্গে মানসিকভাবে অবসাদ মুক্ত হতে ভূমিকা রাখতেও সক্ষম।

তাই, বর্তমানে শহুরে জনসংখ্যার এই পরিস্থিতিতে তাদের ভালো স্বাস্থ্য, মানসিকভাবে উৎফুল্ল রাখতে নগরকৃষি অত্যন্ত জরুরী। উদ্ভিদের বুনন, মাটি খনন, আগাছা পরিষ্কার এবং যাবতীয় অন্যান্য কাজ, মানুষের শরীরের গতিবিধিকে ঠিকঠাক রাখে এবং শরীরের পেশীগুলিকে প্রসারিত করে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বাগান করার অনুশীলনগুলো ক্যালোরিকে দ্রুত পোড়ায় (খনন এবং স্থানান্তর: ২৫০ ক্যালরি, আগাছা পরিষ্কার: ১০৫ ক্যালরি, অন্যান্য : 100 ক্যালোরি) এবং স্থূলতা, ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগের সামগ্রিক ঝুঁকি হ্রাস করে।

সামগ্রিকভাবে শহুরে উদ্যানগুলি কেবল ব্যক্তিগত কিংবা অর্থনৈতিক দিকই নয় বরং পরিবেশকেও উপকৃত করবে। শহরে উদ্যান কিংবা গাছপালা বৃদ্ধি পেলে শহরে পশুপাখি এবং উপকারী পতঙ্গের সংখ্যাও বাড়বে। গাছপালা থেকে ফুল উৎপাদিত হবে এবং উপকারী পোকামাকড় পরাগায়ণ ঘটাবে। এতে করে এই অঞ্চলের সামগ্রিক পরিবেশগত অবস্থার উন্নতি দৃশ্যমান হবে।

নগরকৃষির কারনে নগর বিল্ডিংয়ের ধূসর ছাদ এবং দেয়ালগুলি সবুজ হয়ে কেবল অঞ্চলটির চেহারাই উন্নত করবে না, এমনকি বায়ুতে অক্সিজেন বৃদ্ধি করবে করে বায়ুকেও দূষনমুক্ত রাখবে। একইসঙ্গে কার্বন নিঃসরন মাত্রা কমিয়ে পরিবেশকে সুস্হ অবস্থা দান করবে।

মোটকথা নগরকৃষি গ্রীনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমাতে এবং পুষ্টি সমৃদ্ধ খাবার বৃদ্ধিতে, উদ্ভিদের ধ্বংসাবশেষ এবং অন্যান্য ‘বর্জ্য’ পুনর্ব্যবহার করতেও সহায়তা করবে।

নগর কৃষি নিয়ে এই লিখাটি শেষ করতে চাই একটি প্রস্তাবনার মাধ্যমে। চিরায়তকাল ধরে চলে আসা আমাদের সামাজিক বন্ধন বর্তমানে নগরায়নের বিষাক্ত ছোবলে মৃতপ্রায়। এমতাবস্থায় নগর কৃষির একটি সুন্দর মাধ্যমকে ব্যবহার করে আবারও আমাদের সামাজিক বন্ধনকে দৃঢ় করতে কাজে লাগানো যায়।

সেটি হচ্ছে, নগরের বাড়ি গুলোর মাঝে, অন্তত পাশাপাশি অবস্থান করা প্রতি দুটো বাড়ির বাসিন্দাগণ তাঁদের মাঝে যে বাউন্ডারী সীমাটি ব্যবহার করেন, সেই বাউন্ডারীটি ইট-পাথরের না হয়ে, গড়ে তোলা হোক বড় বড় পাঁচ-ছয়টি গাছের মাধ্যমে। অর্থাৎ সাধারনভাবে আপনার বাড়ী এবং আমার বাড়ির মাঝে যে বাউন্ডারীর দেয়ালটি তুলে দিয়ে সীমানা চিহ্নিত করি আমরা, সেই সীমানাটিকে আমরা চাইলেই ইট-পাথরের বদলে গাছের মাধ্যমে নির্ধারণ করতে পারি। এতে করে পরিবেশে বৃক্ষরোপণ যেমন বাড়বে, একই সঙ্গে বৃদ্ধি পাবে আমাদের আন্ত সামাজিক যোগাযোগ। বৃদ্ধি পাবে আমাদের পারস্পরিক মেলামেশা। বাচ্চাদের জন্য বাড়বে খেলাধুলার জায়গা। সর্বোপরি বাড়বে আবহমান কাল থেকে চলে আসা আমাদের সামাজিক ভার্তৃত্বের অটুট বন্ধন। তাই নগর কৃষির ব্যাপারে এখনই ব্যাপক উদ্যোগ নেয়া উচিত।

লেখক: সাদিয়া রহমান, শিক্ষার্থী, এগ্রিকালচার, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

ট্যাগ:
জনপ্রিয়

যান্ত্রিক জীবনে নগর কৃষি

প্রকাশ: ০৯:২৭:২১ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২০

সাদিয়া রহমান: নগরায়ন বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে পরিচিত এবং বহুল ব্যবহৃত শব্দাবলীর একটি। পৃথিবীর ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার মৌলিক, মানবিক এবং যুগোপযোগী চাহিদা পূরণের নিমিত্তে গ্রামাঞ্চল ধ্বংস করে নিত্য নতুন শহর গড়ে তোলা হচ্ছে পৃথিবীর সর্বত্রই। আমাদের দেশও তাঁর ব্যতিক্রম নয়। নগরায়নের সুফল পাবার আশায় লাখে লাখে বনভূমি ধ্বংস করে স্থাপন করা হচ্ছে মার্কেট, অফিস-আদালত সহ নানামুখী প্রতিষ্ঠান ভবন।

খোদ জাতিসংঘের ভাষ্য মতে, ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ শহরে বাস করবে এবং উন্নয়নশীল দেশগুলির শহুরে জনসংখ্যা বর্তমানের চেয়ে দ্বিগুণ হবে। নগরায়নের এই আধিক্যের ভীড়ে আমরা হারাচ্ছি আমাদের পর্যাপ্ত কৃষিজ জমি, উর্বর ভূমি এবং বিশাল পরিমাণে বৃক্ষ সম্পদ।

তাই ভবিষ্যতের সুন্দর জীবন ও জীবিকার ধারা অব্যহত রাখতে এবং বিশাল জনসংখ্যার শহরমুখী হওয়ার দরুণ সৃষ্ট কৃষি জমি এবং উৎপাদনের ঘাটতি পূরণ করতে এখন থেকেই পদক্ষেপ নেয়া উচিত।

এক্ষেত্রে একটি সুন্দর সহজ সমাধান হিসেবে আমরা তুলে ধরতে পারি নগর কৃষির অপার সম্ভাবনার কথা। কৃষি জমির অপ্রতুলতার সংকট সমাধানে নগরে কৃষিজ উৎপাদনের সম্ভাব্যতা যাচাই করে নগর কৃষির ব্যাপক প্রচলন ঘটানো আমাদের জাতীয় দায়িত্ব হিসেবে তুলে ধরা উচিত। এতে একদিকে যেমন জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই করা যাবে, তেমনই পূরণ করা যাবে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের খাদ্য নিরাপত্তার চ্যালেঞ্জ।

থমসন রয়টার্স ফাউন্ডেশন সমীক্ষা থেকে ব্যাখ্যা করেছে,

“নগর খামারগুলি নগরবাসীর জন্য প্রায় সমস্ত প্রস্তাবিত শাকসব্জী সরবরাহ করতে পারে”।

সমীক্ষার ফল অনুসারে, শহুরে কৃষিক্ষেত্রে বর্ধনশীল গাছপালাগুলো, অর্ধেকেরও বেশি বর্ধিত খাদ্য সুরক্ষা সরবরাহ থেকে শুরু করে নগর পরিবেশের একাধিক সমস্যার সমাধান করতে সহায়তা করতে পারে। যেমন, নগরের তাপমাত্রার তীব্রতা হ্রাসে অবদান রাখতে পারে।

আমরা সবসময়ই শুনতে পাই যে, কল-কারখানা, গার্মেন্টস, মার্কেট, বিলাসবহুল অট্টালিকা সহ প্রভৃতি স্থাপনা তৈরীর উদ্দেশ্যে কৃষি জমি অধিগ্রহণ করা হয়। এটা নিঃসন্দেহে খারাপ লাগার একটি ব্যাপার। কিন্তু মুদ্রার উলটো পিঠেই আমরা বলতে পারি, যেসব কৃষি জমি আমরা নগরায়নের উদ্দেশ্যে ছেড়ে দিচ্ছি বা বিক্রি করে দিচ্ছি, সেসব নগরের প্রত্যেকটি বাড়ির গেট, বারান্দা এবং ছাদকে ব্যবহার করেই আমরা নিজেদের খাবার এবং পরিবেশ চাহিদা মেটাতে সক্ষম।

নগরের বাড়িগুলোতে হয়তো মাঠফসল (ধান, গম, ভূট্টা ইত্যাদি) চাষ করা সম্ভব হবেনা, তবে প্রায় সব ধরনের শাকসবজি এবং বিভিন্ন ফলমূল চাষ করে আমরা আবাদী জমিতে এসব চাষের চাপ কমিয়ে আনতে পারি।

নগরকৃষি প্রতিটি দেশেরই মোট কৃষি জমির পরিমাণ বাড়িয়ে তোলে। ফলস্বরূপ, অল্প জমি ব্যবহার করেই একটি দেশের কোটি কোটি মানুষকে কীভাবে পুষ্টিকর খাবার খাওয়ানো সম্ভব, তা নিয়ে সৃষ্ট সমস্যার সমাধান যেমন হয়ে যায়, তেমনভাবেই ভবিষ্যতের জন্যও খাদ্য নিরাপত্তা গড়ে উঠে।

নগরকৃষি বাজার থেকে কিনে আনা শাকসবজি এবং ফলমূলের উপর নির্ভরতা কমায় এবং অন্যান্য দেশ থেকে  আমদানিকৃত পন্যের পরিমানও হ্রাস করতে সহায়তা করে। নগর কৃষি সরাসরি পরিবেশের সাথে জড়িত হওয়ায় এটি মাটির উর্বরতা রক্ষা, পানির গুণগতমান নিশ্চিত করা, জীববৈচিত্র্য রক্ষা, বৃষ্টির পানির সংগ্রহ, পানি পুনর্ব্যবহার, জৈব সার তৈরি ও ব্যবহার ইত্যাদির মাধ্যমে পরিবেশ সচেতনতাকে বৃদ্ধি করতে সহায়তা করে। কেননা যখনই কোনো মানুষ নিজের বাড়ির উঠোনে কিংবা ছাদে কৃষিকাজ করতে চাইবে, তখনই সবচেয়ে সহজ এবং বারবার উপকৃত হওয়া যায় এমন কার্যকর পদ্ধতিগুলোই জানতে আগ্রহী হবে এবং সেসবই ব্যবহার করবে।

প্রচলিত কৃষিকাজের ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা ভোগ করতে হয়, যেমন- বন্যা, খরা, পানির অপচয় কিংবা অন্যান্য সমস্যা। এসব বিষয় নগর কৃষির ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রন করা তুলনামূলক অনেক সহজ। এখানে যেমন পানির যথোপযুক্ত ও কার্যকর ব্যবহার হয়, তেমনি বন্যা/খরার ভয়ও নেই। হাইড্রোফনিক পদ্ধতিতে, প্রচলিত কৃষিকাজের চেয়ে প্রায় ৯০% কম পানি দরকার হয় নগর কৃষিতে।

নগর কৃষির আরেকটি বিশেষ সুবিধা হচ্ছে চড়াদামে কৃষিজ পণ্য ক্রয় করার ভোগান্তিতে না পড়া। গ্রামে উৎপন্ন সব্জি, ফলমূল সমূহ যাতায়াত খরচ এবং অন্যান্য খরচা করে শহরে আনা হয়। ফলশ্রুতিতে উৎপাদন খরচের চেয়ে বিক্রয়মূল্য কয়েক গুণ হয়ে থাকে। একই সঙ্গে সময়সাধ্য হওয়ায় খরিদকৃত পণ্যের গুণগত মান নিয়েও যথেষ্ট সংশয় থাকেই। নগর কৃষিতে আমাদেরকে এই ধরণের ভোগান্তিতে মোটেও পড়তে হবেনা।

আমাদের শহুরে বাড়িগুলোর আশেপাশে যদি বেশ কিছুটা জমি পতিত থাকে কিংবা বাড়ির ছাদটা বেশ বড় হয়, তাহলে সেখানে কৃষি ফলন করে হয়তো একটা পরিবারের প্রয়োজনীয় চাহিদা মিটিয়েও প্রচুর পরিমাণে খাদ্যের যোগান দেয়া সম্ভব হবে।

এতে করে যে কেউ অন্যান্য ফ্ল্যাটের কিংবা আশেপাশের বাসাবাড়ির লোকজনদের কাছেও বাড়তি জিনিস বিক্রি করতে পারবে। এতে করে প্লাস্টিক/পলিব্যাগ (যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর) ব্যবহার কমবে। পাশাপাশি ছোট আকারে হলেও একটা ব্যবসায়িক মডেল দাড় করানো সম্ভব হবে যাতে অর্থ উপার্জনের পথটাও সুগম হবে। একই সঙ্গে যদি এই ব্যবসার পরিসরকে বড় করা যায়, সেটা নতুন কর্মসংস্থানেরও সন্ধান দিবে।

নগর কৃষি থেকে বিভিন্ন ধরনের খাদ্য, যেমন -উদ্ভিজ্জ, ভেষজ, ফলমূল কিংবা পাখি/কবুতরপালন করে বিভিন্ন পণ্য সরবরাহের সুযোগ রয়েছে। এর মাধ্যমে নতুন অর্থনীতি তৈরি করে একটি শহরের অর্থনৈতিক ভিত্তিকে প্রসারিত করতে পারে। তাই নগর কৃষির অপার সম্ভাবনার এই বিশেষ দিকগুলো নিয়ে আমাদেরকে এখনই চিন্তা করতে হবে।

একটি সম্প্রদায়কে সুস্থ, প্রাণবন্ত এবং পরিশ্রমী তখনই বলা হয়, যখন তাদের রোগমুক্ত, স্বাভাবিক শারীরিক গঠন এবং অর্থনৈতিক গঠন উন্নত থাকে। নগর কৃষি যেভাবে অর্থনৈতিক ভাবে সাহায্য করতে পারে, তেমন ভাবেই খাদ্য সুরক্ষা বৃদ্ধি করে, পাশাপাশি পুষ্টি সমৃদ্ধ খাদ্যও অনেকাংশে নিশ্চিত করে।

যখন নিজের উঠোনে/বাগানে/ছাদে আমরা কৃষিজ পন্য উৎপাদনের চিন্তা করবো, তখন অবশ্যই উপযুক্ত মাটি, পরিষ্কার পানি এবং জৈব সার ব্যবহার করার সিদ্ধান্তই গ্রহন করবো এবং যত্ন সহকারে গাছপালাগুলোকে বেড়ে উঠতে সাহায্য করবো। ফলে খাদ্যের গুণগত মান সম্পর্কেও কোনো সন্দেহের অবকাশ থাকবেনা।

নগরায়নের ব্যপকতায় এবং আধুনিক বিজ্ঞানের কড়াল গ্রাসে, আমরা প্রায়শই চার দেয়ালের ভেতরে ডিজিটাল বন্দী হিসেবে থাকতে বাধ্য। প্রকৃতিকে উপভোগ করার পর্যাপ্ত সময় কিংবা সুযোগ না থাকায় আমরা প্রতিনিয়তই আক্রান্ত হচ্ছি মারাত্নক সব মরনঘাতী ব্যাধিতে কিংবা অবসাদ গ্রস্ত হয়ে পড়ছি।

শহরগুলির ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার বেশিরভাগই অপুষ্টি এবং ডায়েট সম্পর্কিত অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন। নগর কৃষি স্থানীয়ভাবে সমাজের পুষ্টিকর এবং স্বাস্থ্যকর খাদ্যদ্রব্য পৌছাতে সক্ষম। একই সঙ্গে মানসিকভাবে অবসাদ মুক্ত হতে ভূমিকা রাখতেও সক্ষম।

তাই, বর্তমানে শহুরে জনসংখ্যার এই পরিস্থিতিতে তাদের ভালো স্বাস্থ্য, মানসিকভাবে উৎফুল্ল রাখতে নগরকৃষি অত্যন্ত জরুরী। উদ্ভিদের বুনন, মাটি খনন, আগাছা পরিষ্কার এবং যাবতীয় অন্যান্য কাজ, মানুষের শরীরের গতিবিধিকে ঠিকঠাক রাখে এবং শরীরের পেশীগুলিকে প্রসারিত করে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বাগান করার অনুশীলনগুলো ক্যালোরিকে দ্রুত পোড়ায় (খনন এবং স্থানান্তর: ২৫০ ক্যালরি, আগাছা পরিষ্কার: ১০৫ ক্যালরি, অন্যান্য : 100 ক্যালোরি) এবং স্থূলতা, ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগের সামগ্রিক ঝুঁকি হ্রাস করে।

সামগ্রিকভাবে শহুরে উদ্যানগুলি কেবল ব্যক্তিগত কিংবা অর্থনৈতিক দিকই নয় বরং পরিবেশকেও উপকৃত করবে। শহরে উদ্যান কিংবা গাছপালা বৃদ্ধি পেলে শহরে পশুপাখি এবং উপকারী পতঙ্গের সংখ্যাও বাড়বে। গাছপালা থেকে ফুল উৎপাদিত হবে এবং উপকারী পোকামাকড় পরাগায়ণ ঘটাবে। এতে করে এই অঞ্চলের সামগ্রিক পরিবেশগত অবস্থার উন্নতি দৃশ্যমান হবে।

নগরকৃষির কারনে নগর বিল্ডিংয়ের ধূসর ছাদ এবং দেয়ালগুলি সবুজ হয়ে কেবল অঞ্চলটির চেহারাই উন্নত করবে না, এমনকি বায়ুতে অক্সিজেন বৃদ্ধি করবে করে বায়ুকেও দূষনমুক্ত রাখবে। একইসঙ্গে কার্বন নিঃসরন মাত্রা কমিয়ে পরিবেশকে সুস্হ অবস্থা দান করবে।

মোটকথা নগরকৃষি গ্রীনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমাতে এবং পুষ্টি সমৃদ্ধ খাবার বৃদ্ধিতে, উদ্ভিদের ধ্বংসাবশেষ এবং অন্যান্য ‘বর্জ্য’ পুনর্ব্যবহার করতেও সহায়তা করবে।

নগর কৃষি নিয়ে এই লিখাটি শেষ করতে চাই একটি প্রস্তাবনার মাধ্যমে। চিরায়তকাল ধরে চলে আসা আমাদের সামাজিক বন্ধন বর্তমানে নগরায়নের বিষাক্ত ছোবলে মৃতপ্রায়। এমতাবস্থায় নগর কৃষির একটি সুন্দর মাধ্যমকে ব্যবহার করে আবারও আমাদের সামাজিক বন্ধনকে দৃঢ় করতে কাজে লাগানো যায়।

সেটি হচ্ছে, নগরের বাড়ি গুলোর মাঝে, অন্তত পাশাপাশি অবস্থান করা প্রতি দুটো বাড়ির বাসিন্দাগণ তাঁদের মাঝে যে বাউন্ডারী সীমাটি ব্যবহার করেন, সেই বাউন্ডারীটি ইট-পাথরের না হয়ে, গড়ে তোলা হোক বড় বড় পাঁচ-ছয়টি গাছের মাধ্যমে। অর্থাৎ সাধারনভাবে আপনার বাড়ী এবং আমার বাড়ির মাঝে যে বাউন্ডারীর দেয়ালটি তুলে দিয়ে সীমানা চিহ্নিত করি আমরা, সেই সীমানাটিকে আমরা চাইলেই ইট-পাথরের বদলে গাছের মাধ্যমে নির্ধারণ করতে পারি। এতে করে পরিবেশে বৃক্ষরোপণ যেমন বাড়বে, একই সঙ্গে বৃদ্ধি পাবে আমাদের আন্ত সামাজিক যোগাযোগ। বৃদ্ধি পাবে আমাদের পারস্পরিক মেলামেশা। বাচ্চাদের জন্য বাড়বে খেলাধুলার জায়গা। সর্বোপরি বাড়বে আবহমান কাল থেকে চলে আসা আমাদের সামাজিক ভার্তৃত্বের অটুট বন্ধন। তাই নগর কৃষির ব্যাপারে এখনই ব্যাপক উদ্যোগ নেয়া উচিত।

লেখক: সাদিয়া রহমান, শিক্ষার্থী, এগ্রিকালচার, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।